মঙ্গলবার, ১১ ফেব্রুয়ারী ২০২৫, ০৪:৪৫ পূর্বাহ্ন

পাঁচটি চ্যালেঞ্জের বাজেট পেশ আজ

সংবাদদাতার নাম :
  • খবর আপডেট সময় : বৃহস্পতিবার, ৯ জুন, ২০২২
  • ১৫৩ এই পর্যন্ত দেখেছেন

অর্থনৈতিক রিপোর্টার: রাষ্ট্রের আয়-ব্যয়ের বার্ষিক খতিয়ান বাজেট। করোনা পরবর্তী সময়ে এবার আরেকটি বাজেট ঘোষণার দিনক্ষণও চুড়ান্ত। আজ বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে বাজেট উত্থাপন করা হবে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, কৃষি, স্বাস্থ্য, মানবসম্পদ, কর্মসংস্থান ও শিক্ষা খাতসহ বেশ কিছু খাতকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে বাজেট তৈরি করছে বাংলাদেশ সরকার। তবে মহামারি ও বিশ্ব অর্থনৈতিক পরিস্থিতি মাথায় রাখার নির্দেশনাও দেয়া হয়েছে।

নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বমুখী দামে হাহাকারের মধ্যেই এবার দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় বাজেট আসছে। ফলে থাকছে নানা চ্যালেঞ্জ। আসন্ন অর্থবছরে সরকারের বিশাল অঙ্কের এ বাজেটে মানুষের প্রত্যাশা হচ্ছে, জিনিসপত্রের দাম যেন থাকে নাগালের মধ্যে। এছাড়া স্বস্তিতে ব্যবসা করতে চান ব্যবসায়ীরা। এদিকে বিশ্লেষকরা বলছেন, বাজেটে শুধু বরাদ্দ দিলেই হবে না, এটা যেন বাস্তবায়ন হয় সেদিকে বিশেষ জোর দিতে হবে। বাস্তবায়নের সময় যেন অপচয় রোধ করা হয়।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এবারের বাজেটে মোটা দাগে পাঁচটি চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এগুলো হচ্ছে- মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, কর্মসংস্থান বাড়ানো, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ স্থিতিশীল রাখা, বাজেট ঘাটতি কমানো, নতুন দারিদ্র্য ঠেকানো। এর মধ্যে বর্তমান মূল্যস্ফীতিকে অর্থনীতির প্রধান চ্যালেঞ্জ মনে করছেন অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞরা। তাদের পরামর্শ, সাধারণ মানুষের ওপর মূল্যস্ফীতির চাপ সহনীয় পর্যায়ে রাখা কিংবা মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে আগামী অর্থবছরের বাজেটের মূলনীতি হিসেবে দেখা উচিত। নতুন অর্থবছরের বাজেটে সামনের দিনগুলোর জন্য যে বেশ বড় চ্যালেঞ্জ রয়েছে, এর আভাস দিয়েছেন খোদ অর্থমন্ত্রীও।

সম্প্রতি অর্থমন্ত্রী বলেছেন, আগামী বাজেট কারো জন্য কোনো ধরনের খারাপ বার্তা বয়ে আনবে না। সবাই সন্তুষ্ট থাকবে। অর্থমন্ত্রীর আশ্বসে আগামী বাজেটে স্বস্তির খবর থাকলেও সরকারের জন্য বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াতে পারে। এর মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন খাতে ভর্তুকি দেয়া। একই সঙ্গে বৈদেশিক ঋণের সুদ পরিশোধ করা। তবে অর্থ বিভাগের দাবি, বৈদেশিক ঋণের সুদ পরিশোধের অর্থ খুব বেশি বাড়বে না। চলতি অর্থবছরের মতো থাকতে পারে।

মূলত করোনা, ইউক্রেন যুদ্ধ ও দেশীয় দুর্নীতি- এ তিনটি বিষয় সরাসরি বাংলাদেশের অর্থনীতিকে ঋণাত্মক চাপে ফেলেছে। মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি, জিডিপির ভালো প্রবৃদ্ধি সাধারণ নাগরিকদের স্বস্তি দিচ্ছে না। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বাজেটকে এক বছরের সাধারণ আয়-ব্যয়ের হিসাব হিসেবে দেখলে চলবে না। বাজেট বাস্তবায়ন নীতি স্পষ্ট থাকা দরকার, আর দরকার দুর্নীতি প্রতিরোধ, অর্থ পাচার রোধ এবং প্রবৃদ্ধির সুফল যেন সবাই পায় তার জন্য নীতি নির্ধারণ।

