গত দশটি মাস—মৌলভীবাজার যেন এক ধূসর প্রতীক্ষার শহর। নাগরিক জীবনের সকল ছন্দ থেমে আছে এক অদৃশ্য বিষাদের প্রবাহে। শেখ হাসিনার পতনের পর, যে শূন্যতা তৈরি হয়েছে রাজনীতির মঞ্চে, তার ধ্বনি প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরছে এই শহরের ভেজা অলিগলিতে, ভেঙে পড়া ড্রেনেজ লাইনে, এবং মানুষের মলিন চোখে।
যে নেতারা একদিন শহরের মঞ্চে বর্ণিল আলোর মতো দাঁড়িয়েছিলেন—তাঁরা আজ আড়ালে, ছায়ার নিচে, আত্মগোপনে। মেয়র, কমিশনার, কাউন্সিলর—নাম ছিল, পদ ছিল, ছিল প্রভাব; এখন নেই কিছুই। আছে শুধু ভয়ের ছায়া। যাদের ভয়? এক উগ্র মবের, যারা ‘নতুন সময়’-এর নামে আইনকে পায়ের নিচে দলিত করে, নাগরিক দায়িত্বকে বিদ্রুপে পরিণত করে তুলেছে।
এক পশলা বৃষ্টিই এখন মৌলভীবাজারকে ডুবিয়ে দিতে যথেষ্ট। কুদালিছড়া, যা ছিল এই শহরের নাভি, তার নিঃশ্বাস বন্ধ দশ মাস ধরে। একসময় যেভাবে ছড়ার পেট কেটে, ময়লা তুলে, শহরকে শ্বাস নিতে দেওয়া হতো—তা এখন আর হয় না। সাফাই বন্ধ, খনন থেমে আছে, ছড়ার বুকে এখন জমে আছে প্রশাসনিক উদাসীনতার কাদা।
নগর মানেই শুধু ভবন নয়, বিদ্যুৎ নয়, রাস্তা নয়—নগর মানে হচ্ছে অভিভাবকত্ব। অভিভাবকহীন সংসার যেমন ছন্নছাড়া হয়, ঠিক তেমনি অভিভাবকহীন শহর হয়ে পড়ে জল, জঞ্জাল আর যন্ত্রণার বন্দী।
মৌলভীবাজার ছিল এমন এক জেলা যেখানে রাজনীতির নামে হানাহানি খুব বেশি দেখা যেত না। দলের ভিন্নতা থাকলেও, হৃদয়ের সৌজন্য ছিল এক। একজন আওয়ামী করলেও আরেকজন বিএনপি করতেন সহমর্মিতায়—চায়ের দোকানে ঝগড়া হতো, কিন্তু হাত মেলাতেও দ্বিধা ছিল না। কিন্তু এখন? এই সরকারঘেঁষা উশৃঙ্খল একদল, যাদের শিকড় নেই, যাদের মুখে শুধু হুমকি আর চোখে শুধু ক্ষমতার লালসা—তারা এসে সবকিছু ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে।
শহর তলিয়ে যাচ্ছে পানিতে—আর আমরা শুধুই দেখছি। কেউ আসছে না, কেউ বলছে না, কেউ জিজ্ঞেস করছে না “কেন?”। যে ছড়া ছিল আমাদের প্রাণ, তা এখন পচা। যে রাস্তায় হেঁটেছি শতাব্দী ধরে, তা এখন হাঁটু জলমগ্ন।
তথাকথিত ফেরেশতা-সরকারের এই সময়ে, মৌলভীবাজার যেন হয়ে উঠেছে এক নির্বাক শহর—যেখানে নাগরিকেরা শুধুই ভুক্তভোগী, অথচ কোনো অভিভাবক নেই, কোনো দায় নেই। এই নগর এখন নিজের ভারে নিজেই ডুবে যাচ্ছে, আর আমরা? দাঁড়িয়ে আছি ছাউনিহীন বারান্দায়, গা ছমছমে ভবিষ্যতের দিকে চেয়ে।
লেখকঃ কবি আবু মকসুদ