দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী তালিকায় বাদ পড়েছেন হবিগঞ্জ-১ (নবীগঞ্জ-বাহুবল) আসনে সাবেক মন্ত্রী দেওয়ান ফরিদ গাজীর ছেলে এলাকায় ‘ধার্মিক ও স্বচ্ছ ইমেজ’ খ্যাত গাজী মোহাম্মদ শাহনওয়াজ মিলাদ। তার বদলে এবার মনোনয়ন পেয়েছেন হবিগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি ও বর্তমান জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ডা. মুশফিক হুসেন চৌধুরী। আর হবিগঞ্জ-২ (আজমিরীগঞ্জ-বানিয়াচং) আসনে বাদ পড়েছেন জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও টানা তিনবারের সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট আব্দুল মজিদ খান। তার পরিবর্তে মনোনয়ন পেয়েছেন জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য মরহুম শরীফ উদ্দিন আহমেদের ছেলে জেলা আওয়ামী লীগের আইন সম্পাদক অ্যাডভোকেট ময়েজ উদ্দিন শরীফ রুয়েল।
এ দুটি আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী বদলের পরপরই জেলাজুড়ে শুরু হয়েছে আলোচনা-সমালোচনা। এলাকায় ‘স্বচ্ছ ইমেজ’ খ্যাত প্রার্থী মোহাম্মদ শাহ নওয়াজ মিলাদ গাজী ও হেভিওয়েট প্রার্থী এডভোকেট আব্দুল মজিদ খান বাদ পরার কারণ নিয়ে এলাকার ভোটাররা করছেন চুল ছেড়া বিশ্লেষন। হাটবাজার ও চায়ের স্টল সর্বত্র আলোচনা কেন তারা বাদ পড়লেন ?
এলাকার সাধারণ ভোটার ও দলীয় নেতা-কর্মীদের মতে জেলা আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ পদে না থাকা সত্বেও মরহুমদ পিতা দেওয়ান ফরিদ গাজীর পরিচয়ে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাহুবল-নবীগঞ্জ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছিলেন মোহাম্মদ শাহ নওয়াজ গাজী মিলাদ। নির্বাচিত হয়ে গত ৫ বছরে দুই উপজেলায় উল্লেখ্যযোগ্য কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়নমূলক কাজ করেছেন তিনি। এর মধ্যে ৫৭৩ কোটি টাকা ব্যয়ে কুশিয়ারা প্রতিরক্ষা বাধ নির্মাণ। ১৯ কিলোমিটার করাঙ্গী নদী খনন, করাঙ্গী নদীর উপর ৩টি ব্রীজ নির্মাণ। যার কাজ চলমান রয়েছে। নবীগঞ্জে ২২ কিলোমিটার বিজনা নদী খনন, পানি উমদা শংকরপুরে বড় ব্রীজ নির্মান। এতে পানিউমদা, গজনাইপুর ও দেবপাড়া ইউনিয়নবাসীর হবিগঞ্জ শহরে যাতায়াত ব্যবস্থা উন্নত হয়েছে। বাহুবলে ফায়ার সার্ভিস স্টেশন ভবণ নির্মাণ। দুই যুগ বন্ধ থাকার পর সাটিয়াজুড়ি রেলস্টেশন চালু। এছাড়া ১৫টি স্কুল-কলেজ মাদ্রাসা এমপিওভুক্ত ও মিরপুর বাজারে ট্রেনেজ ব্যবস্থাসহ আরসিসি রাস্তাকরণসহ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন রয়েছে তাঁর হাত ধরে।
