সোমবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৫, ১০:২৯ অপরাহ্ন
শিরোনাম :
শ্রীমঙ্গলে ট্রেনের ধাক্কায় চিকিৎসকের মৃত্যু সাংবাদিক মুরাদ জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় যুগ্ম সাংগঠনিক সম্পাদক মনোনীত সংবাদ প্রকাশের জেরে সাংবাদিক লাঞ্ছিত আজমিরীগঞ্জে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষে আহত অর্ধশতাধিক বিসিক এর প্লট বরাদ্দ নিয়ে শ্রীমঙ্গলে মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত সম্প্রীতির বন্ধনে দেশকে এগিয়ে নিতে চাই- সুপ্রদীপ চাকমা পার্বত্য শান্তিচুক্তি পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নে সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ পঞ্চগড়ে বিএনপির ৩১ দফার প্রশিক্ষণ কর্মশালা অনুষ্ঠিত শেখ হাসিনা সহ সকল নেতাকর্মীদের মিথ্যা মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত ঠাকুরগাঁওয়ে ইএসডিও’র পিএফ ও গ্র্যাচুইটি সুবিধাদির চেক বিতরণ অনুষ্ঠিত

পদ্মা সেতু আমাদের জাতীয় সক্ষমতার প্রতীক

সংবাদদাতার নাম :
  • খবর আপডেট সময় : বুধবার, ২২ জুন, ২০২২
  • ১৬৮ এই পর্যন্ত দেখেছেন

ড. আতিউর রহমান: বহু বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে, মানবসৃষ্ট ও প্রাকৃতিক বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেই আমাদের স্বপ্নের মিনার যে পদ্মা সেতু তার কাজ শেষ হয়েছে। পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের অপেক্ষায় উন্মুখ হয়ে ক্ষণ গণনা করছেন এদেশের আপামর জনতা। নানা প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে বাস্তবে রূপায়িত হওয়া এই স্বপ্নের প্রকল্পটি কেবল সামষ্টিক অর্থনৈতিক বিবেচনায় গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোই নয়। একে বলতে হবে আমাদের জাতীয় সক্ষমতার অনন্য প্রতীক।

কোটি কোটি বাঙালির মনে মনে থাকা ‘আমরাই পারি’- এই শব্দযুগলের মূর্ত প্রতীক হয়েই যেন দাঁড়িয়ে আছে সদ্যসমাপ্ত পদ্মা সেতু। এই প্রকল্প বাস্তবায়নে এদেশের মানুষের নিজস্ব শক্তি আর সক্ষমতার ওপর সবচেয়ে বেশি যিনি আস্থা রেখেছেন তিনি বঙ্গবন্ধুকন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সকল চ্যালেঞ্জের মুখেও অবিচল ও আপোশহীন থেকে তিনিই এ স্বপ্নের সেতুর কাজ শেষ করায় নেতৃত্ব দিয়েছেন। পদ্মা সেতুর নাম আসলেই এর পেছনে তাঁর এমন অবিচল নিষ্ঠা ও আপোশহীনতার প্রসঙ্গ আসবে আরও বহু কাল। সরকার প্রধান হিসেবে দেশের মানুষের আত্মশক্তির ওপর তাঁর এমন আস্থা দেখে বারবার মনে পড়ে যায় বঙ্গবন্ধুর কথা। বঙ্গবন্ধুই আমাদের মধ্যে এমন আত্মশক্তির বীজ বুনে গেছেন। সেই জোরেই আমরা আজ এতোটা পথ পাড়ি দিয়ে বিশ্বের মানচিত্রে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছি। সে বিচারে পদ্মা সেতুকে আপোশহীন গণমুখী নেতৃত্বের পরম্পরার ফসল হিসেবেও দেখা যায়।

