মার্কিন কংগ্রেসের ‘টম ল্যান্টস মানবাধিকার কমিশন’র উদ্যোগে মঙ্গলবার (১৫ আগস্ট) ‘বাংলাদেশে মানবাধিকার পরিস্থিতি: হালনাগাদ’ শিরোনামে অনুষ্ঠিত শুনানিতে বাংলাদেশের জাতিরজনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যা এবং হত্যা পরবর্তী মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে কোনো আলোচনাই উঠেনি। বরং ওই শুনানিতে বিএনপি-জামায়াতের ভাষ্য অনুযায়ী ‘শেখ হাসিনা-সরকার কর্তৃক বিরোধীদলের নেতা-কর্মীদের বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম, এবং সাংবাদিকসহ সরকারের সমালোচকদের অত্যাচারের’ ধারাবিবরণী উত্থাপন করা হয়। এতে ওখানকার অংশগ্রহণকারীরা অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। শুনানির সারাংশ তারা কংগ্রেসে জমা দেবেন।
প্রসঙ্গত, ১৫ আগস্ট বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যার দিনে তথা বাঙালিদের জাতীয় শোক দিবস সত্ত্বেও এই শুনানিতে তার কোনো কোন ছাপ পরিলক্ষিত না হওয়ায় অংশগ্রহণকারিদের অনেকেই ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। একজন প্রসঙ্গটির অবতারণা করলেও সঞ্চালক তা আমলে নেননি বলে একজন অংশগ্রহণকারি বুধবার সকালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফোনে ঢাকায় ভোরের কাগজকে জানিয়েছেন।
তবে প্যানেলিস্টদের একজন বক্তব্য উপস্থাপনের সময় সকলকে একথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে ১৫ আগস্ট হত্যা করা হয়েছিল। শুনানিতে প্রশ্নোত্তর পর্বে প্রশ্ন ওঠেছিল, ১৫ আগস্টকে কেন এই শুনানির জন্য বেছে নেয়া হল। কিন্তু সঞ্চালক এই প্রশ্নটি এড়িয়ে যান।
লাইব্রেরি অব কংগ্রেসের বিদেশ-বিষয়ক আইনের বিশেষজ্ঞ তারিক আহমেদের সঞ্চালনায় এতে প্রধান বক্তা ছিলেন-এশিয়ান হিউম্যান রাইটস ও এশিয়ান লিগেল সেন্টারের মোহাম্মদ আশরাফুজ্জমান। তিনি অভিযোগ করেন, ২০০৯ সাল থেকে এ যাবত ক্ষমতাসীন শেখ হাসিনার শাসনামলে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে ২ হাজার ৬৮৩ জন।
২০২১ সালে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারি বাহিনীর সদস্যরা ১০৭টি বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করেছে। গত বছর ৪টি। অর্থাৎ র্যাবের কয়েক কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর এহেন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের সংখ্যা কমলেও বিরোধী মতবাদ পোষণকারীদের দমন-পীড়ন অব্যাহত আছে বলে মন্তব্য করেছেন আশরাফুজ্জামান।
ভাচ্যুয়ালে অনুষ্ঠিত এ শুনানিতে বক্তা ছিলেন-রবার্ট কেনেডি হিউম্যান রাইটসের ক্রিষ্টি উয়েডা, হিউম্যান রাইটস ওয়াচের জুলিয়া ব্লেকনার, এবং ইউ. এস, ইনস্টিটিউট অব পীস ও ইন্টারন্যাশন্যাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউটের এশিয়া-প্যসিফিক ডিভিশনের এ্যাডভাইজার ডক্টর জেফ্রি ম্যাকডোনাল্ড। হোস্ট করেন-কংগ্রেসম্যান (ডেমোক্র্যাট) জেমস পি ম্যাকগভার্ন এবং রিপাবলিকান কংগ্রেসম্যান ক্রিস্টোফার এইচ স্মীথ। এরা দু’জন হলেন-আয়োজক সংগঠন ‘টম ল্যান্টস মানবাধিকার কমিশন’র কো-চেয়ার। শুনানির সারাংশ তারা কংগ্রেসে জমা