৭০’ এর মধ্যভাগ সময় থেকে শুরু হয়ে ছিল আমার কবিতা লেখার পথ ! সেই সময় মিডিয়ার দৌড়াত্ব বলতে এতটা স্ট্রং ছিলনা । হাতে গোনা কয়েকটি প্রথম শ্রেণীর ম্যাগাজিন , (যেখানে গোষ্টিবাজি করে আসা এবং সম্পাদকদের চাটুকারি করে বেশ কিছু অক্ষর শ্রমিকরা ঠাই পেতেন ) আমাদের মত নতুন কবিদের কবিতা প্রকাশের প্রশ্ন আসেই না বলা যায় ! এছাড়া লিটল ম্যাগাজিন … সেতো কলেজ স্ট্রিট অঞ্চলের সোভা পেতো , সেগুলো তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতাম , এবং মনে মনে স্বপ্ন দেখতাম আমিও একদিন এইসব ম্যাগাজিনে লিখবো ! কিন্তু দুর্ভাগ্য , যেখানে আমি ও নতুনেরা সুযোগই পেতাম না । উল্টে বিনে পয়সায় সম্পাদকদের জ্ঞান ও সৃজনশীল তীরস্কার সঙ্গে নিয়ে কলকাতা থেকে শ্রীরামপুর হুগলীর বাড়িতে ফিরতাম ( “আরও পড়ুন , আরও লিখুন ….. এইসব ছাইভষ্ম কি করতে লেখেন” ….. ) !
তবে এটা মনে আছে , সত্যজিৎ রায় সম্পাদিত সন্দেশ’ পত্রিকায় মাত্র ৮ বছর বয়সে আমার প্রথম লেখা ৮ লাইনের একটা ছড়া প্রকাশিত হয়েছিল ! আমি একমাত্র কবিতাকে ভালোবেসে কলম ধরেছি, অন্য কিছু লেখার জন্য সম্পাদকদের দরজায় দরজায় টোকা দিই নি। চেষ্টা করতাম নিজের পায়ে দাঁড়াতে , হঠাৎই সরকারি দপ্তর থেকে যুবমানস পত্রিকায় আমার একটি ছোট কবিতা ‘সময়’ প্রকাশিত হয়েছিল , যা ওই সময় পাঠকদের কাছে সমাদৃত হয়েছিল ! সেই সময় নিজের কাছে ঈর্ষণীয় ছিল প্রতিষ্ঠিত কবিদের কবিতাগুলো ! একলা ঘরে নিঃশব্দ নির্জনে সারারাত ধরে প্রখ্যাত কবিদের লেখা কবিতা গুলো মন দিয়ে পড়তাম , তার সাথে সাথে কোন কোন দিন একটা ভালো কবিতা লেখার চেষ্টা করতাম ।
আমি আস্তে আস্তে পাঠকদের কাছে এগিয়েছি , দৌঁড়াইনি ! কবি শুদ্ধস্বত্ত বসু’- র কবিতা পত্রিকায় প্রকাশ হতে শুরু করলো আমার একটার পর একটা কবিতা । পাঠকরা দপ্তরে চিঠি দিয়ে মতামত দিতেন। পরের সংখ্যায় সেই চিঠিপত্র বিভাগে ছাপা হতো ! তবে এর আগে থেকে বেশ কিছু পত্রিকায় আমার লেখা প্রকাশ হতে শুরু করলো ,…. পাঠক বন্ধুরা বিদ্যুৎ ভৌমিক এর কবিতার সাথে পরিচিত হতে শুরু করলো ! ভিতরে গভীরে দায়িত্ব বেড়ে গেল , আরও ভালো লেখার । এখানে একটা কথা না বলে পারছি না , আমি কিন্তু পাঠকদের কথা ভেবে কবিতা লিখতাম না ! লেখাটা একমাত্র আমার প্যাসান বলা যায়।
পাঠক’যে সব কবিতা বুঝবে, অনুধাবন করতে পারবে সে বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া আমার কাছে খুবই মুস্কিল ! কবিতা’কে চেনা যায় পাঠকের মেধা ও মননের বিচারে , তা না হলে কবি যতই চেষ্টা করুক কবিতা নির্মাণের রসায়ণটা একেবারে অদেখা এবং অপ্রমেয় থেকে যাবে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে কবিতার দর্শন পাঠকদের চিনিয়ে দিতে গিয়ে কবির সৃষ্টিটাই বিফলে যেতে বসে ! আমি মনে করি , কবিদের পাশাপাশি পাঠকদেরও কবিতা বোঝার জন্য চিন্তা – মেধা – বুদ্ধি ও সুগভীর আবেগ থাকাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ I আর সময়টাকে ধরার দিকে পাঠককে অন্তরদৃষ্টি সজাগ রাখতে হবে , আসলে আমি বা আমরা যে সময় একটা লেখা লিখছি তার পারিপার্শিক অবস্থা সেই সঙ্গে কবির মনের মধ্যে সেই লেখা নিয়ে কি ভাবনার তান্ডব চলছে ; সেই জায়গায় পাঠক যদি পৌঁছাতে পারেন তাহলে গোটা ব্যাপারটা সার্থক চেহারা নিতে পারে।