বঙ্গবন্ধুর আজীবনের স্বপ্ন ছিলো এদেশের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে তাদের আত্মশক্তির ওপর ভর করে একটি সমৃদ্ধ সোনার বাংলা গড়ে তোলা। তাই তাঁর ডাকে পুরো জাতি এক হয়ে লড়াই করে দেশকে স্বাধীন করেছিলো। স্বাধীন দেশে ‘যুদ্ধের ছাইভস্ম থেকে সমৃদ্ধির পথে’ এক নতুন অভিযাত্রা শুরু করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। দেশের দায়িত্বভার যখন তিনি কাঁধে নেন তখন তাঁর হাত শূন্য। শূন্য হাতে দেশ গড়ার কাজ হাতে নিয়েছিলেন দেশবাসীর আত্মশক্তির ওপর ভরসা রেখেই। তাই বিদেশি সহায়তার জন্য কখনও কোন আপোশ করেন নি। তাই বিশ্ব মোড়লরা যখন খাদ্য সহায়তা নিয়ে রাজনীতি শুরু করেছিলো তখন তিনি ক্ষিপ্ত হয়েছিলেন।

১৯৭৩ সালে বিশ্ব ব্যাংকের তখনকার ভাইস প্রেসিডেন্ট কারগিল বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলেন পাকিস্তান আমলে সরকারের যে ঋণ ছিলো তার দায় সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশকেও নিতে হবে। তা নাহলে খাদ্য সহায়তা পাওয়ার ক্ষেত্রে সমস্যা হতে পারে। যেহেতু পাকিস্তান আমলে পাওয়া বিদেশি সহায়তা মূলত পশ্চিম পাকিস্তানেই বিনিয়োগ করা হয়েছিলো তাই বিশ্ব ব্যাংকের এই দাবি মেনে নিতে পারেননি বঙ্গবন্ধু। তাই কারগিলকে সেদিন দ্যর্থহীন কণ্ঠে জানিয়ে দিয়েছিলেন যে দরকার হলে বাংলাদেশের মানুষ ঘাস খেয়ে থাকবে, তবু খাদ্য সহায়তার আশায় অন্যায়ের সাথে আপোশ করবে না। বঙ্গবন্ধুর এহেন আপোশহীনতায় শেষ পর্যন্ত উন্নয়ন সহযোগিরা তাদের অন্যায় দাবি থেকে সরে এসেছিলো। স্বাধীনতার পর পরই এভাবে বিশ্ব মোড়লদের সামনে বাঙালিকে একটি আত্মমর্যাদাশীল জাতি হিসেবে পরিচিত করে তুলেছিলেন বঙ্গবন্ধু।

সেই আত্মমর্যাদাশীল জাতির পরিচয় নিয়ে আজও আমরা ন্যায্যভাবেই গর্বিত হই। আজ আমাদের সামনে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা। তাই এদেশেরই কিছু তথাকথিত আলোকিত মানুষের চক্রান্তে বিশ্ব ব্যাংক যখন পদ্মাসেতু নির্মাণে দুর্নীতি হচ্ছে- এমন অন্যায় অভিযোগ আনে তখন তা আমরা মেনে নেইনি। পদ্মা সেতু নির্মাণের জন্য ১.৪ বিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক সাহায্য দেবার যে আয়োজন বিশ্ব ব্যাংকের নেতৃত্বে উন্নয়ন অংশীদারেরা করেছিলেন তা অযথাই এক নোংরা বিতর্কের মাঝে পড়ে যায়। তখনও কোন আন্তর্জাতিক ঠিকাদার নির্দিষ্ট করা হয়নি। প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরীর নেতৃত্বে গঠিত কারিগরি কমিটি শর্টলিস্ট করা ঠিকাদারদের প্রস্তাবগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছিলো। কোথাও কোন কন্ট্রাক্ট দেয়া হয়নি।

