নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার কায়েতপাড়া ইউনিয়নের চনপাড়া পুনর্বাসন কেন্দ্রটি এখন মাদকের হাট। এখানে হাত বাড়ালেই মেলে মাদক। সন্ধ্যা নামতেই এই মাদকের হাটে রাজধানীসহ এর আশপাশের বিভিন্ন এলাকা থেকে শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন পেশার বিপুল সংখ্যক মানুষ মোটরসাইকেল, প্রাইভেট কার ও সিএনজি অটোরিকশাযোগে সেখানে যায়। অনেকে সেবনের পাশাপাশি বহনও করে মাদক।
প্রশাসনের নাকের ডগায় প্রকাশ্যে বসা এই মাদকের হাটে নারী-পুরুষসহ দুই শতাধিক ডিলার রয়েছেন। পুলিশের একশ্রেণির কর্মকর্তা নিয়মিত মাসোহারা পান। অনেকে মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে সেখানে পোস্টিং নেন। চনপাড়া পুনর্বাসন কেন্দ্রটি এখন পেশাদার কিলারসহ বিভিন্ন অপরাধীদের নিরাপদ আশ্রয়স্থলও। এসব ডিলাররা ভাড়ায় খুনসহ সব ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এক দিক দিয়ে অভিযান চালালে অপর দিক থেকে তারা পালিয়ে যায়। এটা অনেকটা চোর-পুলিশ খেলার মতো।
আমাদের প্রতিনিধি সরেজমিন চনপাড়া পুনর্বাসন কেন্দ্রে গেলে সেখানে বসবাসরত নিরীহ দিনমজুর ও ঠেলাগাড়ি চালকরা বলেন, যারা মাদক ব্যবসায়ী ও অপরাধীদের ধরবে তারা তো নিয়মিত মোটা অঙ্কের টাকা পান। খুনিদের সঙ্গে বসে প্রায়ই তাদের আড্ডা দিতেও দেখা যায়। জেলা প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসন মাদকব্যবসা বন্ধ করতে ও খুনিদের ধরতে চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে।
গত বৃহস্পতিবার দুপুরে মাদক উদ্ধারের জন্য ঐ এলাকায় অভিযানে গেলে র্যাবের সঙ্গে মাদক কারবারিদের গুলি বিনিময় হয়। এ সময় শাহীনুর রহমান ওরফে সিটি শাহীন নামে এক জন নিহত হয়। তার নিহত হওয়ার ঘটনায় এলাকাবাসীর মধ্যে স্বস্তি ফিরে আসে।
নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার কায়েতপাড়া ইউনিয়নের চনপাড়া পুনর্বাসন কেন্দ্র এখন মাদক ও অপরাধীদের স্বর্গরাজ্য। হত্যা, মাদক, অপহরণ, চাঁদাবাজি, অজ্ঞান-মলম পার্টি, পকেটমার, ধর্ষণসহ বিভিন্ন অপরাধে এখানকার মানুষ জড়িত রয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। পুনর্বাসন কেন্দ্রের অলি-গলিতে ইয়াবা, হেরোইন, ফেনসিডিল, গাঁজাসহ মাদক প্রকাশ্যেই এখন কেনাবেচা হয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছে। কিন্তু মাদক বেচাকেনা বন্ধ হয়নি। প্রকাশ্যে বিক্রি হচ্ছে।
নাম না প্রকাশের শর্তে এলাকাবাসী জানায়, চনপাড়া পুনর্বাসন কেন্দ্রে দুই শতাধিক মাদকের ডিলার রয়েছে। প্রতিদিন সন্ধ্যায় বস্তিতে মাদকের হাট বসে। পুলিশ, মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরসহ প্রশাসনের নিয়োজিত এক ধরনের প্রতিনিধিরা মাসোহারা গ্রহণ করেন। ঢাকা জেলার ডেমরা থানার বালু নদ পার হলেই চনপাড়া পুনর্বাসন কেন্দ্র। তাই সহজেই রাজধানীর মাদকসেবীরা এখানে চলে আসতে পারে। নারায়ণগঞ্জের সদর, সিদ্ধিরগঞ্জ, ঢাকার ডেমরা, রামপুরা, যাত্রাবাড়ী, সবুজবাগ থানাসহ বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ এখানে মাদক সেবন করতে আসে। দিন দিন মাদকের ব্যবসা ও সেবনের প্রসার ঘটছে। মাদকের ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ নিয়ে প্রায়ই সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে। ঘটছে হত্যাকাণ্ডের ঘটনাও। সুবিধাভোগী একশ্রেণির পুলিশের কারণে থানাপুলিশ মাদকব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। অধিকাংশ সময়ই অভিযানের খবর আগেই মাদক কারবারিরা জেনে নিরাপদে চলে যায়। তাতে পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগবিহীন ও ছোট মাদক কারবারিরা গ্রেফতার হয়।
এছাড়া পুলিশ, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের একশ্রেণির কর্মকর্তা, রাজনৈতিক নেতা, সাংবাদিকসহ স্থানীয় প্রভাবশালীরা মাদকের নিয়মিত মাসোহারা পায় বলেও এলাকাবাসী অভিযোগ করেন। সন্ধ্যা থেকে রাত পর্যন্ত মাদক বেচাকেনা চলে। চনপাড়া আসা-যাওয়ার অনেক পথ রয়েছে। তাই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অভিযানের জন্য যে পথ দিয়ে প্রবেশ করে, অন্য পথ দিয়ে তারা সহজে পালিয়ে যায়। মাদক ও সন্ত্রাসীদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে এখানকার বাসিন্দা দিনমজুর, ঠেলাগাড়িচালক, রিকশাচালক, ফেরিওয়ালা, গার্মেন্টস শ্রমিকসহ নিরীহ সাধারণ মানুষ।
পুলিশ ও এলাকাবাসীর সূত্রে জানা গেছে, চনপাড়া পুনর্বাসন কেন্দ্রের মিজু, রাশিদা, শাহিনা, রিনা, বিলকিছ, ইয়াছমিন, রওশন, রহিমুন, মোশারফ, ইউসুফ, আক্তার হোসেন, সাহাবউদ্দিন, খোরশেদ আলম, সাইফুল, মোস্তফা, বাবু, হাসান, কহিনুর আক্তার, শাওন, নাছিমা, বাকী, জামাল উদ্দিন, আরব হোসেন, পারভীন, খোকা, আলী নুর, রোমেন, ইকবালসহ দুই শতাধিক ব্যক্তি মাদকের কারবারি। অবাধে তারা মাদক ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে।
চনপাড়া পুনর্বাসন কেন্দ্রে বসবাসকারী সন্ত্রাসীরা রাজধানীসহ বিভিন্ন স্থানে ভাড়ায় খুনসহ বিভিন্ন অপরাধ কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে আসছে। চনপাড়া পুনর্বাসন কেন্দ্রকে ৯টি ওয়ার্ডে ভাগ করা হয়েছে। এই বস্তি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে নিহত সিটি শাহীনের গ্রুপসহ সাতটি গ্রুপ। কায়েতপাড়া ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ড হলো চনপাড়া পুনর্বাসন কেন্দ্র।
রূপগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য, শেখ রাসেলনগর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও কায়েতপাড়া ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য বজলুর রহমান গত তিন বারের জনপ্রতিনিধি। এলাকাবাসীর অভিযোগ, তিনিই এখানে সব কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ করেন। বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে নিয়ন্ত্রণ করত তাদের স্থানীয় দলীয় নেতারা।
