বাংলা সাহিত্যের জনপ্রিয় কবি বিদ্যুৎ ভৌমিক। ইউকে বিডি টিভির সুপ্রিয় পাঠকদের জন্য কবির বিশেষ একটি সাক্ষাৎকার নীচে প্রকাশ করা হলো।
কবির সংক্ষিপ্ত পরিচিতি এই সময়কার বাংলা কাব্য সাহিত্যের অন্যতম একজন জনপ্রিয় কবি হলেন বিদ্যুৎ ভৌমিক ৷ জন্ম ১৮ ই এপ্রিল , ১৯৬৪ পশ্চিমবঙ্গের হুগলী জেলার সাংস্কৃতিক পিঠস্থান শ্রীরামপুরের ঝিলবাগান অঞ্চলের “কুসুম কুঞ্জ”- নিবাসে এক সম্ভ্রান্ত ও শিক্ষিত পরিবারে ৷ পিতা ৺পিযুষ কান্তি ভৌমিক এবং মাতা ৺ ছায়ারাণী ভৌমিক ৷ ছাত্র জীবনের হাতেখড়ি শ্রীরামপুরের পূর্ণচন্দ্র প্রাথমিক বিদ্যালয় ৷ মাত্র আট বছর বযসে সত্যজিৎ রায় সম্পাদিত সন্দেশ পত্রিকা’- য় প্রথম “রেলগাড়ী”- শীর্ষক ছড়া লেখা দিয়ে তাঁর আত্মপ্রকাশ ৷ পরবর্ত্তী সময়ে বাংলা কাব্য সাহিত্যের সব শ্রেণীর পত্র-পত্রিকা , কবিতা সংকলনে একমাত্র কবিতা ও শিশু- কিশোরদের জন্য ছড়া লিখে কবি বিদ্যুৎ ভৌমিক দু’ই বাংলার পাঠকদের মনের মণি কোঠায় পৌঁছে গেছেন ৷ তাঁর কবিতার মধ্যে নিজস্ব একটা ব্যতিক্রমী ঘরানা তিনি সৃষ্টি করেছেন ৷ তাঁর অন্যতম কাব্যগ্রন্থের মধ্যে ১ ) কথা না রাখার কথা ২) নির্বাচিত কবিতা ৩) গাছবৃষ্টি চোখের পাতা ভিজিয়েছিল ৪ ) নীল কলম ও একান্নটা চুমু ,— ৫ ) শুধু প্রিয়ংবদার জন্য আগামী ২০২৬ কলকাতা বইমেলায় অনুক্ষণ প্রকাশনী থেকে প্রকাশ হতে চলেছে । কবিতা লেখা এবং নিয়মিত সাধনচর্চা’-র জন্য পেয়েছেন কবি হিসেবে বেশ কিছু সম্মান ও পুরস্কার ৷ ১৯৯৭ “দক্ষিণ কোলকাতা ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক পরিষদ”- থেকে অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি হিসাবে স্বীকৃতি ও ব্রোঞ্চ পদক ৷ 2015 পেয়েছেন “বাংলা শ্রী” কাব্য সম্মান ৷ 2021 California TV অর্থাৎ CA TV USA এর একটি LIVE অনুষ্ঠানে কবি বিদ্যুৎ ভৌমিক তাঁর কবিতা লেখনীর শ্রেষ্ঠত্বের জন্য এবং বাচিক শিল্পী হিসাবে পেয়েছেন বিশেষ সম্মান ৷ সম্প্রতি 2022 পেয়েছেন “সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সাহিত্য সম্মান” ৷ কবিতাচর্চা পাশাপাশি তিনি একজন বাচিক জগতের অন্যতম বিশিষ্ট আবৃত্তিকার ৷ বেতার , দূরদর্শন , বেসরকারী টেলিভিশন চ্যানেল , বিভিন্ন youtube channel , মঞ্চ সহ সোসাল মিডিয়াতে কবি বিদ্যুৎ ভৌমিক”- এর স্বরচিত কবিতা আবৃত্তি পাঠক ও শ্রোতাদের মনরঞ্জন করে চলেছেন ৷
৭০’ এর মধ্যভাগ সময় থেকে শুরু হয়ে ছিল আমার কবিতা লেখার পথ ! সেই সময় মিডিয়ার দৌড়াত্ব বলতে এতটা স্ট্রং ছিলনা। হাতে গোনা কয়েকটি প্রথম শ্রেণীর ম্যাগাজিন (যেখানে গোষ্টিবাজি করে আসা এবং সম্পাদকদের চাটুকারি করে বেশ কিছু অক্ষর শ্রমিকরা ঠাই পেতেন) আমাদের মত নতুন কবিদের কবিতা প্রকাশের প্রশ্ন আসেই না বলা যায়। এছাড়া লিটল ম্যাগাজিন … সেতো কলেজ স্ট্রিট অঞ্চলের সোভা পেতো , সেগুলো তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতাম , এবং মনে মনে স্বপ্ন দেখতাম আমিও একদিন এইসব ম্যাগাজিনে লিখবো। একটা সময় যখন আমার বয়স ১৭ কি ১৮ বছর বয়স , ওই তরুণ বয়সে ভেতরে গভীর রাতদিন এক করে শুধু কবিতা চিন্তায় পাগল ছিলাম, পাড়া প্রতিবেশি থেকে নিকট আত্মীয় স্বজন প্রত্যেকেই আমার হাবভাব ভংগিতে অন্য কিছু খুঁজতো ! কেউই আমাকে স্বাভাবিক নজরে দেখতেন না ! এটা নাকি একান্তই আমার কবিতা লেখার জন্যই । ওই সময় যাদের বাড়িতে আমি যেতাম, ওরা আমার উপস্থিতি টের পেয়ে মনে মনে ভাবতেন এই আপোদ কখন বাড়ি থেকে বিদায় হবে ! আর এখন ওরাই আমন্ত্রণ জানিয়েও আমাকে পান না ! এটাই ভবিতব্য ! প্রথম দিকে আমিও তখন নতুনই ছিলাম, কিন্তু দুর্ভাগ্য , যেখানে আমি ও নতুনেরা সুযোগই পেতাম না । উল্টে বিনে পয়সায় সম্পাদকদের জ্ঞান ও সৃজনশীল তীরস্কার সঙ্গে নিয়ে কলকাতা থেকে শ্রীরামপুর হুগলীর ‘ছায়ানীড়’- এর বাড়িতে কিরতাম ( “আরও পড়ুন , আরও লিখুন ….. এইসব ছাইভষ্ম কি করতে লেখেন” ….. ) !
তবে এটা মনে আছে , সত্যজিৎ রায় সম্পাদিত সন্দেশ’ পত্রিকায় মাত্র ৮ বছর বয়সে আমার প্রথম লেখা ৮ লাইনের একটা ছড়া প্রকাশিত হয়েছিল ! আমি একমাত্র কবিতাকে ভালোবেসে কলম ধরেছি , অন্য কিছু লেখার জন্য সম্পাদকদের দরজায় দরজায় টোকা দিই নি I চেষ্টা করতাম একটা ভালো কবিতা লেখার I হঠাৎই সরকারি দপ্তর থেকে ‘যুবমানস’ পত্রিকায় আমার একটি ছোট কবিতা ‘সময়’ প্রকাশিত হয়েছিল , যা ওই সময় পাঠকদের কাছে সমাদৃত হয়েছিল ! সেই সময় নিজের কাছে ঈর্ষণীয় ছিল প্রতিষ্ঠিত কবিদের কবিতাগুলো ! একলা ঘরে নিঃশব্দ নির্জনে সারারাত ধরে প্রখ্যাত কবিদের লেখা কবিতা গুলো মন দিয়ে পড়তাম , তার সাথে সাথে কোন কোন দিন একটা ভালো কবিতা লেখার চেষ্টা করতাম । কবিতাকে আদ্যোপান্ত সময় দিতাম ।
আমি আস্তে আস্তে পাঠকদের কাছে এগিয়েছি, দৌঁড়াইনি ! কবি শুদ্ধস্বত্ত বসু’- র কবিতা পত্রিকায় প্রকাশ হতে শুরু করলো আমার একটার পর একটা কবিতা । পাঠকরা দপ্তরে চিঠি দিয়ে মতামত দিতেন । পরের সংখ্যায় সেই চিঠিপত্র বিভাগে ছাপা হতো ! তবে এর আগে ৮০’র দশকের মাঝামাঝি থেকে বেশ কিছু পত্রিকায় আমার লেখা প্রকাশ হতে শুরু করলো ,…. পাঠক বন্ধুরা বিদ্যুৎ ভৌমিক এর কবিতার সাথে পরিচিত হতে শুরু করলো ! ভিতরে গভীরে দায়িত্ব বেড়ে গেল , আরও ভালো লেখার । এখানে একটা কথা না বলে পারছি না, আমি কিন্তু পাঠকদের কথা ভেবে কোন দিনই কবিতা লিখতাম না ! কবিতা লেখাটা একমাত্র আমার প্যাসান বলা যায় ।
