গত সপ্তাহের জনমত পত্রিকার প্রথম পাতায় প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, শুধু মাত্র যুক্তরাজ্য কিংবা ইউরোপ নয়, গোটা বিশ্বের অর্থনীতিতেই চলেছে মন্দার অভিঘাত। মঙ্গলবার ’ওয়ার্ল্ড ইকনমিক আউটলুক’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল (আইএমএফ) পূর্বাভাস দিয়ে বলেছে, ’২০২৩ সালে একটি মারাত্মক মন্দার মুখোমুখি হতে পারে বিশ্ব অর্থনীতি।’ মহামারী পরবর্তী সময় থেকেই মন্দার চাপে রয়েছে বিশ্ব অর্থনীতি। কিন্তু এই মন্দার অভিঘাত কতটা দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে তা নিয়ে মতভেদ রয়েছে অর্থনীতিবিদদের।
আইএমএফ-এর এই সতর্ক বাণীতে বিশ্ববাসী কম-বেশি আতঙ্কিত। কাজেই বিশ্বের প্রতিটি দেশই যদি এখন থেকে তাদের দেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার পদক্ষেপ গ্রহণ না করতে পারে, তাহলে আগামী দিনের এই ভয়াবহ অবস্থা থেকে রক্ষা পাওয়া কঠিন। সারা বিশ্বে বর্তমানে অর্থনীতির যে দুরবস্থা পরিলক্ষিত হচ্ছে, আইএমএফ-এর ভবিষ্যতের পূর্বাভাস তারই ইঙ্গিত বহন করে।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার দূরদর্শী চিন্তাধারার মাধ্যমে করোনা মহামারী শেষ হওয়ার পর সারা বিশ্ব যে একটি ভয়াবহ অবস্থার সম্মুখীন হবে তা উপলব্ধী করেই তিনি তাঁর নিজের দেশকে কি ভাবে এর প্রভাব থেকে বাঁচিয়ে রাখা যায় তারই প্রস্তুতি গ্রহণ করেছেন।
তাঁর মতে কৃষি প্রধান আমাদের বাংলাদেশকে যদি খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করে তোলা যায়, তাহলে মন্দার ধকল থেকে দেশের মানুষকে বাঁচানো যাবে। বিশেষ করে ঘরে যদি খাবার আর পরনে যদি কাপড় থাকে তাহলে মানুষ না খেয়ে মরবে না, উলঙ্গ থাকবে না। দেশের মানুষের সাধারণত: একটাই দাবি, খেয়ে পরে বেঁচে থাকার দাবি।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগে ভাগেই দেশের মানুষকে বাঁচিয়ে রাখার তাগিদে ঘোষণা দিয়েছেন, দেশের এক ইঞ্চি জমিও যেন অনাবাদী না থাকে সে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট প্রশাসনকে নির্দেশ দিয়েছেন এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থাও নেয়া হচ্ছে। সরকার ভুর্তুকি দিয়ে কৃষিপণ্যের উৎপাদ বৃদ্ধির উদ্যোগ নিয়েছে।
কৃষকদের সার, উন্নমানের ধানের বীজ ইত্যাদি বিতরণ করে তাদের উৎসাহিত করছে। সেই সঙ্গে শাক সব্জি বেশি করে ফলানোরও তাগিদ দেয়া হচ্ছে এবং জনগণ তা করছেও। আমার মতে, যেহেতু বাংলাদেশ একটি কৃষি প্রধান দেশ, সে হেতু কুষি বিপ্লবের স্বার্থক বাস্তবায়নই বাংলাদেশকে একটি সুখি সমৃদ্ধশালী দেশ হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব।
