রাজনীতি হচ্ছে মানব সেবার একটি বিশেষ মাধ্যম্, এই বিশেষ মাধ্যমটিকে যারা সঠিক ভাবে কাজে লাগিয়েছেন তারাই বিশ্বের বুকে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। বিশেষ করে বিশ্বের নীপিড়িত, হতদরিদ্র দেশগুলোর দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, যে সব দেশের নেতৃবর্গ তাদের দেশের জনগণকে নীপিড়ন, অত্যাচারের হাত থেকে উদ্ধার করার লক্ষ্যে নিজের জীবনের প্রতি তোয়াক্কা না করে বরং বছরের পর বছর জেল-জুলুম, স্বৈরশাসকদের অত্যাচার সহ্য করে শেষ পর্য্যন্ত তারা তাদের লক্ষ্যে পৌছাতে সক্ষম হয়েছেন। তারা সারা বিশ্বের নির্য্যাতিত মানুষের কাছে আজীবন অমর হয়ে আছেন এবং থাকবেন, যেমন আছেন দক্ষিণ আফ্রিকার নেলসন ম্যান্ডেলার মতো হাতে গুণা বিশ্বের কয়েকজন নেতা, তাদের মধ্যে বাংলাদেশের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একজন। যার কারণে আজ বাংলাদেশ একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাড়িয়ে আছে।
কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস, স্বাধীনতা পেয়েও তারা স্বাধীনতার সুফল ভোগ করতে পারছেন না, বিভিন্ন সময়ে দেশের শাসকদের কারণে। সত্যি কথা বলতে কি, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি বিভিন্ন সময়ে দেশ শাসন করেছে ঠিকই, কিন্তু দেশের মানুষ স্বাধীনতার সুফল ভোগ করতে পারেনি। তার একমাত্র কারণ, শাসকগোষ্ঠি দেশের মানুষের জন্য কল্যানকর কিছু করার বদলে বরং নিজেদের কল্যানের জন্য বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়তে দেখা গেছে। লক্ষ কোটি টাকা খরচ করে বাড়ি, গাড়ি, ব্যবসা বাণিজ্য গড়ে তোলে তারা কোটিপতির খাতায় নাম লিখিয়েছেন ঠিকই অথচ দেশের মানুষ যে তিমিরে ছিলো সেই তিমিরেই রয়ে গেছে।
বছরের পর বছর দেশের মানুষের পুঞ্জিভুত ক্ষোভেরই বহি:প্রকাশ ঘটে গত ৫ই আগষ্ট সোমবার ছাত্র-জনতার এক গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে। এই দিন বাংলাদেশের এক সময়ের লৌহ মানবী বলে খ্যাত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যিনি এক নাগারে দীর্ঘ ১৫ বছর রাজত্ব করে দেশকে বিশ্বের বুকে একটি শান্তিকামী, উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে পরিচিত করেছিলেন, কিন্তু শেষ পর্য্যন্ত তা টিকিয়ে রাখতে পারলেন না! এর পেছনে রয়েছে নানা ইতিহাস।
প্রথমেই হচ্ছে, প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার মন্ত্রী সভায় যাদের উপর অগাধ বিশ্বাস রেখে কাজ করে যাচ্ছিলেন, শেষ পর্য্যন্ত দেখা গেলো ”ম্যাডাম, সবকিছু ঠিক আছে” বলে এসব চাটুকারের দল শেখ হাসিনাকে অন্ধকারের মধ্যে রেখে, তারা অবৈধ ভাবে কোটি কোটি টাকা বিভিন্ন ভাবে আত্মসাৎ করে টাকার পাহাড় গড়ে তুলতে শুরু করলো। বিভিন্ন ভাবে বৈধ-অবৈধ কোম্পানীর নামে কোটি কোটি টাকা ব্যাঙ্ক থেকে লোন নিয়ে রিজার্ভ শুণ্য করে দেশকে দেউলিয়া করার পথে নিয়ে যাচ্ছিলো। এ অবস্থা থেকে উত্তরনের জন্য বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় আমরা লেখালেখি করেছি, সরকারকে হুঁশিয়ার করেছি সামনে ভয়ঙ্কর বিপদ আসছে, এসব লুটেরাদের বিরুদ্ধে সময় থাকতে ব্যবস্থা নিন। এতে সরকার কর্ণপাত করেনি, যার ফলে যা ঘটার তা তো ঘটেই গেলো!