এক সময়ে অর্থাৎ প্রায় ৩০ কি ৩২ বছর আগে কোন কিছু বাছ বিচার না করেই নামি কবিদের কবিতার বই এবং নানান ম্যাগাজিনে প্রকাশিত তাঁদের কবিতা গোগ্রাসে পড়তাম ! আর এখন সেটা উল্টোতে দাঁড়িয়েছে ….. এই মুহূর্তে নাম দেখে কবিতা পড়িনা । যে কবির লেখায় অসম্ভব রকমের সৃজন মেধা ঠাসা থাকে সেগুলো খুব বেশি বেশি করে পড়ি এক – দুই কিম্বা পাঁচ – ছয় বারও পড়ি ! এখনে একটা কথা না বলে পারছি না , “অন লাইন কিম্বা ফেস বুক” এর লেখক ও কবিদের কবিতা আমি পড়ি না । ইদানিং দেখছি ফেস বুক’- এর ভেতর হাজার হাজার কবি ( কবি কিনা জানিনা ) কিলবিল করছে। আবার ইদানিং কিছু ধান্দাবাজ সম্পাদক তাদের স্বার্থসিদ্ধি অর্থাৎ পকেট ভর্তী করতে নতুন কবিদের লোভ দেখিয়ে বেশ কিছু অর্থ ওদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিচ্ছে ! এরা নতুন কবিদের এও বলছেন , …. “আপনার কবিতা আমাদের পত্রিকার সম্পাদক মন্ডলি দ্বারা নির্বাচিত হয়েছে , আপনি এতটাকা প্রি বুকিং করুন আপনার কবিতা প্রকাশের পর আপনাকে সৌজন্য সংখ্যা সহ মেমেন্টো এবং প্রসংসাপত্র দিয়ে সম্মানিত করা হবে !” …. কবি’রা এইসব সম্পাদকদের ফাঁদে পা দিয়েই আছে ! এভাবে কি বর্তমান বাংলা কাব্য সাহিত্য বেঁচে থাকবে নিজের সৃজন গরিমায় ? আর এই কারণেই বর্তমানে প্রকৃত কবিতা ফুরিয়ে যাচ্ছে ! এই কথা ২০২২ শে আমি একটি সংবাদ মাধ্যমকে বলেছিলাম । আমাদের রাজ্যে কিছু হোক বা না হোক, প্রতিদিন হাজার হাজার কবির জন্ম হচ্ছে ! কিন্তু পাঠকের কিন্তু দেখা পাওয়া যাচ্ছে না ! এটাই কঠিনতম বাস্তব।
যারা কবি তারাই তাদের সৃষ্টির পাঠক ! এই সব দেখে শুনে খুবই হাসি পায় ! এদেরকে সমর্থণ করার জন্য একদল প্রকাশক ও সম্পাদক আছে , যারা এইসব কবিদের উপজীব্য করে প্রকাশ্যে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে ! সম্প্রতি এই ২০২৫ শে কলকাতায় একটি বই প্রকাশ’- এর অনুষ্ঠানে আমাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল , উক্ত অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়ে দেখি পাঁচজন নবীন কবির কাব্যগ্রন্থ নাকি প্রকাশ করা হবে । ওই পাঁচজন কবির নাম আমার চল্লিশ বছরের কবিতা সাধনার ভেতর কোন দিন শুনিনি ! এদের লেখাও কোথাও পড়িওনি ! কিন্তু অদ্ভূত ব্যাপার হলো এইসব রত্নদের খুঁজে খুঁজে প্রকাশকরা বের করে এদের কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করছেন , তাদের মঞ্চে তুলে “অমুক স্মৃতি তমুখ স্মৃতি” প্রদান করছেন ! আমি এও খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছি , যাদের কাব্যগ্রন্থ এইসব প্রকাশক প্রকাশ করেছেন, সেই সব মহান কবিদের কাছ থেকে গ্রন্থ প্রকাশের যাবতিয় অর্থ নিয়েছেন এবং এটাও ঠিক এদের কাব্যগ্রন্থের বিক্রয়ের দায় দায়িত্ব নাকি প্রকাশন দপ্তর নেবেন না , গোটা ব্যাপারটা কবিদের নিতে হবে !
