বাংলাদেশের ওপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতি নিয়ে চলছে নানান জল্পনা কল্পনা। এটি হচ্ছে বাংলাদেশে বর্তমানে ’টক অব দ্যা কান্ট্রি’।
সম্পতি মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের এক সংবাদ সম্মেলনে জনৈক সাংবাদিকের এক প্রশ্নের জবাবে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথু মিলার বলেন যে, গত মে মাসে পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনী ব্লিংকের নতুন ভিসা নীতি ঘোষণা করেছিলেন। এর উদ্দেশ্য ছিল না যে বাংলদেশে একটি নির্বাচনে পক্ষ নেয়া বরং অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ জাতীয় নির্বাচনকে সমর্থন করা।
এদিকে গত ২২ সেপ্টেম্বর মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার এক বিবৃতিতে জানিয়েছিলেন, বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বাধাদানকারীদের বিরুদ্ধে ভিসা নিষেধ্জ্ঞাা আরোপ করতে শুক্রবার থেকে পদক্ষেপ নিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। এসব ব্যক্তিদের মধ্যে বর্তমান ও সাবেক বাংলাদেশী কর্মকর্তা, আইন প্রয়োগকারী, বিচার বিভাগ, নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য সহ ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধী রাজনৈতিক দলের সদস্য অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
বিবৃতিতে জানানো হয়েছে, এসব ব্যক্তি এবং তাদের পরিবারের সদস্যরা যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের জন্য অযোগ্য বলে বিবেচিত হবেন। বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে ক্ষুণ্ন করার জন্য দায়ী বা জড়িত বলে প্রমাণ হলে ভবিষ্যতে অন্যদের ওপরও এ নীতির অধীনে ভিসা নিষেধ্জ্ঞাা জারি হতে পারে।
এদিকে ভিসানীতি প্রয়োগের প্রক্রিয়া সহ নানা বিষয় নিয়ে একটি গণমাধ্যকে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক সহকারী সেক্রেটারী ডোনাল্ড লু।
ডোনাল্ড লু বলেন, আমরা শুরু থেকেই বলেছি, এই নীতির আওতায় ভিসা নিষেধাজ্ঞা যাদের দেয়া হবে, তাদের নাম আমরা প্রকাশ করবো না। কাউকে ভিসা না দেয়া সহ যে কোনো ভিসা রেকর্ড মার্কিন আইন অনুযায়ী গোপনীয় তথ্য।
”আমি এটুকু বলতে পারি যে এই নীতি ঘোষণা করার পর থেকে সার্বিক ঘটনা খুব কাছ থেকে আমরা দেখেছি। সাক্ষ্য-প্রমান ভালোভাবে পর্য্যালোচনা করার পর আমরা আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধী রাজনৈতিক দলের সদস্যদের ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছি।”
যুক্তরাষ্ট্রের দেয়া বাংলাদেশের উপর ভিসা নীতি প্রয়োগের উপর বিশ্লেষন করার পূর্বে, গত আগষ্ট মাসে দক্ষিণ আফ্রিকার জোহেন্সবার্গে অনুষ্ঠিত ১৫তম “ব্রিকস’ সম্মেলনের বাংলাদেশের ভুমিকার কিছু তথ্য তুলে ধরছি, যাতে ভিসা নীতির পুরো বিষয়টি আমার পাঠকদের বুঝতে সুবিথা হয়।
ব্রিকস সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর বক্তব্যে বলেছেন, ব্রিকসকে বহুমুখী বিশ্বের বাতিঘর হিসেবে আবির্ভুত হতে হবে এবং প্রতিক্রিয়ার সময় অন্তর্ভুক্তিমূলক প্ল্যাটফর্ম হতে হবে। তিনি বলেন, আমাদের এই বহুমুখী বিশ্বে ব্রিকসকে একটি বাতিঘর হিসেবে প্রয়োজন। আমরা আশা করি- আমাদের প্রতি প্রক্রিয়ার সময় এটি একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক প্ল্যাটফরম হিসেবে আবির্ভুত হবে। আমাদের শিশু ও যুবকদের কাছে অবশ্যই প্রমাণ করতে হবে যে, আমাদের জাতিগুলো সংকটে পড়তে পারে, কিন্তু কখনই পরাজিত হবেনা
প্রধানমন্ত্রী জোহেন্সবার্গের স্যান্ডটন কনভেনশন সেন্টারে ৭০টি দেশের প্রতিনিধিদের নিয়ে ফ্রেন্ডস অব ব্রিকস লিডার ডায়ালগ (বিকস-আফ্রিকা আউটরিচ এন্ড দ্য ব্রিকস প্লাস ডায়ালগ) ’নিউ ডেভেলাপমেন্ট ব্যাংক অব ব্রিকস’ এর সদস্য হিসেবে বাংলাদেশের পক্ষে তিনি এসব কথা বলেন।
