দেশের বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিয়োগে অনিয়মের অভিযোগ আসছে। সাধারণত এক শ্রেণির উপাচার্য ও প্রভাবশালীরা এসব অনিয়মের পেছনে থাকেন।
এক সময়ে রাজনৈতিক কিংবা এলাকাসহ অন্যান্য প্রভাবে আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে নিয়োগ, কেনাকাটা, নির্মাণসহ বিভিন্ন কাজের নামে অপকর্মে জড়ানোর অভিযোগই বেশি আসছিল। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে উপাচার্যরা তাদের স্ত্রী, সন্তান ও নিকটাত্মীয় নিয়োগ কিংবা বেনামে থাকা নিজের প্রতিষ্ঠানের নামে কেনাকাটা করতে গিয়ে বিতর্কে জড়িয়ে পড়ছেন। তবে এ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘অ্যাপেক্স বডি’ খ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) মাথাব্যথা কম। তাদের অনিয়ম ও দুর্নীতি তদন্তে আগ্রহ খুব একটা দেখা যায় না।
ফলে একদিকে এই সংস্থাটি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কাছে গুরুত্ব হারাচ্ছে। অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও সুশাসনের ঘাটতি তৈরি হচ্ছে।
দুর্নীতিগ্রস্ত উপাচার্যদের কারণে বাকিরাও দারুণ বিব্রতকর অবস্থায় আছেন। যে কারণে গত বছরের ৩ সেপ্টেম্বর বুয়েটে শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে খোদ উপাচার্যরাই দুর্নীতিবাজদের বিচার দাবি করেন। সেদিন পর্যন্ত অর্ধশতাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে অন্তত ১৪টির তদন্ত প্রতিবেদন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে জমা পড়ে। কিন্তু তাদের মধ্যে দু-একজনকে পদত্যাগ করতে বলা বা অপসারণ, একজনকে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মামলায় কারাগারে যাওয়া, আরেকজনের নামে মামলা দায়েরের ঘটনা ছাড়া বাকিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার নজির নেই।
অন্যদিকে সর্বশেষ গত একবছরে ইউজিসির তদন্তেও ভাটা দেখা যায়। গত ৪ মাস ধরে ইউজিসিতে ঘুরে কতটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে- সেই তথ্য পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ইউজিসির পরিচালক (পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়) জামিনুর রহমান বলেন, বহুদিন ধরে তারা কোনো তদন্ত কাজ করছেন না। বর্তমানে কটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে বা কোন ধরনের অভিযোগ তাও তিনি বলতে পারছেন না। তবে একটা তালিকা করার কাজ চলছে। সেটি চূড়ান্ত হলে তিনি বলতে পারবেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ইউজিসির কয়েকজন কর্মকর্তা কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগ কমিটির সঙ্গে সম্পৃক্ত। যে কারণে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগ সংক্রান্ত বিষয়ে আপত্তি বা অভিযোগ উঠলে তা ইউজিসির পক্ষে থাকা ওইসব সদস্যও অভিযোগের বাইরে থাকেন না। যে তদন্তকারী সংস্থার তদন্ত নিয়ে অনীহা দেখা যাচ্ছে। এ ছাড়া কয়েকজন আছেন নানানভাবে দুর্নীতিবাজ উপাচার্যদের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে গেছেন। কেউ কেউ সুবিধাও নিয়ে থাকেন বলে অভিযোগ আছে।
ফলে তদন্তের পরিবর্তে উপেক্ষা নীতি দেখা যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে ইউজিসি সবচেয়ে বেশি দুর্বল ভূমিকায় চলে গেছে সংস্থাটির চেয়ারম্যানের অসুস্থতার ফলে। ক্যানসার আক্রান্ত এই প্রবীণ অধ্যাপক দীর্ঘদিন অস্ট্রেলিয়ায় থেকে চিকিৎসা করেন। ওই অবস্থায় তার মেয়াদ শেষ হলে ফের পুনর্নিয়োগ পান।
এর আগে করোনাকালে তিনি দিনের পর দিন ‘হোম অফিস’ করেন। ক্যানসার চিকিৎসা শেষে দেশে ফেরার পর অপরাহ্নে কয়েক ঘণ্টার জন্য অফিস করেন। আর এই সুযোগ সংস্থাটিতে থাকা দুর্নীতিবাজ ও সুবিধাবাদীরা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছেন বলেও অভিযোগ আছে।
এর প্রমাণ হিসেবে ইউজিসির এক কর্মকর্তা জানান, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) উপাচার্যের বিরুদ্ধে স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে ছেলে, ছেলের স্ত্রীসহ ১১ জন নিকটাত্মীয় নিয়োগের অভিযোগ আছে। এছাড়া পরীক্ষা, কেনাকাটাসহ আরও কিছু বিষয়েও অভিযোগ উঠেছে। এ বিষয়ে লিখিত অভিযোগ জমা পড়ার পরও ইউজিসি কোনো তদন্ত কমিটি করেনি। আবার একই প্রতিষ্ঠানের কোষাধ্যক্ষের বিরুদ্ধে আরেক লিখিত অভিযোগ পড়ার সঙ্গে সঙ্গে তদন্ত কমিটি গঠনের ঘটনা আছে। এখানেই শেষ নয়, ওই তদন্ত কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে প্রচলিত রীতি লঙ্ঘনের অভিযোগ আছে। বিশেষ করে ইতোমধ্যে অনিয়মের দায়ে অভিযুক্ত এবং কোষাধ্যক্ষের পদের চেয়ে জুনিয়র কর্মকর্তাকে কমিটির সদস্য রাখা হয়েছে। এ নিয়ে খোদ ইউজিসিতেই সমালোচনা আছে।
সাম্প্রতিক সময়ে আরেক আলোচিত ঘটনা হচ্ছে গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বশেমুরবিপ্রবি) ভিসি এবং বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির দুই কন্যা নিয়োগ। এক বছরের ব্যবধানে এই দুই বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক পদে নিয়োগ পান তাদের দুই কন্যা। একজন আরেকজনের কন্যা নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ দেন। এ ঘটনা জানাজানির পর চলছে ব্যাপক সমালোচনা। গণমাধ্যমে এ নিয়ে প্রতিবেদনও প্রকাশিত হয়। কিন্তু এ নিয়েও ইউজিসির মাথা ব্যথা নেই। অথচ গোপন কোনো সমঝোতায় নিয়োগটি হলো কিনা- সেটি খতিয়ে দেখা দরকার বলে মনে করেন অন্য নিয়োগ প্রত্যাশীরা।
এ প্রসঙ্গে ইউজিসির এক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, সরকার বর্তমানে জেলায় জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করছে। নতুন প্রতিষ্ঠান মানেই নিয়োগ। আর নিয়োগের জন্য স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাসহ প্রভাবশালীরা চাপ তৈরি করেন। ফলে অনেক সময়ে নিয়মের ব্যত্যয় ঘটে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, প্রভাবশালীদের কাজ করতে গিয়ে নিজেরও দু-চারটা বাগিয়ে নেন অসৎ উপাচার্যরা। স্বজনপ্রীতির বাইরে অর্থ লেনদেন বা অন্যভাবে খুশি হওয়ার ওপরও নিয়োগ নির্ভর করে বলে সাম্প্রতিককালে অভিযোগ উঠছে। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ ঘিরে অর্থ লেনদেনের অডিও ফাঁসসহ নানান অভিযোগ তো প্রায়ই উঠছে। কুমিল্লার সাবেক এক উপাচার্যের বিরুদ্ধে এক নারী প্রভাষক প্রার্থী স্পর্শকাতর অভিযোগ করেন। গোপালগঞ্জ, খুলনাসহ আরও কয়েকটির সাবেক উপাচার্যদের বিরুদ্ধে নারী কর্মচারী ও ছাত্রীরাও অভিযোগ করেছেন।
ওই কর্মকর্তা জানান, বাংলাদেশ ডিজিটাল বিশ্ববিদ্যালয়ে সাবেক এক উপাচার্যের বিরুদ্ধে বেনামে নিজের বা বন্ধুর প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন কেনাকাটার কাজ দেওয়ার অভিযোগ আছে। খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে (খুকৃবি) উপাচার্য কর্তৃক নিজের ছেলে, মেয়ে, শ্যালক-শ্যালিকার ছেলে, ভাতিজাসহ নিজ পরিবারের ৯ জনের নিয়োগের অভিযোগ করেন সেখানকার এক সিন্ডিকেট সদস্য। পরে শিক্ষা মন্ত্রণালয় মোট ৭৩ জনের নিয়োগ বাতিলের নির্দেশনা দিয়েছে। ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের সব নিয়োগই অবৈধ বলে সম্প্র্রতি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে তদন্ত প্রতিবেদন পাঠিয়েছে ইউজিসি। রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের শীর্ষস্থানীয় কয়েক কর্মকর্তা আত্মীয়স্বজনসহ অসংখ্য নিয়োগের কুশীলব। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের এক অধ্যাপকের বেআইনি নিয়োগ বহুল আলোচিত। সিলেট মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা কার্যক্রম পুরোপুরি চালুর আগেই অনুমোদিত পদের বাইরে অতিরিক্ত ১০৯ জনকে নিয়োগের অভিযোগ তদন্ত হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, দুর্নীতির মাধ্যমে কেউ এবার নিয়োগ পেলে তা আর বাতিল করা যায় না। কেননা, এমন উদ্যোগ নিলে সংশ্লিষ্টরা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়সহ আরও কয়েকটিতে এমন দৃষ্টান্ত আছে। অন্যদিকে অনিয়ম-দুর্নীতির জন্য সর্বোচ্চ শাস্তি অপসারণের মধ্যে সীমিত হয়ে গেছে। বিগত এক দশকে রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এক উপাচার্যকে দুদকের মামলায় কারাগারে যেতে হয়েছে। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় এবং গোপালগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে অপসারণ করা হয়েছে। এ ছাড়া উপাচার্যদের মেয়াদপূর্তি করতে দেওয়ার ঘটনা আছে। শাস্তি বলতে দ্বিতীয়বার আর নিয়োগ দেওয়া হয় না।
জানতে চাইলে ইউজিসির সচিব ড. ফেরদৌস জামান বলেন, উপাচার্য বা অন্যদের বিরুদ্ধে সম্প্রতি ইউজিসির তদন্তে অনীহার অভিযোগ সঠিক নয়। সাধারণত প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয় বা দুদক থেকে চিঠি পেলেই শুধু তদন্তের উদ্যোগ নেন তারা। অভিযোগ পেলেও বা পত্রিকায় অভিযোগ উঠলেও নানান কারণে নিজের স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে তদন্ত করেন না। কিন্তু সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনায় তদন্ত শেষে সম্প্রতি পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছে। এর আগে বিভিন্ন সময়ে আরও অন্তত ৮-৯টি প্রতিবেদন গেছে।
এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, অভিযোগের বেশির ভাগই নিয়োগ, পদোন্নতি ও আর্থিক বিষয়সংক্রান্ত। ইউজিসির কোনো কর্মকর্তা কোথাও সদস্য থাকলে নিয়োগে শতভাগ স্বচ্ছতা নিশ্চিত করে থাকে।
নিউজ /এমএসএম