প্রোগ্রাম ফর পারফরম্যান্স ইমপ্রুভমেন্ট (পিপিআই) কার্যক্রমের ২৪৮ কোটি ৫৫ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে ঢাকা ওয়াসার তিন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। ইতোমধ্যে তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
বুধবার (১০মে) দুদকের ঢাকা সমন্বিত জেলা কার্যালয়ে সংস্থাটির সহকারী পরিচালক মো. আশিকুর রহমান বাদী হয়ে মামলাটি দায়ের করেন।
অভিযোগসূত্রে জানা যায়, ২০১০ সাল থেকে ২০২০ পর্যন্ত এগারো বছরে ঢাকা ওয়াসা ও ঢাকা ওয়াসা কর্মচারী বহুমুখী সমবায় সমিতি লিমিটেডের মধ্যে চুক্তি অনুযায়ী পিপিআই কার্যক্রমে কমিশন হিসেবে ৩৫৪ কোটি ১৬ লাখ ৬৬ হাজার টাকা ব্যাংক হিসাবে জমা হয়। কমিশন বা লভ্যাংশ হিসাবে ওই টাকা জমা হলেও দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা মিলেমিশে ২৪৮ কোটি ৫৫ লাখ টাকা নিজেদের পকেটে ভরেছেন।
মামলার আসামিরা হলেন- ঢাকা ওয়াসার সাবেক রাজস্ব পরিদর্শক ও পিপিআই প্রকল্প পরিচালনা কমিটির কো-চেয়ারম্যান মো. মিজানুর রহমান, ওয়াসার সাবেক রাজস্ব পরিদর্শক ও পিপিআই পরিচালনা পর্ষদের মো. হাবিব উল্লাহ ভূইয়া এবং ঢাকা ওয়াসার রাজস্ব জোন ৬-এর কম্পিউটার অপারেটর মো. নাঈমুল হাসান।
ওয়াসার কর্মচারীরা বলছেন, ১০ বছর ধরে মাত্র তিন কর্মকর্তা মিলে এত টাকা আত্মসাতের সাহস কীভাবে হলো? পেছনের রাঘব-বোয়ালরা আড়ালেই থেকে গেল। পেছনে যারা ছিল তাদেরকে আইনের আওতায় আনা যায়নি। এমনকি পিপিআই পরিচালনা কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে মো. আক্তারুজ্জামান অন্তর্বর্তীকালীন সময়ে দায়িত্ব পালন করলেও তাকে আসামি করা হয়নি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে দুদক সচিব মো. মাহবুবু হোসেন গণমাধ্যমকে বলেন, পিপিআই পরিচালনা কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে মো. আক্তারুজ্জামান অন্তর্বর্তীকালীন সময়ে দায়িত্ব পালন করলেও হিসাব পরিচালনার কোনো নথিপত্রে তার স্বাক্ষর পাওয়া যায়নি। সে কারণে তাকে আসামি করা যায়নি। তবে মামলার তদন্তে যারই সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যাবে, তাকে আসামি করা হবে।
মামলার এজাহার সূত্রে জানা যায়, ২০১০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত দশ বছর ঢাকা ওয়াসা ও ঢাকা ওয়াসা কর্মচারী বহুমুখী সমবায় সমিতি লিমিটেডের মধ্যে সই করা চুক্তি অনুযায়ী পিপিআই (প্রোগ্রাম ফর পারফরমেন্স ইমপ্রুভমেন্ট) কার্যক্রমের আওতায় ব্যাংকে জমা হওয়া অর্থ থেকে ২৪৮ কোটি ৫৫ লাখ ২২ হাজার ৯০০ টাকা আত্মসাৎ করেছেন আসামিরা। তারা পরস্পর যোগসাজশে ঢাকা ওয়াসা কর্মচারী বহুমুখী সমবায় সমিতি লিমিটেডের পক্ষে পিপিআই পরিচালনা কমিটির নামে পরিচালিত ব্যাংক হিসাব থেকে অবৈধভাবে ওই টাকা আত্মসাৎ করেছেন বলে দুদকের অনুসন্ধানে প্রমাণিত হয়েছে। যে কারণে তাদের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ৪০৯/১০৯ ধারা ও ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫ (২) ধারায় মামলা দায়ের করা হয়েছে।