অতীতে আমরা দেখেছি, দেশের বিভিন্ন জায়গার সাথে যোগাযোগ ব্যবস্থা না থাকার কারণে এক এলাকার উৎপাদিত পণ্য অন্য এলাকায় সময় মতো পৌছানো যেতো না, যার ফলে অনেক পণ্যই কিছুদিন গুদামে রাখার পর নষ্ট হয়ে যেতো, কৃষকরা আর্থিক ক্ষতির সম্মুখিন হতেন। এলাকায় যা কিছু বিক্রি হতো তাও আবার উৎপাদন মূল্য থেকে অনেক কম দামে বিক্রি করতে হতো, এ ছাড়া তাদের আর কোন উপায় ছিলো না।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মাষ্টারপ্ল্যান অনুযায়ী তিনি দেশে যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নয়নের লক্ষ্যে বিরাট পদক্ষেপ নেন। তারই ফলশ্রুতিতে, আজ পদ্মা সেতু নির্মাণ করে যেমন উত্তর এবং দক্ষিণাঞ্চলের সাথে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন সাধন করেছে, তেমনি দেশের বড় বড় নদীগুলো সহ গত সপ্তাহে সিলেট সহ বিভিন্ন জেলায় ১০০টি সেতু উদ্বোধনের মাধ্যমে যোগাযোগ ব্যবস্থা বাংলাদেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে বিস্তার লাভ করেছে।
কাজেই এখন প্রত্যেকটি জেলার জনগণের যাতায়াত ব্যবস্থা সহজতর হওয়ার ফলে একদিকে যেমন এক জেলা থেকে অন্য জেলায় যেতে সময় বাঁচবে, অন্যদিকে খরচও বাচবে। তাদের উৎপাদিত কৃষিপণ্য আর এলাকা ভিত্তিক বিক্রি করতে হবে না, এখন তারা অতি অল্প সময়ে এক জেলা থেকে অন্য জেলায় নিয়ে বিক্রি করতে পারবে।
কৃষকরা তাদের উৎপাদিত কৃষি পণ্যের ন্যায্যমুল্য পাবেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এই মাষ্টারপ্ল্যানকে ’সেতু বিপ্লব’ হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়। বাংলাদেশের মতো নদী মাতৃক দেশে ’কৃষি বিপ্লব’ সফল করতে হলে ’সেতু বিপ্লব’ এর বিকল্প নেই। সুতরাং এ কথা নি:সন্দেহে বলা যায়, প্রধানমন্ত্রীর মাষ্টারপ্ল্যান সঠিক এবং সময়োপযোগী একটি পদক্ষেপ।
এই কঠিন সময়ে বিশ্বব্যাংকের প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বাংলাদেশের জন্য ’কৃষি বিপ্লব’ যে স্বার্থকতা লাভ করছে তারই একটি উৎকৃষ্ট প্রমান।
এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমান বৈশ্বিক পেক্ষাপটে বিশ্বের প্রায় সব দেশেই খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে ঝুঁকির মাত্রা ভয়ানক ভাবে বাড়লেও খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে ঝুঁকিতে নেই বাংলাদেশ।’ খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ থেকে চাল রপ্তানি বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।
গত ২৯ শে জুন থেকে এ সিদ্ধান্ত কার্যকর হয়েছে। ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত তা বহাল থাকবে। সারা বিশ্বে খাদ্য সংকট থাকলেও এই মুহুর্তে বাংলাদেশ অনেকটাই স্বস্তিতে রয়েছে। খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে কোনো ধরণের হুমকি নেই। যে কোনো ধরণের খাদ্য সংকট এড়াতে বাংলাদেশ অনেকটাই প্রস্তুত।
এছাড়াও বাংলাদেশ তার অসাধারণ উন্নয়নের মাধ্যমে গোটা বিশ্বকে চমকে দিয়েছে উল্লেখ করেছেন বিশ্বব্যাংকের দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলের ভাইস প্রেসিডেন্ট মার্টিন রাইজার। তিনি একে ”উন্নয়নের একটি সফল ঘটনা হিসেবে’ বর্ণনা করেন।