ঠিক এই কারণেই বর্তমান বাংলা কাব্য সাহিত্য থেকে প্রকৃত কবিতার পাঠক মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে ! সত্যি কি চলছে দুনিয়ায় , যায় কোন প্রতিবাদ নেই। আমি খুবই স্ট্র্যাগল্ করে এই কবিতার জগতে এসেছি। আমাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে প্রচুর বইপত্র পড়তে হয়েছে এবং এখনো পড়ি । বর্তমানে ভারত ও বাংলাদেশের কবিতার প্রেক্ষাপট নিয়ে আলোচনা ও সুচিন্তিত সমালোচনা আমাদেরও করতে হয়, কিন্তু কখনো আমাদের কবিতা নিয়ে পন্ডিত মহল অর্থাৎ কবিতার সমালোচকরা কোন বিরুপ মন্তব্য করেছেন কিনা, এটা আমার জানা নেই ।
আমি আবার বলছি , আমি পাঠকের কাছে সমাদৃত হব বলে লিখি না , ৭০’ এর দীর্ঘায়িত সময় ধরে আমি আমার কঠিন শ্রম – নিষ্ঠা ও আন্তরিক একাগ্রতার সঙ্গে কবিতাকে ভালোবেসে লিখে চলেছি ….. থামবো কবে , বলতে পারছি না !
তবে এই জটিল মুহূর্তে অবক্ষয় সময়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে আমি সব সময়ই পজেটিভ চিন্তা করি ৷ আসলে কি , এই ছলচাতুরি , কপটতা , আর ভন্ডামি হয়ে উঠেছে রাজনৈতিক চতুর্যের অমোঘ নিয়তি ৷ সম্পাদক ও প্রকাশক রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় বেড়ে উঠেছে ! এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কেউ নেই ! এই বিস্তৃত প্রমাণ্যসূত্রিক আলোচনায় , এটাই সুস্পষ্ট হয় যে , রাষ্ট্রসন্ত্রাস, গণহত্যার বর্বরতা চলে এসেছে সেই আদ্যিকাল থেকে ! পৃথিবীর শিল্পী , কবি , সাহিত্যিক , চিত্রকর , ভাস্কর , শিক্ষক ও বুদ্ধিজিবি , এঁরা গান গেয়ে , কবিতা গল্প গল্প উপন্যাস প্রবন্ধ নিবন্ধ লিখে , ছবি এঁকে যুগ যুগ ধরে আপ্রাণ চেষ্টা করে আসছেন এই পৃথিবীটাকে দুষণমুক্ত করার ! সময়ের সাথে সাথে অনেক কিছুই পাল্টেছে , বদলেছে শয়তানের চেহারা ! ভদ্রতার মুখোশ এঁটে এটা চলিয়ে যাচ্ছে তান্ডাব ! আমরা যারা স্বপ্ন দেখি একটা সত্যি কারের মেঘমুক্ত আকাশ, একটা ফুল আর পাখির কাকুলিতে ঢাকা পৃথিবী ; সেই স্বপ্নকে কিছু ধান্দাবাজ শয়তান তাদের হিংসা ও সার্থপরতা দিয়ে ভেঙে খান খান করে দিচ্ছে ! এটার জন্য আমি বর্তমান রাজনিতিকে দায়ি করবো ৷ তবে এটা বেশি দিন চলতে পারে না , একটা সময় একদিন আসবে যখন আমাদের স্বপ্নগুলো একে একে বেঁচে উঠবে ! আর যারা এই পৃথিবীটাকে কব্জা করতে চেয়েছিল , তাদের অবস্থানগত পরিবর্তন হবেই হবে ! দেখে নেবেন ,—–
আমাদের মত কবিদের মাঝেমধ্যেই কবিতা না বোঝা পাঠকদের কাছে গালমন্দ খেতে হয় । তার কারণ , আমাদের কবিতাগুলি নাকি অতিমাত্রায় দুবোর্ধ্য !