ঘটনার বিবরণে জানা যায়, ঢাকা ওয়াসা কর্মচারী ভোগ্যপণ্য সরবরাহ সমবায় সমিতি লিমিটেড ২০০৫ সালে উপ-আইন সংশোধনীর মাধ্যমে ঢাকা ওয়াসা কর্মচারী বহুমুখী সমিতি লিমিটেড নামে নিবন্ধন লাভ করে। রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যে ১৯৯৬ সালের ২৫ নভেম্বর ঢাকা ওয়াসা ও ঢাকা ওয়াসা কর্মচারী সমবায় সমিতির মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তি অনুযায়ী রাজস্ব আদায়, পানির মিটার স্থাপন ও বিলবাবদ প্রথমে ৬ শতাংশ হারে এবং পরবর্তীতে ১০ শতাংশ হারে লভ্যাংশ গ্রহণ করা হয়েছে। যা সমবায় সমিতির সদস্যদের মধ্যে বণ্টনের উদ্দেশ্য থাকলেও তা যথাযথভাবে বন্টন করা হয়নি। ২০১০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ের মধ্যে সেবা গ্রহণকারী প্রতিষ্ঠান ঢাকা ওয়াসা আয়কর বাবদ ২৪ কোটি ৬১ লাখ ৭৮ হাজার ২৯০ টাকা ও ভ্যাট বাবদ ৪০ কোটি ৫৬ লাখ ৭৭ হাজার ৬৭৩ টাকা এবং অন্যান্য খাতে (অফিস ভাড়া, মোবাইল কোর্ট বাবদ খরচ, মিটার টেস্টিং ফি ইত্যাদি) কর্তন বাবদ প্রায় ৪ কোটি ৪৮ লাখ ৩০ হাজার ৪৬০ টাকা কেটে রেখে সর্বমোট ৩৫৪ কোটি ১৬ লাখ ৬৬ হাজার ৪২৯ টাকা জনতা ব্যাংকের কারওয়ান বাজার কর্পোরেট শাখায় সমিতির ব্যাংক হিসাবে প্রদান করা হয়।
প্রদানকৃত এ বিলের মধ্যে ২০১০ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ১০ বছরের মধ্যে ২০১৩, ২০১৫, ২০১৭ ও ২০১৯ সালে চারবার মোট ২ কোটি ৫৭ লাখ ৯৫ হাজার ৮৪৩ টাকা সদস্যদের মধ্যে লভ্যাংশ দেওয়া হয়। পিপিআই পরিচালনা কমিটি প্রতি বছর পরিচালনা ব্যয় নির্বাহ করে বিপুল পরিমাণ টাকা লাভ করার পরও নিয়মিত লভ্যাংশ দেয়নি। ফলে সমিতি গঠনের মূল উদ্দেশ্য লঙ্ঘিত হয়েছে। এ সময়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত সমিতির ব্যবস্থাপনা কমিটি, পিপিআই পরিচালনা পর্ষদ এবং ব্যাংক হিসাব পরিচালনাকারীদের জিজ্ঞাসাবাদ ও অডিট রিপোর্টসহ সংশ্লিষ্ট নথি যাচাই-বাছাই করে মোট ৯৫ কোটি ১ লাখ ৮৮ হাজার ৭১৫ টাকা ব্যয়ের রেকর্ড পাওয়া যায়। এই সময়ে ব্যাংক হিসাবটিতে স্থিতি ছিল ১০ কোটি ৫৯ লাখ ৫৭ হাজার ৮১৪ টাকা। সুতরাং আত্মসাৎকৃত অর্থের পরিমাণ পাওয়া যায় ২৪৮ কোটি ৫৫ লাখ ২২ হাজার ৯০০ টাকা।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, মো. নাঈমুল হাসান প্রকল্পের হিসাব পরিচালনাকারীর দায়িত্ব পালন করেছেন। আরেক আসামি মো. হাবীব উল্লাহ ভূইয়া সমিতির পক্ষে পিপিআই প্রকল্পের অফিস ব্যবস্থাপক হিসেবে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। দায়িত্ব পালনকালে সমস্ত হিসাব নিকাশ ও রেকর্ডপত্র নিজে সংরক্ষণ করতেন এ কর্মকর্তা।
রেকর্ডপত্র পর্যালোচনায় দেখা যায়, মো. হাফিজ উদ্দিন (মৃত) ও মো. মিজানুর রহমানের স্বাক্ষরে যে সকল চেক ব্যাংকে পাঠানো হতো তার অধিকাংশই জাল স্বাক্ষর ছিল। আর এতে স্বাক্ষর করে টাকা আত্মসাতে সহায়তা করতেন মো. হাবীব উল্লাহ ভূইয়া।
নিউজ /এমএসএম