বর্তমান বিশ্বে বিদেশের বিভিন্ন দেশে দক্ষ শ্রমিক, কর্মী, শিক্ষার্থী, বিভিন্ন গবেষণায় নিয়োজিত কাজে প্রায় দুই কোটিরও বেশি বাংলাদেশী রয়েছেন। তারা সেখানে নিজেদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করে নিজের এবং অনেকে পরিবার নিয়ে রয়েছেন। দেশের জন্য তাদের আয়ের কিছু অংশ পাঠাচ্ছেন।
কয়েকটি দেশে ইতোমধ্যে বেশ কিছু বাঙালী পরিবার স্থায়ী ভাবে বসবাস করা শুরু করেছেন। এমন কি তাদের সন্তানাদিও সে দেশে জন্মগ্রহন করেছে, জন্মসূত্রে সে দেশের নাগরিক হয়ে গেছে। তবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশীদের যাবার ইতিহাস অনেক আগের।
অনিসন্ধিৎসু সাংবাদিক এবং লেখক দেওয়ান ফয়সল তার গবেষণায় আজ থেকে প্রায় শতবর্ষ আগে এই বাংলার মানুষ প্রথম কখন বিদেশে যায় তা খুঁজতে শুরু করেন। তাঁর হিসেবে ১৯৩৪ সালের জুন মাসে মৌলভী বাজার জেলার তিনজন মানুষ জাহাজে কাজ নিয়ে কোলকাতা সমুদ্র বন্দর দিয়ে বিদেশে পাড়ি জমায় সে ইতিহাস তিনি খুঁজে পান। তিনি এদের জাহাজে কাজ নিয়ে এবং মহাসাগরের উত্তাল ঢেউ ও ঝড়ের ভেতর দিয়ে বিপজ্জনক যাত্রার মধ্য দিয়ে যাত্রা শুরু করে প্রায় তিন বছর পর সাউথ ওয়েলসের কার্ডিফ সমুদ্র বন্দরে পৌঁছানোর ইতিহাস খুঁজে পান। সে সময় এ বন্দরই ছিল যুক্তরাজ্যে একটি অন্যতম প্রধান বন্দর।
এ বন্দরে নেমে সেই যে তারা সে পাহাড়ি অঞ্চলে প্রবেশ করেন, পথ হারিয়ে ফেলে অন্য এলাকায় চলে যান। পথ হারিয়ে ফেলার কারণে আর জাহাজে ফিরে আসতে পারেননি এজন্য সেখানেই স্থানীয়দের বাড়ির কোন ঘরে বসবাস শুরু করেন এবং সেখানেই থেকে যান। এভাবে লন্ডনে বাঙলীদের বসতি শুরু হয়।
এতো আদ্যোপান্থ সংগ্রহ খুব সহজ ছিল না। এখান থেকেই লেখক দেওয়ান ফয়সল তার এই বইটির লেখা শুরু করেছেন্। ১১ ফ্রন্টে বাংলায় মুদ্রিত বইটির পৃষ্ঠাসংখ্যা ১৭৩ এবং যুক্তরাজ্য থেকে প্রকাশিত মুষ্টিমেয় বইগুলোর মধ্যে এটি অন্যতম।
প্রখ্যাত সাংবাদিক লেখক আব্দুল গাফফার চৌধুরীর সম্পাদনায় লন্ডন থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক নতুন দিন পত্রিকায় দেওয়ান ফসল প্রায় ১৫ বছর কাজ করেছেন।॥তারপর কর্মজীবনের কারণে সাউথ ওয়েলসে চলে যান।
ওয়েলসের ৮,১৯২ বর্গমাইল এলাকার অতীত ইতিহাস থেকে বর্তমান অবস্থানে বাংলাদেশ, বাঙালীরা এবং নতুন প্রজন্ম কেমনভাবে আছেন, সেটিই দীর্ঘ অনুসন্ধান করে বইটি লিখেছেন। শুধু তাই নয়, এই ওয়েলস অঞ্চলে কেমন করে বাংলা স্কুল গড়ে ওঠে, বাঙালীরা ওয়েলস তথা বৃটেনের রাজনীতিতে কেমন করে ক্রমান্বয়ে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করে নেন অন্যান্য দেশ থেকে আগত নাগরিকদের মতো, এখানে কাদের সহযোগিতায় বড় বড় মসজিদ গড়ে ওঠে, বাংলা টিভিগুলো কাজ শুরু করে , কারা ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সহায্য সহযোগিতার ফান্ড গড়ে তোলার দায়িত্ব পালন, ভাষা শহীদদের স্মরণে শহীদ মিনার নির্মাণ , কার্ডিফ ক্যাসেলে কমনওয়েলথভুক্ত ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন জোটভুক্ত দেশগুলোর সাথে বাংলাদেশের পতাকা স্থায়ীভাবে উত্তোলনের কাঠখড় পোড়ানোর কাজ কারা কারা করেন এবং কীভাবে করেন তুলে ধরেছেন তার সুদীর্ঘ ইতিহাস।
তদুপরি তিনি তার বইয়ে বাঙালীরা কেমন ভাবে ব্যবসা শুরু করেন, গ্রেটার সিলেট কাউন্সিল গঠন, কিভাবে বাংলাদেশী চেম্বার অব কমার্স সহ অনেক প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি লাভ করে, সেগুলোর সুবিন্যাস্ত ইতিহাস তুলে ধরেছেন তারা এই বইটিতে। এছাড়াও চারদিকে সাগরবেষ্টিত পাহাড়ের বুকে মালভুমি অঞ্চল এই ওয়েলসে বিভিন্ন এলাকার রয়েছে মনোজ্ঞ বর্ণনা। এই বনভুমি ও মালভূমি এলাকায় বাংলাদেশের শাকশব্জি ও অন্যান্য ফলফলাদি উৎপাদন করার ইতিহাসও রয়েছে।
এভাবে দেওয়ান ফয়সল বিলেতের এই ওয়েলসে একটি ছোট্ট বাংলাদেশের মানচিত্র গেঁথেছেন যার মাধ্যমে সেখানকার নতুন প্রজন্মের বাঙালীরা জানতে পারবে এবং বাংলাদেশকে চিনতে পারবে। বাঙালী জাতি কোন নি:স্ব জাতি নয়। তাদের ঐতিহ্য – সংস্কৃতি রয়েছে, তাদের জাতিসত্তা রয়েছে। যে কোন দেশেই জন্ম নিক না কেন, তারা যদি নিজেদের বাঙালী বলে পরিচয় দেয় তাহলে তারা বিশ্বে অপাঙেক্তয় হবে না।
তার এই বই দৃঢ়তার সাথে সেই ইতিহাসই তুলে ধরে। বিশাল এবং বহুবিস্তৃত এ বইয়ের বিষয়াবলী এতো স্বল্প পরিসরে তুলে ধরা বেশ শক্ত। পাঠকের কাছে তা আদৃত হবে।
বইটি লন্ডনে ছাপা হলেও প্রচ্ছদ, ভেতরের ছবি ও মুদ্রণ অনেক ভাল।
যুক্তরাজ্যের বাঙালিদের ইতিহাস সম্পর্কে জানতে বইটি পড়তে পারেন।
বইটির নাম রুপসী ওয়েলসের কোলে ছোট্ট এক বাংলাদেশ/লেখক দেওয়ান ফয়সল, প্রকাশকাল আগষ্ট, ২০২৩, মুদ্রণ স্পেকট্রাম প্রিন্টিং, ফোরশোর রোড, কার্ডিফ, ওয়েলস, ইউকে/ মূল্য ১০ পাউন্ড।