গ্লোবাল সাউথ-এ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের ওপর চাপিয়ে দেয়া তথাকথিত পছন্দ ও বিভাজনকে ’না’ বলা উচিত। সার্বজনিন নিয়ম ও মূল্যবোধকে অস্ত্রে পরিণত করার প্রচেষ্টাকে আমাদের অবশ্যই প্রত্যাখ্যান করতে হবে। আমাদের নিষেধাজ্ঞা ও পাল্টা নিষেধাজ্ঞার চক্র পরিহার করতে হবে। তিনি বলেন আমাদের সবাইকে সব ধরণের হুমকি, উস্কানী ও যুদ্ধের বিরুদ্ধে কথা বলতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, সকলকে এক সাথে অবশ্যই আন্তর্জাতিক অর্থায়ন ও প্রযুক্তির জন্য প্রত্যেকের প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে এবং জলবায়ূ, ন্যায় বিচার, অভিবাসীদের অধিকার, ডিজিটাল ইক্যুইটি এবং ঋণ স্থায়িত্বের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।
উক্ত সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইরানের প্রেসিডেন্ট ইবরাহিম রাইসি, ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট জোকো উইদোদো, জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসে ছাড়াও আরও বেশ কয়েকটি দেশের সরকার প্রধানদের সাথে সাক্ষাত ও মতবিনিময় করেছেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ধারণা, দক্ষিণ আফ্রিকার জোহেন্সবার্গে অনুষ্ঠিত আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘ মহাসচিব সহ বিভিন্ন দেশের সরকার প্রধানদের সাথে মিলিত হয়ে যে একটি প্লাটফর্ম তৈরী করেছেন এবং কোনোদিন যদি বাংলাদেশ আমেরিকান ব্লক থেকে বেরিয়ে গিয়ে ’ব্রিকস’ এর সাথে হাত মেলায় সেজন্য সেটিকে যুক্তরাষ্ট্রের বাইডেন প্রশাসন তাদের প্রতি একটি বিরাট হুমকি হিসেবে গণ্য করছে। সুতরাং যে ভাবেই হোক বাংলাদেশকে তাদের হাতে রাখার জন্য এই ভিসা নীতি প্রয়োগ করেছে। তারা মনে করছে, এই ভিসা নীতির ভয়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জ্বী হুজুর বলে তাদের কাছে মাথা নত করবে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে বরং তার উল্টোটাই হচ্ছে।
ভিসানীতির উপরের অংশটি বিশ্লেষণ করলে দু’টি অর্থ দাঁড়ায়। প্রথমটি হচ্ছে, নির্বাচন অনুষ্ঠানের শেষ সময় পর্য্যন্ত বাইডেন প্রশাসন অপেক্ষা করবে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাদের সাথে কোন সমঝোতায় যান কি না। যদি তাদের সাথে হাত মিলান, তাহলে বাইডেন প্রশাসন আওয়ামী লীগের পক্ষেই কাজ করবে অর্থাৎ আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় বসানোর লক্ষ্যে বিএনপি সহ অন্যান্য বিরোধী দলকে নির্বাচনে আনার ওয়াদা করবে বলে একটি ’টোপ’ দেবে। শেখ হাসিনা যদি এই ’টোপ’ গিলে ফেলেন তাহলে তো বাইডেনের জন্য হবে সোনায় সোহাগা’, আর যদি তা না হয় তাহলে নির্বাচনের সময় আওয়ামী লীগের ওপর পড়বে ভিসা নীতির পূর্ণ প্রভাব। তখন আওয়ামী লীগ সরকার যতোই চেষ্টা করুক না কেন সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ নির্বাচন করার জন্য, তা তারা হতে দেবে না বরং সুষ্ঠু নির্বাচন হলেও তা স্বীকার করবে না। তখন তাদের তাবেদার বিএনপি-জামায়াতকে কাজে লাগিয়ে নির্বাচনের পূর্বেই বানচালের চেষ্টা করতে ত্রুটি করবে না। পরে দেখা যাবে আওয়ামী লীগের ঘাড়েই সব ভিসা নিষেধাজ্ঞা।
এই নিষেধাজ্ঞার দ্বিতীয় কারণটি হচ্ছে : বাইডেন প্রশাসন মনে করছে যে, যদি উল্লেখিত ব্যক্তিদের উপর নিষেধাজ্ঞার ভয় দেখানো হয়, তাহলে তাদের নিজেদেরকে এই নিষেধাজ্ঞার হাত থেকে বাঁচার জন্য সরকারের বিরুদ্ধে তৎপর হয়ে ওঠবে। তার কারণ হচ্ছে, নিষেধাজ্ঞার আওতায় যারা পড়বে, এক দিকে তারা যেমন যুক্তরাষ্ট ভ্রমনের সুযোগ পাবেন না ঠিক তেমনি যাদের বাড়িঘর সেখানে কিনেছেন তাদের বাড়ি বাজেয়াপ্ত করা হতে পারে এমন কি পরিবারের যারা সেখানে বসবাস করছেন তাদেরকেও দেশ থেকে বের করে দেয়া হতে পারে অথবা তাদের নিকটাত্মীয়ে উপরও নিষেধাজ্ঞা আসতে পারে। যে সব ছাত্র সেখানে লেখাপড়া করতে গেছে তাদেরও ভিসা বাতিল করে বাংলাদেশে ফেরত পাঠিয়ে দিতে পারে, এসব দিক বিবেচনা করে তারাই সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে ক্ষমতা থেকে হঠিয়ে দেবে। অর্থাৎ সরকারের লোক দিয়েই সরকারকে ক্ষমতা থেকে হঠাবার পাঁয়তারা!