রাইজার বলেন, বাংলাদেশ উন্নয়নের একটি সফল ক্ষেত্র এবং একটি অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক অর্জন। বাংলাদেশ তার উন্নয়নের মাধ্যমে চমক সৃষ্টিকারী দেশগুলোর মধ্যে একটি হয়ে উঠছে। গত সোমবার প্রধানমন্ত্রীর কার্য্যলয়ে শেখ হাসিনার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎকালে তিনি এ মন্তব্য করেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ যে দিন দিন উন্নয়নের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, বিশ্বনেতারাও আজ অকপটে তা স্বীকার করছেন। অথচ বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিরোধী রাজনৈতিক একটি মহল দেশের উন্নয়নে যেন তাদের গায়ে জ্বালাপোড়া শুরু হয়েছে।রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বব্যাপী যে নানামুখী সংকটের সম্মুখীন হয়েছে, সে সব অভিযোগগুলো আজ শুধু বাংলাদেশে নয়, সারা বিশ্বের মানুষের।
গত ১৫ই নভেম্বর ইন্দোনেশিয়ার বালিতে অনুষ্ঠিত দু’দিন ব্যাপী জি২০ দেশগুলোর অধিকাংশ নেতা এই যুদ্ধ বন্ধ করার জন্য জোরালো আহ্বান জানিয়েছেন। তারা বলেছেন, ৮ মাসেরও বেশি সময় ধরে এই যুদ্ধ চলছে। এতে বিশ্বের অর্থনীতি টালমাটাল হয়ে পড়ছে। ভু-রাজনৈতিক টালমাটাল অবস্থা, ডুবতে বসা বিশ্ব অর্থনীতি, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, খাদ্য নিরাপত্তার হুমকি, জ্বালানী আর অর্থনৈতিক সংকটের চরম মূহুর্তে বিশ্বনেতারা মিলিত হয়েছেন এবং এই যুদ্ধ বন্ধ করার জন্য রাশিয়া এবং ইউক্রেনের উপর চাপ সৃষ্টি করেছেন।
সারা বিশ্ব আজ যে অবস্থার সম্মুখীন হয়েছে তার চেয়ে বরং আমাদের দেশ অনেক ভালই আছে। এই ভালো থাকার অবস্থা দেখেই বাংলাদেশের স্বাধীন-বিরোধী চক্রটি তা সহ্য করতে পারছেনা।
তাই তারা উপরের বিষয়গুলো তুলে ধরেই আন্দোলন শুরু করেছে। তাদের উদ্দেশ্য, দেশে একটা অরাজকতা সৃষ্টি করে উন্নয়নের কাজে বাধা সৃষ্টি করা, বিভিন্ন অপপ্রচার চালিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলা।
কিন্তু তাদের এই চেষ্টা যে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে সেটা তাদের বুঝার এখনও সময় আছে। তবে তারা যা-ই করুক না কেন, বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, তারা আন্দোলন করছে এবং তারা নিজেরাও জানে এই আন্দোলন সফল হবেনা তবুও একটা ইস্যু নিয়ে আন্দোলন শুরু করে তাদের অনুসারীদের জানান দেয়া যে,’ আমরা মাঠে আছি, তোমরা মন ভেঙো না।’ অর্থাৎ দলকে টিকিয়ে রাখার স্বার্থেই তাদের এই অপচেষ্টা। আর এ কারণেই তারা একদিকে আন্দোলন শুরু করেছে, অন্যদিকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার জন্য প্রস্তুতিও নিচ্ছে।
জানা গেছে, তারেক জিয়া লন্ডন থেকে বাংলাদেশের বিভিন্ন নির্বাচনী এলাকাতে তাদের সংগঠনের নেতাকর্মীদের নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করার জন্য প্রস্তুতি নিতে তাগিদ দিচ্ছেন।
অভিজ্ঞ মহলের মতে, বিএনপি-জামায়াত গোষ্ঠি যদি আন্দোলনের ভুল পথে না গিয়ে বরং সরকারের সাথে আলোচনায় বসে একটা আপোসরফা করে সুন্দর ভাবে নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করতো, তাহলে আগামী দিনের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ তাদের জন্য উজ্বল হতো। তাদের এই ভুল সিদ্ধান্তের খেসরাত দলের নেতাকর্মীদের কাছে অচিরেই দিতে হবে।
লেখকঃ কলামিষ্ট, সিনিয়র সাংবাদিক ও সিনিয়র সদস্য লন্ডন বাংলা প্রেস ক্লাব.