এমন সময় বিশ্ব ব্যাংকের ইন্টিগ্রিটি বিভাগের পক্ষ থেকে অন্যায়ভাবে অভিযোগ করা হলো যে এই প্রকল্পে দূর্নীতি করা হচ্ছে। এ জন্য তৎকালিন সেতু মন্ত্রণালয়ের কর্তাব্যক্তিদেরকে কম হয়রানি করা হয়নি। বিশ্ব ব্যাংকের এই বাড়াবাড়ির জবাবে বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী সিদ্ধান্ত নেন যে, এই প্রকল্পের অর্থায়ন স্বদেশের অর্থেই করা হবে। এটিই ছিলো সে সময়ে সবচেয়ে সমুচিত জবাব। পরবর্তি সময়ে কানাডার আদালত রায় দেয় যে এই প্রকল্পে কোন দুর্নীতি হয়নি। আর শেষ পর্যন্ত নানা প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে আজ যখন পদ্মা সেতুর কাজ শেষ হয়েছে তখন গোটা বিশ্বই দেখতে পাচ্ছে কি করে বাংলাদেশের মানুষ তাদের দেশ ও দেশের নেতৃত্বকে অন্যায় অপবাদ দেয়ার বদলা নেয়।

আত্মশক্তিতে বলিয়ান বঙ্গবন্ধুকন্যার বিচক্ষণ নেতৃত্বে পদ্মা সেতুর উদ্বোধন আসলে আমাদের সক্ষমতার বাংলাদেশের নয়াদিগন্ত উন্মোচনের দিন হিসেবে যুগের পর যুগ পালিত হবে বলে আমার বিশ্বাস। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নেতৃত্বে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত (বিশেষত অগ্রণী ব্যাংক) এই মেগাপ্রকল্পের পুরো বৈদেশিক মুদ্রা সরবরাহ করেছে। আর এই বিদেশি মুদ্রা মূলত আমাদের দেশপ্রেমিক পরিশ্রমী প্রবাসী ভাই বোনেরাই আয় করে ব্যাংকিং চ্যানেলে দেশে পাঠিয়েছেন। পোষাক শিল্পে কর্মরত কৃষককন্যাদের পরিশ্রমের ফসল রপ্তানি আয়ও এর সাথে যুক্ত হয়েছে। সাড়ে সাত বছর ধরে প্রতিকূল প্রাকৃতিক ও কভিড-১৯ এর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে এই সেতুর নির্মাণ সম্পন্ন হয়েছে। আমাজন নদীর পরেই খরশ্রোতা পদ্মার ওপর ১২৮ মিটার দীর্ঘ গভীরতম পাইলিং করে পদ্মাসেতুর দ্বিতল কাঠামো স্থাপন করা হয়েছে। এই সেতুর ওপর তলা দিয়ে যানবাহন এবং নীচের তলা দিয়ে রেল চলবে। একই সঙ্গে নীচের তলায় রয়েছে গ্যাস, বিদ্যুত ও ইন্টারনেটের লাইন। প্রযুক্তির বিস্ময়কর ব্যবহারে গড়ে ওঠা পদ্মাসেতুর জন্য সিমেন্ট, রড ও অন্যান্য উপকরণের বেশিরভাগই জুগিয়েছে বাংলাদেশের শিল্পখাত। আন্তর্জাতিক ঠিকাদারদের পাশাপাশি আব্দুল মোনেম গ্রুপের মতো স্বদেশী ঠিকাদাররাও অসাধারণ অবদান রেখেছে এই সেতু নির্মাণে। বাংলাদেশ সেনা বাহিনীর প্রকৌশল বিভাগের সমন্বয় ও কর্মতৎপরতাও ছিল দেখার মতো।

