রাজধানীর গ্রিন রোডের সেন্ট্রাল হাসপাতালে ভুল চিকিৎসায় মারা গেছেন মাহবুবা রহমান আঁখি ও তার সন্তান। মৃত্যুর আগে আট দিন ল্যাবএইড হাসপাতালের করোনারি কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ) চিকিৎসাধীন ছিলেন আঁখি। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের তিনি মারা গেছেন বলে জানিয়েছে হাসপাতালটি।
আঁখির মৃত্যুপরবর্তী প্রেস ব্রিফিংয়ে আজ রোববার বিকেলে এ তথ্য জানান ল্যাবএইড হাসপাতালের জনসংযোগ কর্মকর্তা চৌধুরী মেহের-এ-খোদা দ্বীপ। তবে কী কারণে এবং কোন জায়গা থেকে রক্তক্ষরণ হচ্ছিল, তা স্পষ্ট করেননি তিনি।
আঁখির চিকিৎসায় ল্যাবএইডে ৬ সদস্যের মেডিকেল বোর্ড গঠনের কথা জানানো হলেও ব্রিফিংয়ে কাউকেই রাখা হয়নি।
লিখিত বক্তব্যে চৌধুরী মেহের-এ-খোদা দ্বীপ বলেন, ল্যাবএইড হাসপাতালের সিসিইউতে রোগীকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের তত্ত্বাবধানে লাইফ সাপোর্টে চিকিৎসাসেবা প্রদান করা হচ্ছিল। রোগীর অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় গত ১২ জুন ছয় সদস্য বিশিষ্ট একটি মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়। সে অনুযায়ী চিকিৎসা প্রদান অব্যাহত ছিল। রোগীর ইউরিন আউটপুট বন্ধ থাকায় ডায়ালাইসিস প্রদান করা হচ্ছিল। সকাল প্রকার প্রচেষ্টার পরও রোগীর কোনো প্রকার উন্নতি পরিলক্ষিত হয়নি। আজ দুপুর ১টা ৪৩ মিনিটে আঁখি মারা যান।’
আঁখির মরদেহ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে নেওয়া হচ্ছে। সেখানে পোস্ট ময়নাতদন্ত করা হবে বলে জানিয়েছেন আঁখির বড় চাচা শফিকুর রহমান মজুমদার।
তিনি বলেন, ‘আমরা বাড়িতে নিতে চাচ্ছিলাম। কিন্তু প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, যেহেতু আইনি ব্যাপার রয়েছে তাই ময়নাতদন্ত করতে হবে। সেখান থেকে লাশ বুঝে পেলে বাড়িতে নেওয়া হবে।
এর আগে নবজাতক ও মায়ের মৃত্যুর ঘটনায় সেন্ট্রাল হাসপাতালের লাইসেন্স বাতিল এবং অস্ত্রোপচারে জড়িত চিকিৎসকদের নিবন্ধন বাতিলের দাবি জানান আঁখির সহপাঠীরা। বিকেল পৌনে ৪টার দিকে ল্যাবএইড হাসপাতালের সামনে গণমাধ্যমের সঙ্গে আলাপকালে তারা এ দাবি জানান।
এ সময় তারা বলেন, সেন্ট্রাল হসপিটালে ভুল চিকিৎসা ও ডা. সংযুক্তা সাহার প্রতারণার শিকার হয়েছে আমাদের সহপাঠী। কেমন চিকিৎসা দিলে অস্ত্রোপচার করতে গিয়ে মূত্রনালি ও মলদার কেটে ফেলার পাশাপাশি লিভার ক্ষতিগ্রস্ত করে। আমরা ২৪ ঘণ্টার মধ্যে হাসপাতালের লাইসেন্স বাতিলের দাবি করছি। একই সঙ্গে চিকিৎসক সংযুক্তা সাহার গ্রেপ্তার ও তার চিকিৎসা নিবন্ধন বাতিল করতে হবে।’