ছাত্র-জনতার সময়োপযোগি এই আন্দোলনকে দেশবাসী স্বাগত জানিয়েছে। স্বাগত জানিয়েছে এই কারণেই, যখন দেশের মানুষ দেখেছে, দলীয় প্রভাবশালী লোকেরা মিথ্যা ব্যবসা-বানিজ্য, বিভিন্ন ধরণের বড় বড় প্রজেক্ট এর প্ল্যান ব্যাঙ্কে দাখিল করে শত শত কোটি টাকা ব্যাঙ্ক থেকে লোন নিয়ে কোটি কোটি টাকার মালিক হচ্ছে, অথচ ব্যাঙ্কগুলো হয়ে যাচ্ছে দেউলিয়া কিন্তু সরকারের তরফ থেকে কোন প্রতিকারের ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। এ কারণেই দেশের মানুষ ছাত্র-জনতার এই আন্দোলনের প্রতি একাত্মতা ঘোষণা করে তাদের মনের ক্ষোভ প্রকাশ করেছে।
জনগণের প্রত্যাশা, আগামীতে যে সরকারই ক্ষমতায় আসুক তাদের প্রধান কাজ হবে, এ সব দুর্নীতিবাজ প্রভাবশালী ব্যক্তিদের আইনের আওতায় এনে, তাদের কাছ থেকে টাকা উদ্ধার করে বাংলাদেশ ব্যাঙ্কে জমা করে রিজার্ভ বাড়ানো। নতুন সরকারের প্রধান কাজই হবে এসব দূর্নিতিবাজদের কঠোর শাস্তি প্রদান করা যাতে. ভবিষ্যতে যে সরকারই আসুক না কেন, তারা যেন এ পথে পা বাড়াবার সাহস না পায়। এ ভাবেই দেশের সংকটাপন্ন অথৃনৈতিক অবস্থাকে পুনরুদ্ধার করতে হবে।
দেশে অন্তর্বর্তিকালীন নতুন সরকার গঠন করা হয়েছে, যার প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন শান্তিতে নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনুস। এখন এই অন্তর্বর্তিকালীন সরকারের প্রধান কাজ হচ্ছে, দেশের সকল রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে নির্বাচনের তারিখ ঠিক করে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব একটি জনপ্রতিনিধিত্বমূলক সরকার গঠন করা। কেননা বর্তমানে দেশে আইন শৃঙ্খলা বলতে কিছু নেই। চুরি, ডাকাতি, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ থেকে শুরু বিভিন্ন ধরণের অনৈতিক কার্যকলাপে দেশ এখন বড় হুমকির মুখে দাঁড়িয়েছে। সুতরাং নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠন করে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে শক্ত হাতে এদের দমন করতে না পারলে অরাজকতা দিন দিন শুধু বাড়তেই থাকবে।
বর্তমানে রাজপথে একমাত্র বিএনপি ছাড়া কার্যকর কোন রাজনৈতিক দল বাংলাদেশে নেই। সুতরাং অন্যান্য যে রাজনৈতিক দলগুলো আছে, তাদের একত্রিত করে এই নির্বাচন অনুষ্ঠান ড. ইউনুসের জন্য একটি বিরাট চ্যালেঞ্জ বলে রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। এছাড়াও তাদের মতে, রাজনৈতিক দলগুলোতে রয়েছেন ভিন্ন মতাবলম্বি, রাজনীতিতে অভিজ্ঞ এবং অনভিজ্ঞ নেতৃবৃন্দ যাদের নির্বাচন সম্বন্ধে কোন জ্ঞান নেই। সুতরাং তাদেরকে বুঝিয়ে নির্বাচনে আনা হবে ভীষণ কষ্টকর।
তবে ইতিমধ্যেই নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রক্রিয়া শুরু করেছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মোহাম্মদ ইউনুস। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে নির্বাচন নিয়ে আলাপ আলোচনা তিনি শুরু করেছেন। প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ তাদের মতামত প্রকাশ করছেন। প্রত্যেকেই তাদের দলের পক্ষ থেকে বিভিন্ন ধরণের দাবি তুলে ধরছেন। এ দাবিগুলোর মধ্যে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে, নির্বাচনে জয়লাভ করে যে দল থেকেই প্রধানমন্ত্রী হোন না কেন, তিনি দুই টার্মের বেশি ক্ষমতায় থাকতে পারবেন না।