প্রমত্ত পদ্মা যুগের পর যুগ দক্ষিণ বাংলার একুশটি জেলার অর্থনীতিকে বাংলাদেশের মূলধারার অর্থনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছিল। কৃষিপণ্যসহ অন্যান্য পণ্য দিনের পর দিন ফেরি ঘাটে পড়ে থাকতো। অনেক পণ্য পঁচে যেতো। সহজে মুমূর্ষ রোগীকেও প্রতিকূল আবহাওয়ায় ঢাকায় নিয়ে চিকিৎসা করা যেতো না। দক্ষিণ বাংলার রাস্তাঘাট হয়েতো এখন আগের চেয়ে উন্নত হয়েছে। কিন্তু কানেক্টিভিটি না থাকায় এগুলো দক্ষ ব্যবহার হচ্ছিল না। তাই এই এলাকায় কলকারখানা গড়ে ওঠে নি। ছোট ও মাঝারি শিল্প ও ব্যবসায়ী উদ্যোগও তাই সীমিতই থেকে গেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এমনিতেই দক্ষিণ বাংলার উপকূলের মানুষজন দারুণ অর্থনৈতিক চাপে রয়েছেন। দেশের গড় দারিদ্র্যের হার থেকে অন্তত পাঁচ শতাংশ বেশি এই অঞ্চলে। পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান নেই এখানে। তাই জলবায়ু শরণার্থীরা ঢাকা বা চট্টগ্রামে খুবই কষ্টে জীবন ও জীবিকার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে থাকেন। অথচ পদ্মাসেতুটি যদি আরও আগে করা যেতো তাহলে যমুনার ওপর বঙ্গবন্ধু সেতু নির্মাণের ফলে উত্তর বঙ্গের অর্থনীতির যে উন্নতি (জিডিপিতে বছরে ২% যোগ হচ্ছে) হয়েছে তা দক্ষিণ বাংলাতেও হতে পারতো।

বঙ্গবন্ধুকন্যা পদ্মার ওপারের মানুষ। তাই দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের দুঃখ দুর্দশা নিজের চোখে দেখেছেন। এসব নিয়ে বেশ কয়েকটি বইও তিনি লিখেছেন। তাই পদ্মাসেতু নির্মাণে তিনি ছিলেন আপোশহীন। বঙ্গবন্ধু বাঙালিকে যে লড়াকু মন দিয়ে গেছেন তার অনেকটাই বঙ্গবন্ধুকন্যাও পেয়েছেন। তাই জনগণের মঙ্গল হবে এমন প্রকল্প গ্রহণে তিনি এতোটা মরিয়া। জেদি। অঙ্গীকারাবদ্ধ। নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধুর মতোই স্বউন্নয়নে তিনি নিবেদিতপ্রাণ। আমি পদ্মাসেতু উপাখ্যানের শুরুর দিনগুলোতে তাঁর খুব কাছে থেকেই দেখেছি তিনি কতোটা সাহসী এবং আত্মসম্মানে বলীয়ান। কেননা তিনি যে অনেক দূরে দেখতে পান। ঠিকই তিনি অনুভব করেছিলেন এই সেতু শুধু দক্ষিণ বাংলা নয় পুরো বাংলাদেশের উন্নয়নের ল্যান্ডস্কেপই বদলে দেবে। তাই পদ্মাসেতুর উদ্বোধনের আগ দিয়ে জনমনে যে প্রাণচাঞ্চল্য দেখা গেছে তা মোটেও অনভিপ্রেত ছিল না। তাই যখন গণমাধ্যমে দেখতে পাই একজন জসিমউদ্দীন ষোল হাজার টাকায় আইসিইউ সুবিধে সম্পন্ন অ্যাম্বুলেন্সে করে তার মুমূর্ষ সন্তানকে পদ্মাসেতু দেখাতে নিয়ে যান তখন আর অবাক হই না। চ্যানেল একাত্তরে যখন এই প্রতিবেদনটি দেখানো হচ্ছিল তখন দেশে এবং বিদেশে সঞ্চালকের মতোই মানুষের চোখে পানি ধরছিল না তার হিসেব ক’জনই বা রাখেন।

