

পূর্ব লন্ডনের কংক্রিটের বুকে বোনা এই গল্প যেন এক জীবন্ত আর্তনাদ—শ্যাডওয়েলের সরু গলি, পপলারের হাইরাইজ টাওয়ার, ওয়াপিংয়ের ধূসর নদীকূলে কিংবা বেথনাল গ্রীনের রোমান রোডের প্রাচীন বিল্ডিং—প্রতিটি কোণ থেকে উঠে এসেছে নাট্যকার সাঈম চৌধুরীর লেখা নাটক ‘গ্রোয়িং এল্ডার ইন দ্য ইস্ট এন্ড’-এর চরিত্ররা। নাটকটি মঞ্চশৈলীর কলাকুশলীদের অনবদ্য পারফরম্যান্সে উপভোগ্য হয়েছিলো।
রবিবার রিচমিক্সের মঞ্চে যখন পর্দা উঠল, মনে হলো—লন্ডনের এই প্রান্তে বয়স, একাকিত্ব আর স্মৃতির ভারে নুয়ে পড়া মানুষদের জীবনের দর্পণ যেন মঞ্চে প্রতিফলিত হচ্ছে। একটি ডে কেয়ার সেন্টারের প্রতিদিনের ঘটনাপ্রবাহ—যেখানে আছে দীর্ঘশ্বাসের প্রতিধ্বনি, হাসির ক্ষণিক ঝলক, আর বেঁচে থাকার অব্যক্ত বেদনা।
স্ট্রোকে পা হারিয়ে ফেলা জাহানারা বেগমের সাততলার জানালা থেকে নিঃসঙ্গ আকাশের দিকে চেয়ে থাকা; মূত্রনালীর সমস্যায় আক্রান্ত জলিল মিয়ার মধ্যরাতে নিচতলার টয়লেটে নামার যুদ্ধ; ওভারক্রাউডেড হাউজে শ্বাসরুদ্ধ জীবনযাপন করা সিরাজ মিয়া;
আর ছয়-সাতটি বাড়ির মালিক দাবি করা একা, নিঃসঙ্গ, পরিত্যক্ত জসিম উদ্দিন—এই চরিত্রগুলো শুধু নাটকের নয়, পূর্ব লন্ডনের প্রতিটি বাঙালি প্রবাসীর জীবনের ছায়া যেন।
নাট্যকার সাঈম চৌধুরী সমাজের কঠিন বাস্তবতাকে মঞ্চে এমনভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন, যেন লন্ডনের প্রতিটি ইট, প্রতিটি বাতাস সাক্ষী দেয় নিঃসঙ্গতার এই নগরীর গল্পে।
নাটকের এক পর্যায়ে, বৃদ্ধ জসিম উদ্দিন যখন জানতে পারেন যে তাঁর পুত্রবধূর চাপে তিনি বৃদ্ধাশ্রমে যাবেন—তখন মঞ্চ নিস্তব্ধ।
সেই মুহূর্তে, এক পিতার অসহায়তা আর সমাজের নিস্পৃহতার মিশেলে এমন দৃশ্য তৈরি হয়, যা হৃদয়ে ছুরির মতো বিঁধে যায়।
যে মানুষটি জীবনের বড় অংশ কেটেছেন মর্টগেজের কিস্তি দিতে দিতে, যে দিন বাড়ি অবশেষে ফ্রি-হোল্ড হলো, ঠিক সেই দিনেই তাঁকে নিজের ঘর ছেড়ে কেয়ার হোমে যেতে হলো—এই দৃশ্য শুধু চোখ ভিজিয়ে দেয়নি, ভাবতে বাধ্য করেছে তিন শতাধিক দর্শককে—
আমরা ঠিক কতটা মানবিক আছি?
পাঁচজন বৃদ্ধ চরিত্রে যেন ফুটে উঠেছে পূর্ব লন্ডনের নীরব কান্না।
তাদের মুখ দিয়ে উচ্চারিত হয় জীবনের এক নির্মম অথচ সহজ সত্য—“নিজের একটা ঘর হবে… গল্প করার মানুষ হবে…”
একটি নিজের ঘর, একটু গল্প করার মানুষ—এই দুটি আকাঙ্ক্ষাই আজ পূর্ব লন্ডনের শত শত পেনশনার মানুষের জীবনের সংক্ষিপ্ত সংজ্ঞা।
জীবনের শেষ প্রান্তে এসে যখন বন্ধুরা একে একে চলে গেছে,
সন্তানরা ব্যস্ত নিজের পৃথিবীতে,
তখন এই মানুষগুলোর সবচেয়ে বড় চিন্তা শুধু নিঃসঙ্গতা নয়—
শেষকৃত্যের টাকাও যেন এক ভয়াবহ বাস্তবতা।
নাটকে শেষ দৃশ্যে জসিম উদ্দিন যেভাবে অন্য ৩ বৃদ্ধকে নিয়ে লাপাত্তা হয়ে যান, দিয়ে যান একটি ক্লু! হোয়াইটচ্যাপেল থেকে ১০ স্টপ দূরে, নেমে ১০ মিনিট হাঁটা! তখন মনে হয় নাটক শেষ হবে ‘গার্ডেন অব পিসে’! তবে নাটক শেষ হয় বাকিংহাম প্যালেসে, প্রচন্ড শক্তিশালী একটি বার্তা দিয়ে। এই সমাজে আমরা সবাই রাজা! রাজা কখনো পরাজিত হয়, রাজা কখনো জয়ী হয়!
তাদের মুখে ফুটে ওঠা এই অদৃশ্য বেদনা আমাদের সমাজের প্রতি এক নীরব প্রশ্ন,পরিবার কি তবে শুধুই তরুণ প্রজন্মের জন্য?
যাদের হাত ধরে প্রবাসে টিকে থাকার ইতিহাস লেখা হয়েছে,
তাদের জন্য একটু ভালোবাসা, একটু যত্ন—
এই দায় কি আমাদের নয়?
লেখকঃ আ স ম মাসুম সাবেক ট্রেজারার, লন্ডন বাংলা প্রেস ক্লাব