গত ১লা সেপ্টেম্বর আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে দেশব্যাপী তৃণমূল পর্যাায়ে ধারাবাহিক মতবিনিময় সভার অংশ হিসেবে কুমিল্লা ও ফরিদপুরে নেতাকর্মীদের উদ্দেশ্যে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছেন, বাংলাদেশে যাতে আর কেউ পরপর দুইবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী না হতে পারে, সেটা নিশ্চিত করতে বিএনপি সংবিধানে এমন ব্যবস্থা রাখতে চায়।
তিনি আরও বলেন, এতদিন শুধু আওয়ামী লীগ ছিল আমাদের প্রকাশ্য প্রতিপক্ষ। এখন ওরা ছাড়াও চারদিকে অসংখ্য অদৃশ্য প্রতিপক্ষ। এদের অবস্থান অন্ধকারে, এরা সর্বত্র। এই দৃশ্যমান ও অদৃশ্য প্রতিপক্ষ মোকাবিলায় আমাদের সতর্ক থাকতে হবে।
বিএনপি বলছে, আগামী ৬ মাসের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে। তাদের মতে, আগামী ৩ মাসের মধ্যেই দেশকে একটা স্থিতিশীণ পর্যায়ে নিয়ে নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব। নির্বাচন আর দেরী করা উচিৎ হবে না, দেশের মানুষ চায় দেশে একটা নির্বাচিত সরকার গঠন হোক।
নির্বাচনের তারিখ নিয়ে জামায়াতের আমীর ডা: মাওলানা শফিকুর রহমান বলেছেন, বর্তমানে দেশ একটা অস্থিতিশীল অবস্থার মধ্যে আছে সুতরাং অন্তর্বতির্বর্তীকালীন এই সরকারকে সবকিছু সংস্কার করে এবং গুছিয়ে এনে নির্বাচনের পরিবেশ তৈরী করে তারপর নির্বাচনের তারিখ ঠিক করা উচিৎ। এজন্য সরকারকে সময় দিতে হবে। তিনি আরও বলেন, সংস্কার ছাড়া নির্বাচন দিলে সেটা অর্থবহ হবে না।
অন্যদিকে ড. ইউনুস বলেছেন, ”এমন একটি সময়ে এসে দেশের দায়িত্ব নিয়েছি, যখন প্রায় সব ক্ষেত্রেই চরম বিশৃঙ্খলা। তাই নির্বাচন কমিশন, বিচার বিভাগ, জনপ্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও গণধ্যমে প্রয়োজনীয় সংস্কারের পর অন্তবর্তী সরকার একটি অবাধ, সুষ্ঠু এবং অংশগ্রহণমুলক নির্বাচনের আয়োজন করবে।”
৩ সেপ্টেম্বর প্রধান উপদেষ্টা ড. মোহাম্মদ ইউনুস বলেছেন, বর্তমান সরকার মুক্ত গণমাধ্যমে বিশ্বাস করে এবং দেশে একটি গতিশীল ও প্রাণবন্ত গণমাধ্যম দেখতে চায়। রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় দেশের শীর্ষস্থানীয় ২০ পত্রিকার সম্পাদকদের সঙ্গে এক মত বিনিময় সভায় তিনি এ কথা বলেন। এ ছাড়াও এই বৈঠকে এডিটরদের কাছে জানতে চান, নির্বাচনের তারিখ কবে নাগাদ দিলে ভাল হবে বলে তারা মনে করেন? এর উত্তরে বিভিন্নজন তাদের বক্তব্য দিয়েছেন। তাদের কেউ কেউ বলেছেন কম পক্ষে ২ বছর আবার কেউ বলেছেন ৩ বছর পর দেওয়া উচিৎ, কারন এর আগে দেশের সব ডিপার্টমেন্টগুলোকে সংস্কার করে নির্বাচনের পরিবেশ ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়।
রাজনৈতিক দলগুলো এবং পত্রিকার এডিটরদের নির্বাচন অনুষ্ঠানের তারিখ নিয়ে মতভেদ সৃষ্টি হয়েছে। এই মতভেদ কাটিয়ে প্রধান উপদেষ্টা ড. মো: ই্উনুস কি ভাবে এই সমস্যার সমাধান করে দেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচন উপহার দিবেন, তার উপরই নির্ভর করবে দেশের ভবিষ্যৎ।
লেখকঃ দেওয়ান ফয়সল, কলামিষ্ট, সিনিয়র সাংবাদিক ও সদস্য লন্ডন বাংলা প্রেসক্লাব।