আঁখির সহপাঠী ইডেন কলেজের ছাত্রী মুনিরা আনজুম বলেন, সেন্ট্রাল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ থেকে লোক পাঠিয়ে হুমকি দেওয়া হচ্ছে। কত বাড় সাহস তাদের, তারা এমন স্পর্ধা দেখাচ্ছে। তারা বলে, কিছুদিন পর সবাই ভুলে যাবে, তোমাদের কত টাকা হয়েছে। কিছুদিন পর সব ঠিক হয়ে গেলে তোমাকে দেখে নেবে। এভাবে আমাদের শিশুকে ও বোনকে হত্যা করার পর হুমকি দিচ্ছে। আমরা সেন্ট্রাল হাসপাতালের কাছে যাব আমাদেরও মেরে ফেলুক।
তিনি আরও বলেন, আজকে আমার সহপাঠী আঁখি মারা গেলো, তখন সবাই তাকে দেখতে আসছে, তার খোঁজ নিচ্ছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত সেন্ট্রাল হাসপাতালের পক্ষ থেকে কেউ আসেনি, খবরও নেয়নি। এমনকি যার আশ্বাসে আঁখি ঢাকায় এসেছিল, সেই ডাক্তার সংযুক্তা সাহাও এক দিন রোগীকে দেখতে আসেনি। আমরা মনে করি, সেন্ট্রাল হাসপাতাল বা ডা. সংযুক্তা কেউই এই হত্যাকাণ্ডের দায় এড়াতে পারে না।
আরেক সহপাঠী নাজমুর হাসান বলেন, আমাদের সহপাঠীর নরমাল ডেলিভারি করানোর কথা ছিল। পরে কোনো ধরনের অনুমতি ছাড়াই সিজার করা হয়। কিন্তু কত বড় কসাই হলে অপারেশন করতে গিয়ে রোগীর মলদার, মূত্রনালি কেটে ফেলে। লিভার ও কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত করে। গত কয়েকদিনে আঁখিকে ৩৩ ব্যাগ রক্ত দিতে হয়েছে। আমরা মনে করি, আঁখি ডা. সংযুক্তা সাহার প্রতারণার শিকার হয়ে সেন্ট্রাল হাসপাতালের ভুল চিকিৎসার শিকার হয়েছে।
এর আগে সেন্ট্রাল হাসপাতালের গাইনি ও প্রসূতি বিভাগের চিকিৎসক সংযুক্তা সাহার ফেসবুকে নরমাল ডেলিভারির তথ্য পেয়ে গত ৯ জুন আঁখিকে কুমিল্লা থেকে সেন্ট্রালে আনা হয়। কিন্তু তার অধীনে ভর্তি করা হলেও অস্ত্রোপচারের সময় তিনি সেখানে ছিলেন না। হাসপাতালের অন্য চিকিৎসকের কারণে ভুল চিকিৎসার শিকার হন তিনি। এতে করে জন্মের এক দিন পরই নবজাতকের মৃত্যু হয়। পরে সংকটাপন্ন অবস্থায় ল্যাবএইড হাসপাতালের সিসিইউতে ভর্তি করা হয় আঁখিকে। সেখানেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় আজ মারা যান তিনি।
এর আগে অভিযুক্ত সেন্ট্রাল হাসপাতালের দুই চিকিৎসককে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে তাদেরকে আদালতে তোলা হলে দোষ স্বীকার করে জবানবন্দি দেন তারা।
রোগীকে ভুল চিকিৎসা দেওয়ার পর গত শুক্রবার সেন্ট্রাল হাসপাতালে অভিযান চালায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। অভিযানে হাসপাতালটির চিকিৎসা ব্যবস্থাপনায় বেশ কিছু ঘাটতি দেখতে পান অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। জরুরি চিকিৎসায় পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না থাকায় আইসিইউসহ প্রতিষ্ঠানটিতে সব ধরনের অস্ত্রোপচার বন্ধের নির্দেশ দেওয়া হয়। পাশাপাশি ডা. সংযুক্তা সাহাকে ওই প্রতিষ্ঠানে বিশেষজ্ঞ সেবা দেওয়ায় নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়।
নিউজ /এমএসএম