ঘনিয়ে আসছে মাহেন্দ্রক্ষণ। আগামী ২০ নভেম্বর মধ্যপ্রাচ্যের দেশ কাতারে শুরু হতে যাচ্ছে বিশ্বকাপ ফুটবল-২০২২। এই বিশাল আয়োজনে ব্যাপকভাবে প্রস্তুতি নিয়েছে দেশটি। কাতার বিশ্বকাপ চলাকালে নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত থাকবে ৫০ হাজারের বেশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য। তাদের মধ্যে বিদেশিরাও থাকছেন নিরাপত্তার দায়িত্বে।
এদিকে বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম এই ক্রীড়া প্রতিযোগিতা দেখতে উপসাগরীয় দেশটিতে ছুটে যাচ্ছেন লাখ লাখ ফুটবলপ্রেমী। তবে কাতারের এই আয়োজন কেবল পৃথিবীর সেরা ৩২টি ফুটবল দলের লড়াইয়েই সীমাবদ্ধ নয়; বিশ্বের বিখ্যাত অনেক বিনোদনতারকার মনোজ্ঞ পারফরম্যান্সও সেখানে দেখতে পারবেন দর্শকেরা।
সম্প্রতি কাতারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, বিশ্বকাপ ফুটবলের নিরাপত্তা নিশ্চিতে ৫০ হাজারের বেশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। কাতারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর আওতায় সহায়তা করবে বিদেশি বাহিনীর সদস্যরাও। তবে কাতারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র জাবর হামুদ জাবর আল নুয়াইমি কোন কোন দেশের বাহিনীর সদস্য নিরাপত্তার কাজে অংশ নেবেন তা খোলাসা করেননি। তিনি বলেন, কাতারের নেতৃত্বে বন্ধুসুলভ দেশগুলোর বাহিনীর সদস্যরা এ কাজে অংশ নেবেন। বিশেষ করে যাদের বিশেষ দক্ষতা রয়েছে। তুরস্ক ৩ হাজার দাঙ্গা পুলিশ প্রদান করছে এবং দেশটির কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, তুর্কি কমান্ডের অধীনে কাজ করবে এসব পুলিশ সদস্য।
আল-জাজিরার খবরে বলা হয়েছে, তুরস্ক অপারেশনে নিয়োজিত আরও ১০০ বিশেষ পুলিশ কর্মকর্তা, ৫০ জন বোমা বিশেষজ্ঞ ও ৮০টি স্নিফার কুকুর পাঠাবে এমন ঘোষণা দিয়েছিল। গত আগস্টে পাকিস্তানও ফুটবল বিশ্বকাপ চলাকালে নিরাপত্তা নিশ্চিতে কাতারে সেনা পাঠাতে রাজি হয়। একই মাসে ফরাসি পার্লামেন্ট উপসাগরীয় রাষ্ট্রটিতে প্রায় ২২০ জন নিরাপত্তাকর্মী মোতায়েনের অনুমোদন দেয়। পরে ফরাসি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিষয়টি নিশ্চিত করে।
কাতার মরক্কোর সঙ্গেও একটি নিরাপত্তাবিষয়ক সহযোগিতা চুক্তি করেছে। মরক্কোর সংবাদ আউটলেটগুলো এর আগে জানিয়েছিল, কাতারে সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের মোতায়েন করবে দেশটি। ৩০ লাখ লোকের দেশ কাতার। এর মধ্যে ১২ শতাংশ হলো দেশটির নাগরিক। ফলে মাসব্যাপী বিশ্বকাপ ফুটবলের জন্য প্রস্তুতি নেওয়ার সময় জনবলের ঘাটতি দেখা দেয়। সে কারণে পুরো নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে শুরু করে এবারের বিশ্বকাপ আয়োজক দেশটি। এদিকে, ফিফা বিশ্বকাপের জন্য যারা টিকিট কিনতে পারেননি তাদের টুর্নামেন্টের গ্রুপ পর্বের পর কাতারে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হবে।
সম্প্রতি দোহায় একটি অনুষ্ঠানে কাতারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র জাবর হামুদ জাবর আল নুয়াইমি বলেন, টিকিটবিহীন দর্শকরা ফিফা বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্বের পর কাতারে প্রবেশ করতে পারবেন। চলতি বছরের ২ ডিসেম্বর থেকে কাতারে ঢুকতে পারবেন তারা। কাতারে প্রবেশ করতে হলে মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে তাদের হায়া কার্ডের জন্য আবেদন করতে হবে। এদিকে ধারণা করা হচ্ছে, সরাসরি স্টেডিয়ামে ও টেলিভিশন সেটের সামনে বসে এবারের বিশ্বকাপ ফুটবল দেখবেন অন্তত ৫০০ কোটি মানুষ। অর্থাৎ, পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার অর্ধেকেরও বেশি মানুষের কাছে পৌঁছে যাবে কাতারের নাম। তাই বিশ্বকাপের আয়োজনকে বর্ণাঢ্য করে তুলতে চেষ্টার কোনো কমতি রাখেনি মধ্যপ্রাচ্যের দেশটি।
কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরার খবর অনুসারে, ১২ বছর আগে ২০২২ ফুটবল বিশ্বকাপের আয়োজক হিসেবে কাতারের নাম ঘোষণা হওয়ার পরপরই বিশাল প্রস্তুতি শুরু করে দেশটি। এরপর থেকে সেখানে কয়েক ডজন হোটেল, অবকাশযাপন কেন্দ্র তৈরি হয়েছে। গড়ে উঠেছে বিনোদনের নতুন নতুন ভেন্যু, সৈকত, রিসোর্ট, জাদুঘর, রেস্টুরেন্ট প্রভৃতি। আর এসবই করা হয়েছে কেবল বিশ্বকাপ প্যাকেজের অংশ হিসেবে। পর্যটকদের জন্য কাতারে এখনই অন্তত তিনটি সংগীত উৎসব চলছে। সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত ব্যান্ড ব্ল্যাক আইড পিস, ডাচ ডিজে আরমি ভ্যান ব্যুরেনের পারফরম্যান্স দেখার সুযোগ পাবেন ভক্তরা। গত শুক্রবার দোহা গলফ ক্লাবে পারফর্ম করেছেন স্প্যানিশ সংগীততারকা এনরিক ইগলেসিয়াস। ওই একই ভেন্যুতে ব্লাক আইড পিসকেও দেখা যাবে বলে আশা করা হচ্ছে।
কাতারের এই বিশাল সাংস্কৃতিক আয়োজনের কেন্দ্রে রয়েছে আর্কেডিয়া ফেস্টিভ্যাল। এতে ১০০ জনের বেশি আন্তর্জাতিক শিল্পী পারফর্ম করবেন বলে আশা করা হচ্ছে। চলবে ১৯ নভেম্বর থেকে ১৯ ডিসেম্বর, অর্থাৎ ফাইনাল ম্যাচের পরের দিন পর্যন্ত। এই ফেস্টিভ্যাল উপলক্ষে থাকছে তিনটি সুদৃশ্য মঞ্চ। এর মধ্যে একটি সাজানো হয়েছে সুবিশাল মাকড়সার আকারে, যাতে রয়েছে দৃষ্টিনন্দন লেজারের ব্যবহারও। এছাড়া, বিখ্যাত দোহা গলফ ক্লাবে অনুষ্ঠিত হচ্ছে ডেড্রিম ফেস্টিভ্যাল। সেখানে ডাচ ডিজে তিয়েস্তো, সুইডিশ ডিজে অ্যালেসো, জার্মান ডিজে এটিবি এবং পল ভ্যান ডাইকের ইলেক্ট্রনিক পারফরম্যান্স দেখা যাবে। কাতারের আইকনিক ইসলামিক আর্ট জাদুঘর আবারও খুলে দেওয়া হয়েছে গত মাসে। দর্শনার্থীদের জন্য ২০২২ সালে চালু হওয়া একঝাঁক নতুন স্থাপনার মধ্যে রয়েছে ৩-২-১ কাতার অলিম্পিক ও ক্রীড়া জাদুঘরও।
ফিফা বিশ্বকাপ-২০২২ দেখতে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ১২ লাখের বেশি মানুষ কাতার যাবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। এরই মধ্যে প্রায় ২৯ লাখ টিকিট বিক্রি হয়ে গেছে। এসব ভ্রমণকারীর রাতযাপনের জন্য অত্যাধুনিক সুবিধাযুক্ত অ্যাপার্টমেন্ট, হোটেল রুম, মরুভূমি ক্যাম্প, ভিলা, ফ্যান ভিলেজ, এমনকি নোঙ্গর করা ক্রুজ শিপে কেবিনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। অনেকেই সংযুক্ত আরব আমিরাত, ওমান বা ইরানের মতো প্রতিবেশী দেশগুলোকে থাকার বিকল্প জায়গা হিসেবে বেছে নেবেন। তারা কাতারে ফুটবল ম্যাচ দেখেই যেন ফিরে যেতে পারেন, সেজন্য ‘শাটল’ ফ্লাইটের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
কাতার বিশ্বকাপের আয়োজকরা বলেছেন, বিশ্বকাপ চলাকালে বিশাল পরিসরে সাংস্কৃতিক আয়োজন ও বিনোদনের ব্যবস্থা থাকবে। ফুটবল ম্যাচের পাশাপাশি দেশব্যাপী উৎসবে ৯০টিরও বেশি বিশেষ ইভেন্ট অনুষ্ঠিত হবে। প্রধান ইভেন্টগুলোর মধ্যে থাকবে জায়ান্ট স্ক্রিনে ম্যাচ দেখার ব্যবস্থা, সঙ্গীত উৎসব, সাংস্কৃতিক প্রদর্শনী ও স্ট্রিট পারফরম্যান্স। বিশ্বকাপ উপলক্ষে চলতি মাসের শুরু থেকে রাজধানী দোহার বিখ্যাত কর্নিশকে (সমুদ্রের তীরবর্তী রাস্তা) কেবল হেঁটে চলাচলকারীদের জন্য উন্মুক্ত ঘোষণা করা হয়েছে। প্রায় ছয় কিলোমিটার দীর্ঘ এই পথজুড়ে থাকবে কার্নিভালের পরিবেশ; যেখানে ঘোরাঘুরির সুযোগ, সাংস্কৃতিক কার্যক্রম, খাদ্য ও পানীয়ের স্টল এবং খুচরা বিক্রেতাদের নানা আউটলেটের ব্যবস্থা থাকবে।
ইউকেবিডিটিভি/ বিডি / এমএসএম