তবে দুই উপজেলার রাস্তাঘাট ও অবকাঠামোগত উন্নয়নে রয়েছে চরম ভাটা। গ্রামাঞ্চলের মানুষের জীবন মান উন্নয়নে তেমন ভুমিকা নেই তার। যে কারনে দৃশ্যমান উন্নয়ন চোখে পড়েনি জনসাধারণের। এতে সাধারণ ভোটাররা রয়েছেন তার প্রতি ক্ষিপ্ত। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের দলীয় নেতা-কর্মীদের সাথে অনেকটাই দূরত্ব বজায় রেখেছেন তিনি। দুই উপজেলার সংখ্যা গরিষ্ট প্রবীন ও নবীন নেতা-কর্মীদের সাথে তার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। ভোটার ও দলীয় নেতা-কর্মীরা বলছেন, এ দুটি কারণেই মনোনয়ন বঞ্ছিত হয়েছেন তিনি। তবে দুই উপজেলার মানুষের কাছে খুবই ভালো একজন মানুষ তিনি। অর্জন করেছেন ধার্মিক ও স্বচ্ছ ইমেজ’ খ্যাতি।
বানিয়াচং-আজমিরীগঞ্জ আসনে ব্যাপক উন্নয়ন করেছেন এডভোকেট আব্দুল মজিদ খান। যে কারণে সাধারণ মানুষও ভোটারদের মধ্যে আলোচনায় রয়েছেন তিনি। পরপর টানা ৩ বার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে বানিয়াচং-আজমিরীগঞ্জে কয়েকটি সড়ক নির্মাণ, ব্রীজ-কালভার্ট, অবকাঠামোগত ব্যাপক উন্নয়নসহ বিভিন্ন প্রকল্পের কাজ করেছেন তিনি। ফলে ভাটি বাংলা খ্যাত আজমিরীগঞ্জ-বানিয়াচংয়ে ব্যাপক সুনাম রয়েছে তাঁর। আব্দুল মজিদ খানের উল্লেখ্যযোগ্য উন্নয়নের মধ্যে রয়েছে ১৩০ কোটি টাকা ব্যয়ে বানিয়াচং-আজমিরীগঞ্জ এমপি শরীফ উদ্দিন সড়ক নির্মাণ, ৮শ কোটি টাকা ব্যয়ে দিরাই শাল্লা-আজমিরীগঞ্জ-বানিয়াচং-হবিগঞ্জ আঞ্চলিক মহাসড়ক নির্মাণ, ৭০ কোটি টাকা ব্যয়ে বানিয়াচং-আজমিরীগঞ্জ-শিবপাশা সড়ক নির্মাণ, ৭২ কোটি টাকা ব্যয়ে নবীগঞ্জ-বানিয়াচং সড়ক, আজমিরীগঞ্জ-হবিগঞ্জ সড়ক ও হবিগঞ্জ-বানিয়াচং সড়কের সংস্কার, বানিয়াচং-আজমিরীগঞ্জে ১৩২ কোটি টাকা ব্যয়ে উচ্চ বিদ্যালয়, কলেজ ও মাদ্রাসার ৫৮টি ভবণ নির্মাণ, ১২০ কোটি টাকা ব্যয়ে সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় ২৩৫টি ভবণ নির্মাণসহ অসংখ্য মসজিদ-মাদ্রাসা, ব্রীজ কালভার্ট, মন্দির নির্মাণ করেছেন তিনি। উন্নয়নমুলক কাজে বেশ প্রশংসা রয়েছে তাঁর। তবে দীর্ঘদিন তিনি জেলা আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকা সত্তেও দলীয় নেতা-কর্মীদের সাথে সু-সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারেননি তিনি। দুই উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি-সাধারণসহ তৃণমূল নেতা-কর্মীদের সাথে দুরত্ব ও অমিল রয়েছে তার। স্থানীয় নেতা-কর্মীদের বিভিন্ন সময় মামলা দিয়ে হয়রানী করার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে । সম্প্রতি আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রকাশের কিছুদিন পূর্বে দুই উপজেলার নেতা-কর্মীদের সমন্বয়ে যৌথ সভায় তার প্রতি ক্ষোভ ও নিন্দার ঝড় তুলা হয়। অভিযোগ করা হয়, প্রকৃত আওয়ামীলীগের নেতা-কর্মীদের বাদ দিয়ে হাইব্রীড নেতাদের গুরুত্ব দিচ্ছেন তিনি। এমপি’র ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে দলের নেতাদের মামলা দিয়ে করেছেন হয়রানী। এসব অভিযোগই প্রভাব পড়েছে মজিদ খানের মনোনয়নে। শুধু তাই নয়, এমপি মজিদ খান নিজের পকেটের লোক দিয়ে এলাকায় গড়ে তুলেছেন ‘মজিদ লীগ’। এমন অভিযোগে স্থানীয় নেতা-কর্মীরা ক্ষিপ্ত রয়েছেন তার প্রতি। এসব কারণেই তিনি এ বছর মনোনয়ন বঞ্ছিত হয়েছেন বলে ধারণা ভোটার ও নেতা-কর্মীদের।