পাঠক’যে সব কবিতা বুঝবে , অনুধাবন করতে পারবে সে বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া আমার কাছে খুবই মুস্কিল ! কবিতা’কে চেনা যায় পাঠকের মেধা ও মননের বিচারে , তা না হলে কবি যতই চেষ্টা করুক কবিতা নির্মাণের রসায়ণটা একেবারে অদেখা এবং অপ্রমেয় থেকে যাবে । কিছু কিছু ক্ষেত্রে কবিতার দর্শন পাঠকদের চিনিয়ে দিতে গিয়ে কবির সৃষ্টিটাই বিফলে যেতে বসে ! আমি মনে করি , কবিদের পাশাপাশি পাঠকদেরও কবিতা বোঝার জন্য চিন্তা – মেধা – বুদ্ধি ও সুগভীর আবেগ থাকাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ I আর সময়টাকে ধরার দিকে পাঠককে অন্তরদৃষ্টি সজাগ রাখতে হবে , আসলে আমি বা আমরা যে সময় একটা লেখা লিখছি তার পারিপার্শিক অবস্থা সেই সঙ্গে কবির মনের মধ্যে সেই লেখা নিয়ে কি ভাবনার তান্ডব চলছে ; সেই জায়গায় পাঠক যদি পৌঁছাতে পারেন তাহলে গোটা ব্যাপারটা সার্থক চেহারা নিতে পারে । এক সময়ে অর্থাৎ প্রায় ৩০ কি ৩২ বছর আগে কোন কিছু বাছ বিচার না করেই নামি কবিদের কবিতার বই এবং নানান ম্যাগাজিনে প্রকাশিত তাঁদের কবিতা গোগ্রাসে পড়তাম ! আর এখন সেটা উল্টোতে দাঁড়িয়েছে ….. এই মুহূর্তে নাম দেখে কবিতা পড়িনা । যে কবির লেখায় অসম্ভব রকমের সৃজন মেধায় ঠাসা এবং বুদ্ধিদীপ্ত , সেগুলো খুব বেশি বেশি করে পড়ি এক – দুই কিম্বা পাঁচ – ছয় বারও পড়ি ! এইসব অনামী কবিদের লেখা পড়ে মনে মনে ভীষণ ভাবে আপ্লুত হই । এখনে একটা কথা না বলে পারছি না , “অন লাইন কিম্বা ফেস বুক” এর লেখক ও কবিদের কবিতা আমি পড়ি না।
ইদানিং দেখছি ফেস বুক’- এর ভেতর হাজার হাজার কবি ( কবি কিনা জানিনা ) কিলবিল করছে॥ এই ফেসবুক”- এর সবাই যে কবি সে বিষয়ে আমার নিশ্চিত সন্দেহ আছে ! আবার ইদানিং কিছু ধান্দাবাজ সম্পাদক তাদের স্বার্থসিদ্ধি অর্থাৎ পকেট ভর্তী করতে নতুন কবিদের লোভ দেখিয়ে বেশ কিছু অর্থ ওদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিচ্ছে ! এরা নতুন কবিদের এও বলছেন , …. “আপনার কবিতা আমাদের পত্রিকার সম্পাদক মন্ডলি দ্বারা নির্বাচিত হয়েছে , আপনি এতটাকা প্রি বুকিং করুন আপনার কবিতা প্রকাশের পর আপনাকে সৌজন্য সংখ্যা সহ মেমেন্টো এবং প্রসংসাপত্র দিয়ে সম্মানিত করা হবে !”
ডঃ ইব্রাহীম ইসলাম: নতুন যারা কবিতার রাস্তায় হাঁটতে চাইছেন বা হাঁটছেন তারা রঙিন চশমা চোখে দিয়ে একটা আগামী ভবিষ্যৎ কে দেখতে চাইছেন , এবং পদে পদে ঠোক্কোর খেয়ে চলেছেন ! নতুন কবিদের এই ভাবনায় কি কোন ভুল আছে ? যদি বিস্তারিত আলোচনা করেন …..
কবি বিদ্যুৎ ভৌমিক : ইদানিংকালে এই কঠিন সময়ের মধ্যে নতুন বা নবীন কবি’রা বেশ ভুল পথে এগোচ্ছে ! তাদের অর্থের বিনিময়ে কৃতকৌশলে ব্যাবহার করছেন বেশ কিছু প্রকাশক ও সম্পাদক ! নতুনদের পান্ডুলিপি প্রকাশকরা ভুল বুঝিয়ে হাতিয়ে নিচ্ছেন , এবং সেই পাণ্ডুলিপি যখন বই আঁকারে প্রকাশ হচ্ছে সেগুলোর বিক্রির দায়িত্ব থেকে মুখ সরিয়ে নিচ্ছেন একসব অর্থলোভি প্রকাশকরা ! নতুন কবিদের কাব্যগ্রন্থ গুলি নবীন কবিরাই পরিচিতদের মধ্যে বিনামূল্যে দিতে বাধ্য হচ্ছেন ! এটাই এখন একটা চেনা ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে আরকি !