এখানে অপরাধীদের রাজনৈতিক কোনো পরিচয় নেই। যখন যে সরকার ক্ষমতায় এসেছে, সেই দলের কর্মী সেজে মাদকব্যবসাসহ সব অপরাধ নিরাপদে চালানোর একটি কৌশল বলে এলাকাবাসী জানান। ক্ষমতাসীনদের নিয়মিত মাসোহারা দিয়ে আসছে মাদক ব্যবসায়ীরা। একইভাবে ভাগ পাচ্ছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। পাচ্ছে মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের একশ্রেণির কর্মকর্তারাও।
এলাকাবাসীর দাবি, যারা নিয়ন্ত্রণ করবে, নেপথ্যে তারাই মাদকের হাট পরিচালনা করছে। জড়িত কর্মকর্তারা এক বছরে বাড়িগাড়ির মালিক হয়ে যান। এই এলাকায় পোস্টিং নিয়ে আসতে প্রশাসনকে মোটা অঙ্কের টাকা ঘুষ দিতে হয়। এমনকি কোনো কোনো কর্মকর্তা প্রকাশ্যে বলেন, ‘অনেক টাকা ঘুষ দিয়ে এসেছি, সেই টাকা তো তুলতে হবে।’ বজলুর রহমান বলেন,‘ নির্বাচনে আমার সঙ্গে পরাজিত হয়ে ও আওয়ামী লীগের বিরোধীরা আমার নামে অপপ্রচার করে থাকেন। অন্যায় ও অনিয়ম করলে ভোটাররা গোপন ভোটে আমাকেই নির্বাচিত করতেন না। আমি কোনো অবৈধ কর্মকাণ্ডে জড়িত নই। ’
জানা গেছে, চনপাড়া পুনর্বাসন কেন্দ্রের দুই গ্রুপের দুই জন নেতা ছিলেন তাদের এক জন জয়নাল আবেদীন বর্তমানে কারাগারে। এর আগে অপর নেতা আনোয়ার হোসেনও প্রতিপক্ষের হামলায় নিহত হন। অপর দুই গ্রুপের নেতা ছাদ্দাম হোসেন ও রাজা মিয়া নিরাপদে আশ্রয় নেন। পুলিশের তথ্যানুযায়ী, গত ৪৪ বছরে এখানে ২৩টি খুনের ঘটনা ঘটেছে। তবে বাসিন্দাদের মতে, এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা দ্বিগুণ হবে। হত্যা মামলার আসামিরা এতই ভয়ংকর যে তাদের বিরুদ্ধে কেউ সাক্ষী দেওয়ার সাহস পাচ্ছে না। তাই সাক্ষীর অভাবে হত্যা মামলাগুলোর বিচার হচ্ছে না।
নিহত সিটি শাহীনের স্ত্রী ইতি আক্তার বলেন, শাহীন চনপাড়া ইউনিয়ন স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও মাদক নির্মূল কমিটির সদস্য সচিব ছিলেন। এলাকাবাসী বলেন, দলীয় পরিচয় নিয়ে শাহীন মাদকের বেশির ভাগ এলাকা নিয়ন্ত্রণ করত। তার বিরুদ্ধে খুনসহ ২৩টি মামলা রয়েছে। সে একজন পেশাদার কিলার। সে কোনো দলীয় লোক না।
রূপগঞ্জ থানার ওসি এ এফ এম সায়েদ বলেন, চনপাড়ায় মাদক আছে। তবে পুলিশের অভিযান চলমান। পুলিশের একটি টিম প্রতিদিন সেখানে অভিযান পরিচালনা করছে। এলাকাটি ঘিঞ্জি হওয়ায় পুলিশ অভিযান চালানোর আগেই মাদক কারবারিরা পালিয়ে যায়। রূপগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার ফয়সাল হক বলেন, চনপাড়া মাদকের অভয়ারণ্য হলেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতায় সেখানে শান্তি ফিরে আসছে।
নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. আমির খসরু বলেন, চনপাড়া পুনর্বাসন কেন্দ্রে জয়নাল আবেদীন ও সিটি শাহীনের মধ্যে সৃষ্ট সংঘর্ষে আহত হয়ে কিছুদিন আগে চনপাড়া ৯ নম্বর ওয়ার্ডের বুলু মিয়ার ছেলে সজল ঢাকা মেডিক্যাল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায়। এ মামলায় এজাহার নামীয় সাত আসামিকে পুলিশ গ্রেফতার করে। পুলিশ চনপাড়া পুনর্বাসন কেন্দ্রের অপরাধকর্মকাণ্ড নির্মূলে সবসময়ই তৎপর।
ইউকেবিডিটিভি/ বিডি / এমএসএম