মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার মাগুরছড়া মাঠে আদিবাসী খাসি (খাসিয়া) সম্প্রদায়ের ১২৫ তম বর্ষ বিদায় ও ১২৬ তম নতুন বছরকে বরণের ঐতিহ্যবাহী উৎসব ‘খাসি সেং কুটস্নেম’ নানান আয়োজনের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠিত হয়েছে।
চলতি মৌসুমে খাসিদের আয় ও জীবিকার প্রধান উৎস পানের চাষ ও ব্যবসায় মন্দার কারণে আর্থিক সংকট থাকায় “খাসি সেং কুটস্নেম” উৎসব এবার পালন না করার সিদ্ধান্ত ছিল। পরবর্তীতে প্রশাসনের সর্বাত্বক সহযোগিতার আশ্বাসে তাদের উৎসব অনুষ্ঠিত হয়েছে বলে খাসি সোশ্যাল কাউন্সিলের নেতৃবৃন্দ জানান।
শনিবার (২৩ নভেম্বর) সকাল থেকে মাগুরছড়া খাসিয়া পুঞ্জির খেলার মাঠে খাসি সোশ্যাল কাউন্সিলের আয়োজনে আদিবাসী খাসিদের ঐতিহ্যবাহী উৎসব ‘সেং কুটস্নেম’ দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত হয়েছে। উৎসবের নিরাপত্তায় সেনাবাহিনী, পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যদের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো।
বৃহত্তর সিলেট আদিবাসী ফোরামের কো-চেয়ারম্যান ও মাগুরছড়া খাসিয়া পুঞ্জি প্রধান জিডিসন প্রধান সুচিয়াং এর সভাপতিত্বে অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন মৌলভীবাজার জেলা পুলিশ সুপার এম কে এইচ জাহাঙ্গীর হোসেন পিপিএম, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মোঃ আব্দুস সালাম, এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট শাওন মজুমদার, কমলগঞ্জ উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) ডি এম সাদিক আল শাফিন, লাউয়াছড়া খাসিয়া পুঞ্জি প্রধান ও খাসি সোস্যাল কাউন্সিলের সাধারন সম্পাদক ফিলা পতমী, ডেবলছড়া পুঞ্জি প্রধান পিডিশন প্রধান, শ্রীমঙ্গল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আমিনুল ইসলাম, কমলগঞ্জ থানার ওসি(তদন্ত) শামীম আখঞ্জিসহ বিভিন্ন খাসি পুঞ্জি প্রধানগণ।
সরেজমিনে মাগুরছড়া খাসিয়া পুঞ্জির খেলার মাঠে দেখা যায়, খাসিয়া সম্প্রদায়ের ১২৫তম বর্ষ বিদায় ও ১২৬ তম নতুন বছরকে বরণের ঐতিহ্যবাহী উৎসব ‘খাসি সেং কুটস্নেম’ উপলক্ষে নানান রঙের পোশাক পরে খাসি ছেলে-মেয়েরা অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে নাচগান, খেলাধুলাসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে। মাঠের একপাশে খাসিদের বিভিন্ন পণ্য সামগ্রী, খাবার-দাবার নিয়ে মেলা বসে। মাঠের একপাশে সুপারি গাছ ও পাতাদিয়ে মঞ্চ তৈরি করা হয়েছে। তবে অন্যান্য বছরের তুলনায় এবছর আয়োজন ছিল কিছুটা কম।
খাসিয়ারা তাদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরে নাচেগানে নিজেদের সংস্কৃতি তুলে ধরেন। দিনব্যাপী উৎসবের আকর্ষনীয় আয়োজন ছিল বিভিন্ন প্রতিযোগিতার। এসবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য, খোয়াই ডখা(মাছ শিকার), কিউত্নেং(তৈলাক্ত বাশে উঠা), তীর ধনুক ও গুলতি ছোড়া প্রতিযোগিতাসহ বিভিন্ন ধরনের খেলাধুলা।
খাসি সোশ্যাল কাউন্সিল সুত্রে জানা যায়, ২০০৯ সাল থেকে প্রতিবছর ২৩ নভেম্বর কমলগঞ্জ উপজেলার মাগুরছড়া খাসিয়া পুঞ্জির খেলার মাঠে খাসি সম্প্রদায়ের বর্ষ বিদায় ও নতুন বছরকে বরণের অনুষ্ঠািত হয়। খাসিয়ারা তাদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক ও সাজসজ্জায় সেজে নেচে–গেয়ে নিজেদের সংস্কৃতি তুলে ধরেন।
‘সেং কুটস্নেম উৎসবের দিন সবাই মিলে ঐতিহ্যবাহী খেলাধুলা, নিজস্ব সাংস্কৃতিক পরিবেশনা, ঐতিহ্যবাহী খাবার খেয়ে আনন্দে নিজেদের সামাজিক সম্পর্ক সুদৃঢ় করেন। অনুষ্ঠানস্থলে পুরো মাঠ জুড়ে মেলা বসে। বিভিন্ন স্টলে খাসিয়ারা পোশাক, পান, তীর, ধনুক, বাঁশ-বেতের তৈরী জিনিসপত্রের পসরা সাজিয়ে বসেন। এই উৎসবে সিলেট বিভাগের প্রায় ৭০টি খাসিয়া পুঞ্জির মানুষ এসে অংশ নেন। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে পর্যটকেরাও এই অনুষ্ঠানে আসেন।
খাসি সোশ্যাল কাউন্সিলের সাধারণ সম্পাদক ফিলা পতমী জানান,, আমরা প্রতি বছর আমাদের বর্ষ বিদায় ও নতুন বছরকে বরণের অনুষ্ঠানটি করে আসছি। অনুষ্ঠানটি ঘিরে খাসি সম্প্রদায়ের সবাই একসাথে জমা হয়ে উৎসবে মেতে উঠি। আমাদের অর্থনৈতিক সংকটের কারণে অনুষ্ঠানটি আয়োজন থেকে বিরত ছিলাম। পরবর্তীতে প্রশাসনের সহযোগিতায় আমরা ‘সেং কুটস্নেম’ আয়োজন করি।’
খাসি সোশ্যাল কাউন্সিলের সভাপতি জিডিশন প্রধান সুছিয়াং বলেন,‘সিলেট বিভাগের প্রায় ৭০টি খাসিয়া পুঞ্জির মানুষ এই উৎসবে এসে অংশ গ্রহণ করেন । দেশ–বিদেশের পর্যটকেরাও এই অনুষ্ঠানে আসেন। খাসি সেং কুটস্নেম বা বর্ষ বিদায় খাসিয়াদের একটি সার্বজনীন উৎসব।’