…. কবি’রা এইসব সম্পাদকদের ফাঁদে পা দিয়েই আছে ! এভাবে কি বর্তমান বাংলা কাব্য সাহিত্য বেঁচে থাকবে নিজের সৃজন গরিমায় ? আর এই কারণেই বর্তমানে প্রকৃত কবিতা ফুরিয়ে যাচ্ছে ! এই কথা ২০২২ শে আমি একটি সংবাদ মাধ্যমকে বলেছিলাম । আমাদের রাজ্যে কিছু হোক বা না হোক , প্রতিদিন হাজার হাজার কবির জন্ম হচ্ছে ! কিন্তু পাঠকের কিন্তু দেখা পাওয়া যাচ্ছে না ! এটাই কঠিনতম বাস্তব । যারা কবি তারাই তাদের সৃষ্টির পাঠক ! এই সব দেখে শুনে খুবই হাসি পায় ! এদেরকে সমর্থণ করার জন্য একদল প্রকাশক ও সম্পাদক আছে , যারা এইসব কবিদের উপজীব্য করে প্রকাশ্যে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে ! সম্প্রতি এই ২০২৫ শে কলকাতায় একটি বই প্রকাশ’- এর অনুষ্ঠানে আমাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল , উক্ত অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়ে দেখি পাঁচজন নবীন কবির কাব্যগ্রন্থ নাকি প্রকাশ করা হবে । ওই পাঁচজন কবির নাম আমার চল্লিশ বছরের কবিতা সাধনার ভেতর কোন দিন শুনিনি ! এদের লেখাও কোথাও পড়িওনি ! কিন্তু অদ্ভূত ব্যাপার হলো এইসব রত্নদের খুঁজে খুঁজে প্রকাশকরা বের করে এদের কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করছেন , তাদের মঞ্চে তুলে “অমুক স্মৃতি তমুখ স্মৃতি” প্রদান করছেন !
আমি এও খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছি , যাদের কাব্যগ্রন্থ এইসব প্রকাশক প্রকাশ করেছেন , সেই সব মহান কবিদের কাছ থেকে গ্রন্থ প্রকাশের যাবতিয় অর্থ নিয়েছেন এবং এটাও ঠিক এদের কাব্যগ্রন্থের বিক্রয়ের দায় দায়িত্ব নাকি প্রকাশন দপ্তর নেবেন না , গোটা ব্যাপারটা কবিদের নিতে হবে ! ঠিক এই কারণেই বর্তমান বাংলা কাব্য সাহিত্য থেকে প্রকৃত কবিতার পাঠক মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে ! সত্যি কি চলছে দুনিয়ায় , যায় কোন প্রতিবাদ নেই । আমি খুবই স্ট্র্যাগল্ করে এই কবিতার জগতে এসেছি । আমাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে প্রচুর বইপত্র পড়তে হয়েছে এবং এখনো পড়ি।
বর্তমানে ভারত ও বাংলাদেশের কবিতার প্রেক্ষাপট নিয়ে আলোচনা ও সুচিন্তিত সমালোচনা আমাদেরও করতে হয় , কিন্তু কখনো আমাদের কবিতা নিয়ে পন্ডিত মহল অর্থাৎ কবিতার সমালোচকরা কোন বিরুপ মন্তব্য করেছেন কিনা , এটা আমার জানা নেই । আমি আবার বলছি , আমি পাঠকের কাছে সমাদৃত হব বলে লিখি না , ৭০’ এর দীর্ঘায়িত সময় ধরে আমি আমার কঠিন শ্রম – নিষ্ঠা ও আন্তরিক একাগ্রতার সঙ্গে কবিতাকে ভালোবেসে লিখে চলেছি ….. থামবো কবে , বলতে পারছি না !