আসলে কি দুর্বোধ্যতা পাঠকদের অজ্ঞতা বা অযোগ্যতা বলে আমি মনে করি ! কবি বিষ্ণু দে , সুভাষ মুখোপাধ্যায় , বিরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় , প্রেমেন্দ্র মিত্র , শঙ্খ ঘোষ , সুনীল , শক্তি , জয় গোস্বামী , সুবোধ সরকার”- দের এই অপবাদ শুনতে হয়েছে এবং মন্দার , সৃজাত আমাকেও শুনতে হয় ! আসলে কবিতা অনুধাবন করতে গেলে আগে ভিতরকার শিক্ষার প্রয়োজন ৷ এক কথায় পাঠকদের কবিতার শিক্ষার শিক্ষীত হতে হবে , তা না হলে আমাদের কবিতা পাঠকদের মাথার উপর দিয়ে চলে যাবে ! তবে এটা সত্যি , কবিতা বোঝার লোক খুবই কম ! হাতে গুনে বলা যায় ! যাই হোক , এরই মধ্যে সুদিন একদিন আসবেই আসবে ! এ আমার দৃঢ় বিশ্বাস ………
কবি পরিচিতি : [ বাংলা কাব্য সাহিত্যের অন্যতম জনপ্রিয় কবি ব্যক্তিত্ব বিদ্যুৎ ভৌমিক I জন্ম ১৬ ই জুন ১৯৬৪ ভারতের পশ্চিমবঙ্গের হুগলী জেলার শ্রীরামপুরের এক সম্ভ্রন্ত ও শিক্ষিত পরিবারে । প্রথম শ্রেণীর পত্র পত্রিকা , লিটল ম্যাগাজিন , কবিতা সংকলনে ৭০ দশক থেকে একমাত্র কবিতার সাধক । কবি বিদ্যুৎ ভৌমিক এর কবিতার মধ্যে এক ব্যাতিক্রমী সৃজন দর্শন পেয়ে আসছেন দু’ই বাংলার পাঠক I বেশ কয়েকটা কাব্যগ্রন্থ ইতিমধ্যে বাজারে এসেছে । তারমধ্যে উল্ল্যেখযোগ্য ১) কথা না রাখার কথা ২) নির্বাচিত কবিতা ৩) নীল কলম এবং একান্নটা চুমু ৪) গাছবৃষ্টি চোখের পাতা ভিজিয়ে ছিল …. ইত্যাদি । ২০২২ “সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সাহিত্য সম্মান” লাভ I সংবাদ এখন পত্রিকা থেকে ২০১৫ “বাংলা শ্রী” সম্মানিত । কবিতার লেখার পাশাপাশি কবি বিদ্যুৎ ভৌমিক একজন কলকাতার জনপ্রিয় বাচিক শিল্পী । বেতার ও দূরদর্শন সহ কলকাতার বিভিন্ন বেসরকারী টেলিভিশন চ্যানেল , you tube channel সহ মঞ্চের তিনি চেনা মুখ ও চেনা কন্ঠস্বর । সম্প্রতি 2023 California TV LIVE Show তে কবি বিদ্যুৎ ভৌমিক’কে শ্রেষ্ঠ কবি ও বাচিক শিল্পীর সম্মান প্রদান করা হয় । ]
______________________________________