একাদশ জাতীয় সংসদের বাজেট অধিবেশন শুরু হয়েছে গত রবিবার। আজ বৃহস্পতিবার বিকাল ৩টায় অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল জাতীয় সংসদে ২০২২-২০২৩ অর্থবছরের জাতীয় বাজেট প্রস্তাব উপস্থাপন করবেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকারের টানা তৃতীয় মেয়াদের চতুর্থ এ বাজেটের সম্ভাব্য আকার ৬ লাখ ৭৭ হাজার ৮৬৪ কোটি টাকা। আগামী বাজেটে প্রাধিকার পাবে দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী। ‘কোভিডের অভিঘাত পেরিয়ে উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় প্রত্যাবর্তন’ শিরোনামের এবারের বাজেটটি প্রস্তুত হয়েছে সরকারের অতীতের অর্জন এবং উদ্ভ‚ত বর্তমান পরিস্থিতির সমন্বয়ে।

বাজেট প্রস্তাব পেশের আগে জাতীয় সংসদ ভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে মন্ত্রিপরিষদের বিশেষ সভায় খসড়া বাজেট প্রস্তাবটি অনুমোদিত হবে।

অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, বর্তমান সরকারের এবারের মেয়াদে এটি একটি পূর্ণাঙ্গ শেষ বাজেট। কারণ আগামী বছরের জুনে যে বাজেট পেশ হবে, সেটি হবে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের। ২০২৩ সালের ১ জুলাই শুরু হওয়া এ অর্থবছর শেষ হবে ২০২৪ সালের ৩০ জুন। এর কমপক্ষে ৬ মাস আগে ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে অথবা ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে দেশে অনুষ্ঠিত হবে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। সেই বিবেচনায় বর্তমান সরকার এবারই পুরো বাজেট বাস্তবায়নের সুযোগ পাচ্ছে। ফলে সরকার এবারের বাজেটে ব্যাপক কর্মসৃজনের বিষয়ে গুরুত্ব দিতে চাচ্ছে। এজন্য নতুন জিডিপির ৩১ দশমিক ৫ শতাংশ ধরা হয়েছে বিনিয়োগের লক্ষ্যমাত্রা। এর মধ্যে বেসরকারি বিনিয়োগ ২৪ দশমিক ৯ শতাংশ এবং সরকারি বিনিয়োগ ৬ দশমিক ৬ শতাংশ।

দেশের শীর্ষস্থানীয় গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান ভোরের কাগজকে বলেন, সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে মূল্যস্ফীতির এ সময়ে শুল্ক সমন্বয় করা। তাৎক্ষণিকভাবে এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আগামী অর্থবছরের বাজেটে অগ্রাধিকার দেয়া উচিত। তিনি বলেন, নিত্যপণ্যের শুল্ক-কর কমানো হলে দাম কিছুটা কমতে পারে। আবার ন্যায্যমূল্যে নিত্যপণ্য বিক্রির জন্য ওএমএস কার্যক্রম বিস্তৃত করা এবং গরিব মানুষের জন্য সরাসরি নগদ সহায়তা কর্মসূচির আওতা বাড়ানোরও সুপারিশ করেন তিনি।

তিনি বলেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে সরকার নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ওপর থেকে শুল্ক কর-ভ্যাট কমানোর পাশাপাশি বিলাসপণ্য আমদানি নিরুৎসাহিত করার জন্য যে পদক্ষেপ নিয়েছে, সেটি ইতিবাচক। এছাড়া বৈদেশিক মুদ্রা বাজার স্বাভাবিক রাখতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজারে ডলার ছাড়ছে, এটিও অব্যাহত রাখতে হবে। তিনি বলেন, বর্তমানে বৈদেশিক মুদ্রার যে মজুত রয়েছে, সেটি কোনোভাবেই শঙ্কাজনক নয়। তাই বাজারে যেন ডলার সংকটের কোনো স্পেকিউলেশন তৈরি না হয়, সেজন্য প্রয়োজন মাফিক ডলার বিক্রি অব্যাহত রাখাটা জরুরি। তিনি ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন করা সরকারের সময়োচিত ভালো পদক্ষেপ বলে বর্ণনা করেন।

মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, সামাজিক সুরক্ষা দিয়ে প্রান্তিক মানুষকে কতটুকু সহযোগিতা করবে এটিও একটি অন্যতম চ্যালেঞ্জ। সাধারণ মানুষ যেহেতু চাপের মধ্যে আছে, সেহেতু কীভাবে তাদের একটু সহায়তা দেয়া যায়, সে বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে। বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। অন্যদিকে ব্যয়টা কীভাবে সাশ্রয়ী করা যায় সেটি ভাবতে হবে। এছাড়া ভর্তুকি সমন্বয় করবে, না ভর্তুকি বাজেট বেশি রেখে বাজেটে অন্য কোনো প্রস্তাব দিবে। তিনি বলেন, বাজেট কেমন হবে তা আমরা জানি না। তবে আয়করের দিকে হয়তো কোনো পরিবর্তন হবে না। কিছু কর্পোরেট ট্যাক্স কমানোর চাপ থাকবে। বছরের পর বছর যেগুলো রিফরমস আছে ডিরেক্ট ট্যাক্স অ্যাক্ট, কাস্টমস অ্যাক্ট ইত্যাদি রিফরমসে জোড় দিতে হবে। কারণ এখন সম্পদ আহরণ করা দরকার।

অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, এবারের বাজেট মোট জিডিপির ১৫ দশমিক ৪ শতাংশ। আগামী অর্থবছরের জন্য মোট রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ৪ লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকা, যা জিডিপির ৯ দশমিক ৮ শতাংশ। এটি চলতি অর্থবছরের তুলনায় ৪৪ হাজার কোটি টাকা বেশি। এ হিসাবে নতুন অর্থবছরে বাজেট ঘাটতি দাঁড়াবে ২ লাখ ৪৪ হাজার কোটি টাকার কম-বেশি। যা মোট জিডিপির ৫ দশমিক ৫ শতাংশ।

বাজেট ঘাটতি মেটাতে সরকার দেশের অভ্যন্তর থেকে ১ লাখ ২৮ হাজার ৩৪১ কোটি টাকা এবং বিদেশ থেকে ঋণ নেবে ১ লাখ ১৬ হাজার ৫২৩ কোটি টাকা। অভ্যন্তরের উৎস হিসেবে ব্যাংক ঋণ নেয়া হবে ৯৩ হাজার ৮৮৯ কোটি টাকা। বাকিটা আসবে সঞ্চয়পত্র থেকে। এবারের বাজেটে সর্বোচ্চ গুরুত্বারোপ করা হবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ। সেই সঙ্গে নতুন করে আরো ১১ লাখ মানুষকে সামাজিক সুরক্ষায় আওতায় আনার পরিকল্পনা করছে সরকার।

সূত্র মতে, করোনার কারণে গত দুই অর্থবছর দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য মন্দা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছে। বিশ্ব বাজারে জ্বলানি ও সারের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে সরকারের ভর্তুকির পরিমাণও এবার বাড়াতে হচ্ছে। ভর্তুকির এ অর্থ জোগাতে এবার রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। আগামী ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে এনবিআর বহির্ভূত রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১৮ হাজার কোটি টাকা। করবহির্ভূত রাজস্ব (এনটিআর) আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ৪৫ হাজার কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটে এ দুই খাতে আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা হচ্ছে যথাক্রমে ১৬ হাজার কোটি টাকা ও ৪৩ হাজার কোটি টাকা। সে হিসাবে নতুন বাজেটে আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা বাড়ছে যথাক্রমে ১৩ শতাংশ ও ৫ শতাংশ।

চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরে বাজেটের আকার ছিল জিডিপির ১৭ দশমিক ৫ শতাংশ। এক বছরের ব্যবধানে সরকারের জিডিপির অংশ হিসেবে বাজেটের আকার ২ শতাংশ কমিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। নতুন অর্থবছরে বাজেট ঘাটতি থাকবে প্রায় আড়াই লাখ কোটি টাকা। এ অর্থবছরের জন্য জিডিপির প্রাক্কলন হয়েছে ৪৪ লাখ ১২ হাজার ৮৪৯ কোটি টাকা। মূল্যস্ফীতি ধরা হচ্ছে ৫ দশমিক ৫ শতাংশ।

বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) পরিচালক মো. খসরু চৌধুরী বলেন, বিশ্বে এক ধরনের অস্থিরতা বিরাজ করছে এটি মাথায় রাখতে হবে। সেই সঙ্গে আমাদের ব্যবসা যাতে ধসে না পড়ে, আমাদের ব্যবসা যাতে বন্ধ হয়ে না যায়, সে দিকটি মাথায় রেখে বাজেট করলে সবার জন্য ভালো হবে।

দয়া করে খবরটি শেয়ার করুন

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

এই ক্যাটাগরিতে আরো যেসব খবর রয়েছে
All rights reserved © UKBDTV.COM
       
themesba-lates1749691102