তবে এই জটিল মুহূর্তে অবক্ষয় সময়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে আমি সব সময়ই পজেটিভ চিন্তা করি ৷ আসলে কি , এই ছলচাতুরি , কপটতা , আর ভন্ডামি হয়ে উঠেছে রাজনৈতিক চতুর্যের অমোঘ নিয়তি ৷ সম্পাদক ও প্রকাশক রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় বেড়ে উঠেছে ! এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কেউ নেই ! এই বিস্তৃত প্রমাণ্যসূত্রিক আলোচনায় , এটাই সুস্পষ্ট হয় যে , রাষ্ট্রসন্ত্রাস, গণহত্যার বর্বরতা চলে এসেছে সেই আদ্যিকাল থেকে ! পৃথিবীর শিল্পী , কবি , সাহিত্যিক , চিত্রকর , ভাস্কর , শিক্ষক ও বুদ্ধিজিবি , এঁরা গান গেয়ে , কবিতা গল্প গল্প উপন্যাস প্রবন্ধ নিবন্ধ লিখে , ছবি এঁকে যুগ যুগ ধরে আপ্রাণ চেষ্টা করে আসছেন এই পৃথিবীটাকে দুষণমুক্ত করার !
সময়ের সাথে সাথে অনেক কিছুই পাল্টেছে , বদলেছে শয়তানের চেহারা ! ভদ্রতার মুখোশ এঁটে এটা চলিয়ে যাচ্ছে তান্ডাব ! আমরা যারা স্বপ্ন দেখি একটা সত্যি কারের মেঘমুক্ত আকাশ , একটা ফুল আর পাখির কাকুলিতে ঢাকা পৃথিবী ; সেই স্বপ্নকে কিছু ধান্দাবাজ শয়তান তাদের হিংসা ও সার্থপরতা দিয়ে ভেঙে খান খান করে দিচ্ছে ! এটার জন্য আমি বর্তমান রাজনিতিকে দায়ি করবো ৷ তবে এটা বেশি দিন চলতে পারে না , একটা সময় একদিন আসবে যখন আমাদের স্বপ্নগুলো একে একে বেঁচে উঠবে ! আর যারা এই পৃথিবীটাকে কব্জা করতে চেয়েছিল , তাদের অবস্থানগত পরিবর্তন হবেই হবে ! দেখে নেবেন ,—–
আমাদের মত কবিদের মাঝেমধ্যেই কবিতা না বোঝা পাঠকদের কাছে গালমন্দ খেতে হয় । তার কারণ , আমাদের কবিতাগুলি নাকি অতিমাত্রায় দুবোর্ধ্য !
আসলে কি দুর্বোধ্যতা পাঠকদের অজ্ঞতা বা অযোগ্যতা বলে আমি মনে করি ! কবি বিষ্ণু দে , সুভাষ মুখোপাধ্যায় , বিরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় , প্রেমেন্দ্র মিত্র , শঙ্খ ঘোষ , সুনীল , শক্তি , জয় গোস্বামী , সুবোধ সরকার”- দের এই অপবাদ শুনতে হয়েছে এবং মন্দার , সৃজাত আমাকেও শুনতে হয় ! এটা নতুন কিছু নয় , এইসব গালমন্দ শুনে শুনে আমাদের অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে !
ডঃ ইব্রাহীম ইসলাম:~ এবার আসছি বিদ্যুৎ বাবু আপনার কবিতা নিয়ে কিছু কথা শুনতে ৷ ( কবি বিদ্যুৎ ভৌমিক হাসি মুখে বললেন , বলুন ? ) বর্তমান পরিস্থিত , সমাজ ব্যবস্থা , মূল্যহীনতা , জাত-পাত , কিম্বা ধর্মটর্ম ; এইসব বিষয় নিয়ে আপনি কি এই মূহুর্তে কিছু লিখছেন , বা লিখবেন বলে চিন্তা করছেন ?
কবি বিদ্যুৎ ভৌমিক :~ দেখুন আমি শুধুমাত্র কবিতা ও ছোটদের জন্য ছাড়া লিখি , তবে সম্পাদকদের আবদার মেটাতে গিয়ে মাঝেমধ্যে গল্পটল্প লিখতে হয় ! আমি মনে করি আমার মত যঘণ্য গদ্যকার অর্থাৎ গল্প লেখক পৃথিবীতে আর আছেন কিনা , সে বিষয়ে আমার সন্দেহ আছে ! আমি খুব কমই গল্প লিখি , সেই লেখা যে কবিতার শরীর নিয়ে ফেলে সেটা আমি লেখার আগে অনুধাবন করতে পারি না ! ( মৃদু হেসে ) তবে কবিতাটা আমি খুবই যত্ন , নিষ্ঠা এবং একাগ্রতার সাথে লিখি ! এটা দু’ই বাংলার আমার পাঠক বন্ধুরা র্দীঘদিন ধরে দেখে আসছেন !
ডঃ ইব্রাহীম ইসলাম:~ বিদ্যুৎ বাবু এবার বলুন আপনার প্রেম এবং কবিতার ভেতর তার প্রভাব কতটা বিস্তৃত ?