একই ভাবে চ্যানেল সময়ের রাশেদ বাপ্পী যখন বিভিন্ন জেলায় ঘুরে ঘুরে তার ‘স্বপ্নযাত্রা’ সিরিজটি দেখিয়েছেন তখন সহজেই বোঝা গেছে দক্ষিণ বাংলার মানুষগুলোর আরও সুন্দর জীবন যাপনের স্বপ্নের তল কতোটা গভীর। ঐ প্রতিবেদন থেকেই জানতে পারি ফরিদপুরের কৃষকরা আশা করছেন পদ্মাসেতু চালু হবার পর এই অঞ্চলে নতুন কলকারখানা তৈরি হবে। তাদের উৎপাদিত পাটের চাহিদা বাড়বে। সোনালী আঁশ তাদের সোনালী স্বপ্ন পূরণে সারথি হবে। ৭০ মিনিটে ঢাকা যেতে পারবেন ফরিদপুরের মানুষ। এ যেন ‘স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে’ একজন জানালেন। তাদের ধারনা পদ্মা সেতু তাদের জীবন মান উন্নয়নে বিরাট ভূমিকা পালন করবে। একই ভাবে খুলনা, কুষ্টিয়া, বরিশালের মানুষের মনে কতো স্বপ্নই না ভর করেছে। কুষ্টিয়ার কুমারখালির গামছা পল্লীর তাঁতিরা মনে করছেন তাদের কাঁচামাল সংগ্রহ সহজ হবে। উৎপাদিত পণ্যও দ্রুত কম সময়ে ঢাকা ও অন্যান্য বাজারে নেয়া যাবে।

কবিগুরুর কুঠি বাড়ি পর্যটকে ভরে যাবে। লালন শাহের আখড়া, কাঙ্গাল হরিনাথ, মীর মোশাররফ হোসেনের স্মৃতি ধন্য কুষ্টিায়ার সংস্কৃতি অঙ্গণ সক্রিয় হয়ে উঠবে পদ্মা সেতুর কল্যাণে যাতায়াত সহজ হবার করণে। শুধু ইলেক্ট্রনিক গণমাধ্যমে কেন, প্রিন্ট মিডিয়াতেও খবর বের হয়েছে জনগণের উচ্ছ্বাসের। ‘স্বপ্ন বুনছেন পদ্মাপারের মানুষ’ শিরোনামে ‘দৈনিক আমদের সময়ে’ ২১মে, ২০২২ সানাউল হক সানি স্থানিয় অর্থনীতিতে এই সেতুর প্রভাব কতোটা গভীরভাবে পড়তে তা স্পষ্টভাবেই ফুটে উঠেছে। জাজিয়ার নাওডোবা এলাকার ক্ষুদে দোকানদার ইব্রাহিম হাওলাদার পদ্মাসেতু চালু হবার পর তার মোটর মেকানিক সন্তানকে ঢাকা থেকে নিয়ে আসবেন তার গ্রামে। তাকে তিনি গ্যারেজ করে দেবেন। সুখে দুঃখে স্বজনদের সাথেই এক সঙ্গে সেও থাকবে। জাজির কাজির হাট বাজারের ব্যবসায়ী মোস্তফা কামাল জানিয়েছেন শিল্পকারখানার জন্য উদ্যোক্তারা কোটি টাকা দিয়ে জমি কিনে ফেলছেন।

স্থানীয়রাও নানামুখী ব্যবসায়ী উদ্যোগ নিচ্ছেন। জাজিরা পৌরসভার রেজাউল করিম ঢাকায় কারখানায় কাজ করেন। তিনি এই বাজারে ফিরে এসে নিজেই কারখানা গড়ে তুলবেন। নড়িয়া উপজেলা মধ্যপ্রাচ্য ফেরৎ আশরাফুল আর বিদেশে যাবেন না। দ্রুত গড়ে ওঠা হিমাগারের ম্যানেজারের কাজ পেয়ে গেছেন। এই প্রতিবেদন থেকেই জানাগেল জাজিরা, নড়িয়া, ভাঙ্গাসহ অনেক স্থানেই বড় শিল্প গ্রুপ জমি কিনে রেখেছে। এরই মধ্যে পার্ক-রিসোর্ট তৈরি হচ্ছে। শরীয়তপুরের তোসাই হাটে তৈরি হচ্ছে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল। জাজিরা উপজেলার নওডোবায় দেশের সর্ববৃহৎ তাঁত শিল্প ‘শেখ হাসিনা তাঁতপল্লী’ গড়ে উঠছে দশ লক্ষ মানুষের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কর্মসংস্থান দেবার লক্ষ্য নিয়ে।

কর্মরত তাঁতীদের জন্য ৮ হাজার ৬৪টি তাঁত শেড নির্মাণ হতে যাচ্ছে তাঁতীদের আবাসনের জন্য। এই তাঁত পল্লীতে বছরে ৪.৩১ কোটি মিটার কাপড় তৈরি হবে। এই এলাকার কৃষক আলতাফ মিয়া যথার্থই বলেছেন, ‘হঠাৎ পুরে এলাকাই বদলে গেল।… এখনই পদ্মাসেতু দেখতে পর্যটকরা ভিড় করছেন আমাদের এলাকায়।’ এই এলাকায় গড়ে উঠছে আইটি পার্ক। সত্তর একর জায়গায় গড়ে উঠছে হাইটেক পার্ক। আরও গড়ে উঠছে টেক্সটাইল ইনজিনিয়ারিং কলেজ, শিশু পার্ক, নার্সিং ইনস্টিটিউট ও কলেজ, অলিম্পিক ভিলেজ, বিসিক শিল্প পার্ক, বিশাল হাউজিং প্রকল্প যখানে লাখ খানিক মানুষের আবাসন হবে। জাজিরা উপজেলার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জানিয়েছেন পদ্মাসেতু দিয়ে দ্রুত কৃষি পণ্য ঢাকাসহ অন্যান্য বাজারে যাবে বলে কৃষকরা ন্যায্য দাম পাবেন।

চরাঞ্চলেও লেগেছে নগরায়নের ছোঁয়া। গড়ে উঠছে শিল্প কারখানা। বাড়বে কর্মসংস্থানের সুযোগ। পদ্মাসেতু মানুষের উচ্ছ্বাস কতোটা প্রবল তার খবর দিয়েছে কালের কণ্ঠ (৪ জুন’ ২০২২)। পদ্মাসেতু বা ব্রিজ গুগল করলে আড়াই কোটি খবর ও ভিডিও হিট করে বলে ঐ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। এসব টুকরো টুকরো তথ্য থেকেই অনুমান করতে পারি পদ্মাসেতুর অর্থনৈতিক গুরুত্ব কতোটা হতে পারে। অর্থনীতিবিদরা মডেলিং করে দেখিয়েছেন যে পদ্মাসেতু চালু হলে বছরে ১.২৬ শতাংশ জাতীয় জিডিপিতে যুক্ত হবে। একুশ জেলার আঞ্চলিখ জিডিপিতে যুক্ত হবে ৩.৫০ শতাংশ।

রেল চালু হলে জাতীয় জিডিপিতে আরও এক শতাংশ যুক্ত হবে। ভুটান, নেপাল ও ভারতের সাথে বাণিজ্যিক যোগাযোগ বাড়বে। মোংলা ও পায়রা সমুদ্র বন্দরের সচলতা বাড়বে। তাদের আশে পাশে অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে উঠবে। খুলনা, বরিশালে জাহাজ ভাঙ্গা ও নির্মাণ শিল্প গড়ে উঠবে। শুধু বরিশালেই এক হাজারের মতো ক্ষুদে ও মাঝারি শিল্পোদ্যোগ গড়ে উঠবে। কুয়াকাটা, ষাট গম্বুজ মসজিদ, বঙ্গবন্ধুর সমাধি সৌধ, কবিগুরুর কুঠি বাড়ি, লালনের আখড়া, সুন্দরবনে পর্যটকদের ঢল