দেবেন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাঙালি কম্যুনিটি লিডার ও ডেমোক্র্যাটিক পার্টির অন্যতম সংগঠক ড. দিলীপ নাথ এই শুনানিতে ছিলেন। তিনি বলেন, শুনানির নামে প্রহসনের নাটক মঞ্চস্থ করা হয়েছে। বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে শুনানির আয়োজন করা হলো, অথচ আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্যে বাংলাদেশের সরকারের অথবা ক্ষমতাসীন দলের কাউকে সুযোগ দেয়া হয়নি। বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের নেতা অধ্যাপক নব্যেন্দু দত্ত এবং ড. দ্বীজেন ভট্টাচার্য একই মন্তব্য করেছেন আয়োজকদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে।
ড. দ্বীজেন ভট্টাচার্য বুধবার (১৬ আগস্ট) সকালে ভোরের কাগজকে বলেন, অংশগ্রহণকারীদের বক্তব্য শুনতে শুনতে মনে প্রশ্ন জাগছিল, এই শুনানির আয়োজক আসলে কে? টম ল্যান্টস হিউম্যান রাইটস কমিশনের শুনানি তো সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ হওয়ার কথা, এই কমিশন কি জানেনা আজ আমাদের জাতীয় শোক দিবস, এই দিনে ওরা এই শুনানির আয়োজন করতে গেল কেন? বক্তা হিসেবে তারা কোনো সরকারি প্রতিনিধি, বাংলাদেশের কোনো বিখ্যাত সাংবাদিক বা মানবাধিকার কর্মী/প্রবক্তা, নির্যাতিত সংখ্যালঘুদের প্রতিনিধি-কাউকে আনেনি কেন? কেউ কেন বলছে না ২০০১ সালের কথিত নির্বাচনে বিজয়ী বিএনপি-জামাত কি নারকীয় তাণ্ডব চালিয়েছিল দেশের সংখ্যালঘু নাগরিকদের ওপর। আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে একই পরিস্থিতির পুনরাবৃত্তি ঠেকানোর জন্য সরকার এবং বিরোধী দলগুলোর কার কী করণীয় সে কথাও উপস্থাপিত হলো না।
ড. দ্বীজেন এবং অধ্যাপক নব্যেন্দু বিস্ময়ের সঙ্গে বলেন, যুক্তরাষ্ট্র হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ কখনও কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষে বা বিপক্ষে অবস্থান না নিয়ে দেশের সংখ্যালঘু নির্যাতনে ঐতিহাসিকভাবে সব দলেরই নেতিবাচক ভূমিকার কথা যুক্তরাষ্ট্র সরকার ও কংগ্রেসকে জানিয়ে এসেছে এবং এর সমাধানে তাদের সাহায্য চেয়েছে। সেই ধারাবাহিকতায়, আমরা মনে করি, আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে আজকের শুনানিতে আনিত সকল অভিযোগের কী জবাব তারা দেবে সেটা তাদের ব্যাপার, কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে অস্বীকার করলে তো বাংলাদেশে রাষ্ট্র এবং বাঙালী জাতীয়তাবাদ কিছুরই অস্তিত্ব থাকে না।
শুনানিতে কে কে উপস্থিত ছিলেন সেটা স্ক্রীনে দেখা যায়নি। প্রশ্নোত্তর পর্বে সঞ্চালক নিজেই প্রশ্নগুলো তার মত করে পড়ে শোনালে প্যানেলিস্টরা উত্তর দেন,যা তাদের লিখিত বক্তব্যের চেয়ে ভিন্ন কিছু ছিল না। ঐক্য পরিষদের নেতারা বলেছেন, আমরা যুক্তরাষ্ট্রে অসংখ্য শুনানি শুনেছি, কিন্তু এমন একপেশে শুনানি এই প্রথম দেখলাম। শুনানিতে এমন প্রশ্নও ছিল নির্বাচন পরিচালনা করার জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন হওয়া দরকার কি না।
ডক্টর জেফ্রি ম্যাকডোনাল্ড এই প্রশ্নের জবাবে বলেন, সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য ইলেকশন কমিশনকে শক্তিশালী করা দরকার।
নিউজ /এমএসএম