কবি বিদ্যুৎ ভৌমিক :~ আমি বেশ পাকাপোক্ত প্রেমিক বলা যেতে পারে ! সাতপুরুষের সম্পত্তি আগলে রাখার মতোই এই প্রেম ও প্রতিশব্দময় ভালোবাসা”- কে আমি আগলে রেখেছি ৷ আমার প্রেম ? কিভাবে বর্ণনা করবো ভেবে পাচ্ছিনা , তবু প্রশ্নটা যখন করেছেন তখন না বলে পারছি না ৷ আমার জীবনে প্রেম বহু বার এসেছে ও গেছে ! কাছে থেকেছে খুব কম , অনাহুতো অতিথির মতোই ! আমি তখন শ্রীরামপুর হুগলীর পূর্ণচন্দ্র প্রাথমিক বিদ্যালয়ে জুনিয়র ক্লাসে পড়ি ৷ আমার পাশে একই বেঞ্চে শুভ্রা নামে একটা মেয়ে বসতো , ভীষণ সুন্দরী একটা ফুটফুটে মেয়ে ! আমি স্কুলে পড়া পারি বা না পারি , প্রতিদিন ওই ছোট্ট শুভ্রা মেযেটার জন্য স্কুল কামাই করতাম না ! আমাদের ঝিলবাগানের কুসুমকুঞ্জের বাড়িতে আমি আমার জ্যাঠতুতো দাদা-দিদি ও বড়দের কাছে শুভ্রার গল্প করতাম ৷ দাদা , দিদি , ও বাড়ির বড়রা আমাকে ঠাট্টা করে বলতো ; “রানা তোর সাথে শুভ্রার বিয়ে দিয়ে দেব !”— একটা কথা এখানে বলি , আমার ডাক নাম রানা ৷ এই রানা ব’লে বাড়ির সবাই আমাকে ডাকে ৷ ওদের কথা আমি ওই অল্প বয়সে বিশ্বাস করে ফেলে ছিলাম , একটু একটু করে শুভ্রাকে আমি ভালোবেসে ফেলে ছিলাম ! তখন প্রেম বা ভালোবাসা কাকে বলে সেটাই জানতাম না , তবে কিছু একটা যে মনের মধ্যে ঝড় তুলেই চলেছে সেটা অনুধাবন করতাম !
বাড়ির যারা আমাকে বলেছিল শুভ্রার সাথে আমার বিয়ে দিয়ে দেবে, সেই ওদের কথা আমি শুভ্রাকে বলেও ছিলাম ! আমার কথা শুনে ওই মেয়েটা সেদিন এক হাতে মুখ ঢেকে হেসে ছিল ! সে স্মৃতি এখনো আমার অন্তরের অন্তঃস্থলে গোচ্ছিত আছে ! সেই শুভ্রা একদিন স্কুলে আসা বন্ধ করে দিলো ! স্কুলের অন্য সব বন্ধুদের কাছে ওর কথা জিজ্ঞাস করাতে কেউ বলতে পারেনি শুভ্রা স্কুলে আসছেন কেন ! একদিন টিফিন প্রিয়ডে আমাদের স্কুলের কমলবাবু নতুন দিদিমুনিকে কি যেন বলছিলেন , আমি একটু দূরেই দাঁড়িয়ে ছিলাম ৷ কান পেতে শুনলাম কলমবাবু বলছিলেন ; শুভ্রা মেয়েটার ব্লাড ক্যানসার হয়েছে ও আর স্কুলে আসবেনা ! সত্যি শুভ্রা আর কোনোদিনই স্কুলে আসেনি ! ওর বাড়ি কোথায় , সেটাও আমার জানা ছিল না ! মেয়েটা বেঁচে আছে , না মরে গেছে , তাও জানিনা ! তবে এখনো আমার মনের মন্দিরে সেই মিষ্টি হাসি মাখা সুন্দর মেয়েটা এখনো আছে ! এটাই প্রেম , যা আমাকে এই ছাপান্ন বছর বয়সেও অহর্নিশ ডুবিয়ে মারে ! এরপর বড় বেলাতেও প্রেম এসেছে , আবার ফুঁড়ুৎ করে পালিয়েও গেছে !
আমার পরবর্ত্তী সময়ে ওই সব প্রেম”- নানা ভাবে , নানা রূপে কবিতায় এসেছে ! নবনীতা’-কে নিয়ে আমার কবিতার পাঠকদের মধ্যে গুঞ্জন শোনা যায় ৷ আমি নবনীতাকে নিয়ে প্রচুর কবিতা লিখেছি ৷ আমার , কথা না রাখার কথা শীর্ষক কাব্যগ্রন্থে নবনীতাকে নিয়ে বেশকিছু কবিতা আছে ৷ এই নবনীতা কে , কেন , এবং আমার সাথে কি সম্পর্ক সেটা আমি বলতে পারবো না ৷ এটা বলে ফেললে কবিতার মেজাজটাই নষ্ট হয়ে যাবে ৷ তাই না ,—- ?