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, তাদের মতে, বাইডেন প্রশাসনের চিন্তাধারা হতে পারে ’হিতে বিপরীত’। কেননা তাদের দেয়া নিষেধাজ্ঞা যে সব ব্যক্তির উপর দেয়া হয়েছে তারা যদি মনে করে, সরকার থেকে তারা যেসব সুযোগ সুবিধা পাচ্ছেন, সে সব সুবিধাকে কাজে লাগাতে হলে এই সরকারকেই তাদের ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে হবে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার গত ১৪ বছরে দেশের যে উন্নয়ন করেছে, তা দেখে বিশ্ব নেতৃবৃন্দের কাছে শেখ হাসিনা একজন রোল মডেল হিসেবে আখ্যায়িত হয়েছেন। আর এজন্য সারা বিশ্ব নেতৃবৃন্দের চোখ এখন বাংলাদেশের দিকে। সুতরাং বাংলাদেশে উন্নয়নের এই অগ্রযাত্রাকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে হলে শেখ হাসিনার বিকল্প নেই। তখন তারা ভিসানীতির ভয়কে উপেক্ষা করে দেশের জনগণের কল্যানেই আওয়ামী লীগ সরকারকে সহযোগিতা দান করে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার উৎসাহ প্রদান করবে।
বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে অনেকেই শংকার মধ্যে আছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিয়ে। অনেকেই মনে করছেন, ক্ষমতালোভী নরপিশাচের দল যে ভাবে ক্ষমতা দখলের জন্য তাদের মিত্রদের সাহায্য নিয়ে ওৎ পেতে বসে আছে কি ভাবে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতা থেকে সরানো যায় সে উদ্দেশ্য নিয়ে। যদি তারা এ ব্যাপারে ব্যর্থ হয় তাহলে ’৭৫ সালের মতো একটি ঘটনা ঘটাতেও তারা দ্বিধাবোধ করবে না।
সামনে নির্বাচন। এই নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী দেশের বিভিন্ন জয়গায় সমাবেশ করে জনগণের কাছে যাবেন তাদের দোয়া নিতে, দেশের উন্নয়নে তাঁর নিরলস পরিশ্রমের কথা জানাবেন, দেশকে কিভাবে দারিদ্রমুক্ত, শিল্পোন্নত করে জনগণের জন্য কাজের ব্যবস্থা করছেন, কিভাবে ২০২৪ সালের ভিষণ বাস্তবায়ন করবেন তা তুলে ধরার জন্য। সুতরাং এ সময় জনসভাগুলোতে কড়া নিরাপত্তার ব্যবস্থা রাখতে হবে। আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতৃবৃন্দ সহ আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সর্বদা সজাগ থাকতে হবে যাতে কোনো অনাকাঙ্খিত ঘটনা না ঘটে। প্রধানমন্ত্রীকে কড়া নিরাপত্তা দিয়ে রাখতে হবে।
প্রধানমন্ত্রীকে মনে রাখতে হবে, যাদেরকে বেশি বিশ্বাস করা যায় এদের মধ্যেই একজন বিশ্বাস ঘাতকতা করে। এ শিক্ষা আমরা পেয়েছি বঙ্গবন্ধু হত্যকারীর কাছ থেকে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিশ্বস্ত মানুষ ছিলো খন্দকার মুশতাক। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগষ্ট যে রাতে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়, তার আগের রাত এই মীরজাফর মুশতাক বঙ্গবন্ধুর বাসায় যায়, বঙ্গবন্ধুর সাথে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলাপ আলোচনা করে, রাতে খাওয়া দাওয়া করে এবং পরের রাতে সেই মুশতাকের নেতৃত্বেই বঙ্গবন্ধু স্বপরিবারে নিহত হন। সুতরাং নির্বাচন অনুষ্ঠান শেষ হওয়া পর্য্যন্ত তাঁকে খুব সাবধানে চলাফেরা করতে হবে।
স্বার্থান্বেষী কুচক্রী মহলের হাত থেকে আল্লাহ পাক শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্ব রক্ষা এবং দেশকে উন্নত, সমৃদ্ধশালী ও শক্তিশালী দেশ হিসেবে গড়ে তোলার তৌফিক দান করুন ইহাই দেশবাসীর প্রত্যাশা।
লেখকঃ দেওয়ান ফয়সল, কলামিষ্ট, সিনিয়র সাংবাদিক ও সদস্য লন্ডন বাংলা প্রেসক্লাব