নামবে। দক্ষিণাঞ্চলে প্রতিবছর অন্তত দুই লক্ষ মানুষের কর্মসংস্থান হবে। বছরে এক শতাংশেরও বেশি দারিদ্র্য কমে আসেব। অনেকেই ঢাকা থেকে নিজ এলাকায় ফিরবে। মোট শ্রমশক্তির ১.২ শতাংশের কর্মসংস্থান ঘটবে। আরও সহজ করে বলা যায় আগামি পাঁচ বছরে দশ লাখ অর্থাৎ বছরে দুই লাখ মানুষের নতুন করে কর্মসংস্থানের সুযোগ ঘটবে। দশ বছর পর এই

সংখ্যা তিন গুন হয়ে যাবে। এশীয় হাইওয়ে ও রেলওয়ের সাথে যুক্ত হবে পদ্মাসেতুর ওপর দিয়ে যাওয়া এক্সপ্রেসওয়ে। আমরা চাইলেই পদ্মাসেতুর দক্ষিণাঞ্চলে কিছু সরকারি অফিস (যেমন বিআরটিএ) নিয়ে যেতে পারি। বিশ্ববিদ্যালয়, হাসপাতাল, বিমান বন্দর, আন্তর্জাতিক কনভেনশন হল গড়ে তোলার উদ্যোগ নিশ্চয় আমরা নিতে পারি। এর ফলে ঢাকার ওপর বাড়তি নগরায়নের চাপ কমবে। সেজন্য ফরিদপুর (পদ্মা বিভাগ) সহ বিভাগীয় শহরগুলোকে আধুনিক নগর হিসেবে গড়েতুলতে পারি। এ অঞ্চলে শিল্পায়ন, শিক্ষা ও প্রশিক্ষণকেন্দ্র গড়ে তোলার জন্য স্টার্টআপ তহবিলসহ বিশেষ কর সুবিধে ও অর্থায়নের সুযোগ অবশ্যি দিতে পারি।

নিঃসন্দেহে পদ্মা সেতু আমাদের অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের পথনকশায় এক নতুন আশা-সঞ্চারি মাইলফলক। পদ্মাসেতু আমাদের অহংকার ও মর্যাদার প্রতীক। বিশ্বাসের আত্মশক্তির প্রতীক। ‘আমরাও পারি’ আত্মবিশ্বাসের প্রতিচ্ছবি। এই সেতুর সাথে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার সাহসী নেতৃত্বের ছোঁয়া লেগে আছে। এই বন্ধন যুগে যুগে আরও পোক্ত হবে। বিরাট হবে।

বিশ্ব অর্থনৈতিক সংকটের এই দুঃসময়ে পদ্মাসেতুর উদ্বোধন বাংলাদেশের উন্নয়ন অভিযাত্রার এক নয়া বার্তা দেবে বিশ্বকে। আন্তর্জাতিক অর্থনীতির টালমাটাল অবস্থাতে আমাদের সামনেও নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ হাজির হচ্ছে। করোনা সঙ্কট এখনও পুরোপুরি কাটেনি। দেশব্যাপি খাদ্য মূল্যবৃদ্ধির চাপ রয়েছে। এর মধ্যে বন্যার আশঙ্কাও দেখা দিচ্ছে। এতো সব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেও আমরা অল্প সময়ের মধ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে যুক্ত হবার সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছি। স্বপ্ন দেখছি দুই দশকেরও কম সময়ের মধ্যে উচ্চ আয়ের দেশে রূপান্তরের। এমন সাহসের পেছনে কাজ করছে এদেশের পরিশ্রমী মানুষ আর অর্থনৈতিক সক্ষমতার ট্র্যাক রেকর্ড। সেই জাতীয় শক্তিরই প্রতীক এই পদ্মা সেতু। এই স্বপ্নের সেতুটি থেকে আমরা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে বাধা পেড়িয়ে সফল হওয়ার অনুপ্রেরণা পাবো। (পিআইডি ফিচার)

লেখক: সাবেক গভর্নর বাংলাদেশ ব্যাংক।

দয়া করে খবরটি শেয়ার করুন

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

এই ক্যাটাগরিতে আরো যেসব খবর রয়েছে
All rights reserved © UKBDTV.COM
       
themesba-lates1749691102