ডঃ ইব্রাহীম ইসলামঃ বিদ্যুৎ বাবু একটা বিশেষ কথা আপনার কাছে জানতে চাইছি , সেটা হল কবিতার চিত্রকল্প ৷ এই বিষয়টা নিয়ে যদি বিস্তারিত কিছু বলেন ?
কবি বিদ্যুৎ ভৌমিক : হ্যাঁ খুব ভালো প্রশ্ন করেছেন ইব্রাহিম বাবু ৷ দেখুন , গোটা জীবনটা ধরে মস্ত মস্ত মোটা মোটা বই লেখার চাইতে , আমি মনে করি একটা সত্যি কারের রিয়্যালিষ্টিক অর্থাৎ সার্থক চিত্রকল্প নির্মাণ করা অনেক ভালো ! তাই না ? It is better to present one image in lifetime than to produce voluminous work I এটা আমার কথা নয় , এটা এজরা পাউন্ড এর প্রণিধানযোগ্য বাণী ! এই চিত্রকল্প বিষয়টা কি ? উপমা ও চিএকল্প ব্যাপারটা কি এক ? কবি জীবনানন্দ দাশ বলেছেন ; উপমাই কবিত্ব ৷ উপমার মধ্যে চিত্র থাকলেও চিএকল্প ও উপমা কখনোই এক হয় না ৷ কবিতা রচনার মধ্যে কবির বুদ্ধিমত্তা ও আবেগের সংহতিকে যা একটা বিশেষ মুহূর্তে কবিহৃদয়ে জাগিয়ে তোলা ! কিন্তু এই ইমেজ কবির মনে জন্ম নেয় কিভাবে ? কবিকে আগে শব্দের দীক্ষা নিতে হবে ৷ শব্দ একটা কন্সেপ্ট concept অর্থাৎ ধারণার প্রতীক , এটা কিন্তু সর্বাগ্রে কবিকে অনুধাবন করতে হবে ৷ এরপর কবিকে শরীর , মন , প্রাণ দিয়ে বিশুদ্ধ থাকতে হবে ! তবেই তাঁর দর্শন আরও শক্তিশালী হবে।
সাম্প্রতিক বাংলা কবিতায় চিত্রকল্পের যে বহুল প্রয়োগ দেখা যায় , “ইমেজিষ্ট” আন্দোলনের পরোক্ষ প্রভাব থেকেই সেটা এসেছে ! কবিতায় জীবনের গভীরার্থ অনুসন্ধান করতে গিয়ে ভাঙাচোরা সময় থেকে সুস্থিতি ফিরে পাওয়ার আত্যান্তিক তাগিদ আমি অহর্নিশ উপলব্ধি করি ! যাই হোক , এটুকুই বললাম ৷ আগামী দিনে কবিতার চিত্রকল্প”- এই বিষয়টা নিয়ে আরও বিস্তারিত বলার ইচ্ছা রইল।
ডঃ ইব্রাহীম ইসলাম: বিদ্যুৎ বাবু , উত্তর আধুনিকতাবাদ প্রসঙ্গে আপনার মতামত যদি আপনি খোলসা করে বলেন …..
কবি বিদ্যুৎ ভৌমিক : এই প্রসঙ্গ নিয়ে ইতিমধ্যে অনেকে অনেক ভাষণ-টাষণ দিয়েছেন , নানা সাহিত্যধর্মী ম্যাগাজিনে লম্বা লম্বা প্রবন্ধ লিখেছেন পন্ডিত মহল ৷ আমি সেই বিচারে পণ্ডিত- টন্ডিত নই , তবে আমার সামান্য অল্পসল্প পড়াশোনা থেকে এটা বলতে পারি , আসলে আমার যেটা মনে হয় এই উত্তর আধুনিকতাবাদ আধুনিকতাবাদের একটা প্রকারন্ত দিক ! যা গোটা ব্যাপারটাকে সমৃদ্ধ করে । কিম্বা আধুনিকাতার পরবর্তী সিঁড়ি বলা যেতে পারে ৷ কিন্তু আসলে আদৌ সেটা তা নয় ! কারণ এরা পরস্পর বিরোধী পক্ষ ৷ আধুনিকতার মূল উপজিব্য কারণ হল এটা যে সময় , একে আদ্যোপান্ত ধারণ করা ৷ কিন্তু উত্তরাধুনিকতার মূল বিষয়টা হল কোন কিছু ধ্রুব অর্থাৎ সত্য মেনে ধারণ করা যাবে না ৷ ফলে এই ধ্রুবহীনতাকে আদর্শ ধরে যে কাঠামোকে গ্রহণ করা হয় তাকেই বলা যেতে পারে উত্তরাধুনিকতাবাদ ৷ এই মতবাদটিতে লেখকের যে ক্যারেক্টরের কথা বলা হয়ে থাকে তা মূলত লেখকের স্বাধীনতা কিম্বা স্বকীয়তা ৷
কবিতার বিষয়বস্তুই হল বাস্তবতার ভিন্নরূপ ! কেননা কবি তার চারপাশে যেই চিত্র উপলদ্ধি করেন তাই শব্দের মাধ্যমে আঁকেন ৷ তবে বাস্তবতাকে যদি ধ্রুব না মানা যায় তবে কি দরকার কবিতায় ধ্রুবহীনতা ? এটাও কিন্তু সত্যি এই সব ব্যাপার ট্যাপার নিয়ে বেশি ভাবলে কিন্তু আসল দিকটায় ফাঁক থেকে যাবে ৷ সেটা হল কবির কলম দিয়ে কবিতা নির্মাণ না হয়ে ব্যাকরণ ট্যাকরণ শব্দ ও অক্ষরে গড়ে উঠবে ৷ আমি বিশ্বাস করি কবিতা মূলত সমাজ ও শিল্প গঠনের উপর নির্ভর করে নির্মাণ হয় ৷ আবার এটাও সত্য কবিতা কিন্তু গঠন নির্ভর নয় ৷ কবিতা হল বিষয় আর ভাব নির্ভর ৷ বাস্তবতার কল্পনা জ্ঞান দ্বারা যে নির্মাণ কাজ সাধিত হয় সেটাই কবিতা ৷ আমরা কি আগের কোন কবির কবিতা ফেলে দিতে পারবো , কিম্বা তাঁদের সৃষ্টি নিয়ে বিদ্রুপ করতে পারি ? অবশ্যই নয় ৷ যেটা পারি তা কেবল কবিতার ভিন্নধারা নির্মাণ করতে ৷ এইজন্যেই কবিতা আধুনিক বা পুরাধুনিক হয় না ৷ আধুনিক কিম্বা পুরাধুনিক হয়ে যার কবিতার শব্দ , গঠন , ভাষা আর তার সময়ের প্রেক্ষাপট ৷
আসলে কবিতা অনুধাবন করতে গেলে আগে ভিতরকার শিক্ষার প্রয়োজন ৷ এক কথায় পাঠকদের কবিতার শিক্ষার শিক্ষীত হতে হবে , তা না হলে আমাদের কবিতা পাঠকদের মাথার উপর দিয়ে চলে যাবে ! তবে এটা সত্যি , কবিতা বোঝার লোক খুবই কম ! হাতে গুনে বলা যায় ! যাই হোক , এরই মধ্যে সুদিন একদিন আসবেই আসবে ! এ আমার দৃঢ় বিশ্বাস ………
ডঃ ইব্রাহীম ইসলাম: বিদ্যুৎ বাবু , আপনার কাছে অনেক কিছু জানতে পারলাম ৷ আপনি যে আমাকে এতোটা সময় দিয়েছেন এর জন্য আপনার প্রতি রইল শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা ৷
কবি বিদ্যুৎ ভৌমিক : না না ওসব কিছু নয় , আমি যতটুকু জানি সেটাই আপনাকে বললাম ৷ তবে কবিতা লেখা খুবই কঠিন কাজ ৷ আমি মনে করি একটা কবিতার একটা লাইন আমৃত্যু একজন মানুষ তাঁর অন্তরের অন্তঃস্থল দিয়ে বয়ে নিয়ে বেড়ায় ! ওই এক লাইনই আমি প্রকৃত কবিতা বলে মনে করি ৷ যাই হোক , এবার আমাকে উঠতে হবে তার কারণ কলকাতার একটা বেসরকারী এফ এম রেডিওতে আমার স্বরচিত কবিতা বলার আমন্ত্রণ আছে ৷ ইন্ডিয়াতে আবার এলে অবশ্যই আমার শ্রীরামপুর হুগলীর ছায়ানীড়”- এর বাড়িতে আসবেন কিন্তু ইব্রাহীম বাবু ৷ উঠি , আবার সময় সুযোগ হলে সাক্ষাতে কথা হবে।