টাঙ্গাইলের মধুপুর মনোমুগ্ধকর জীববৈচিত্র্য সমৃদ্ধ একটি প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী ভারতের পত্রঝরা বনাঞ্চল হিসাবে সমধিক পরিচিত । টাঙ্গাইলের মধুপুর উপজেলায় বনভূমির পরিমাণ ৪৫ হাজার ৫৬৫ দশমিক ১৮ একর। এই বনভূমির এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি বনভূমি উপজাতি ও রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে প্রভাবশালীরা দখল করে রেখেছে। তার বেশিরভাগ জমিই স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও আদিবাসী নেতারা দখল করেছেন।যার ফলে বনভূমির ১৫ হাজার একরের বেশী বনভূমি হাতছাড়া হয়ে গেছে বন বিভাগের, জবরদখলকারীরা উপজাতিদের ব্যবহারকরে দীর্ঘদিন যাবত ওই ভূমি ভোগদখল করে আসছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।বনভূমির সংরক্ষিত বনের পরিমাণ ১১ হাজার ৬৭১ দশমিক ২১ একর ও সংরক্ষিত বনের বাইরে জমির পরিমাণ ৩৩ হাজার ৮৯৩ দশমিক ৯৭ একর। এর মধ্যে অবৈধ দখলে রয়েছে ১৫ হাজার ৩৭৯ দশমিক ১৪ একর জমি অবৈধ দখলদারের সংখ্যা প্রায় ৩০ হাজার। মধুপুর বন দখলে আওয়ামী লীগ-বিএনপি নেতা, ব্যবসায়ী, আইনজীবী, দলিল লেখক, সমাজকর্মীসহ কেউই বাদ যায়নি। দখল করে নির্মাণ করা হয়েছে করাতকল,হাটবাজার, বাড়িঘর ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। কোথাও চাষ করা হচ্ছে কলা, আনারস, ড্রাগন ও লেবু।
বনভূমি দখলের ক্ষেত্রে বন বিভাগের কিছু কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অবহেলা, উদাসীনতা এবং অনৈতিক সুবিধা নেওয়ার গুরুতর অভিযোগ রয়েছে। নানা প্রক্রিয়ায় তারা বনের জমি অবৈধভাবে ভোগদখলের সুযোগ করে দিয়েছেন স্থানীয় প্রভাবশালীদের । দেশ বাংলা ‘র অনুসন্ধানে, বন বিভাগের বনভূমি জবরদখল ও উদ্ধার সংক্রান্ত প্রতিবেদনের তথ্য থেকে জানা গেছে, মধুপুরের জামগাছা গ্রামের আওয়ামী লীগের নেতা হিসেবে পরিচিত আইজউদ্দিন মণ্ডল দোখলা রেঞ্জের চাঁদপুর বিটের ফুলবাগচালা মৌজার প্রায় ৩০০ একর সংরক্ষিত বনের জমি দখল করে রেখেছেন। এ ছাড়া ফুলবাগচালার ২০০ একর বাঘাডোবার আওয়ামী লীগ নেতা নস্কর মেম্বার, ১০০ একর জামাল উদ্দিন, ৫৩ একর বাঘাডোবার আওয়ামী লীগ নেতা ময়নাল মেম্বার, ৫২ একর সুরেনটাল গ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা রেফাজ উদ্দিন, ৪০ একর সুরেনটালের আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল আজিদ, ৩৫ একর সুরেনটালের প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল মজিদ দখল করেছেন। অন্যদিকে হাগড়াকুড়ি গ্রামের বিএনপি নেতা হিসেবে পরিচিত সাদেক আলী দোখলা রেঞ্জের চাঁদপুর বিটের জোরামগাছার ২০ একর, থানারবাইদের স্থানীয় আদিবাসী নেতা রাগেন্দ্র নকরেক দোখলা বিটের পীরগাছার ২৫০ একর বনভূমি দখল করেছেন।
অরনখোলার ৭০ একর চুনিয়ার বাবুল মৃ, ৫৫ একর চুনিয়ার টমাস নকরেক, ৩৫ একর মধুপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি, শোলাকুড়ি ইউপি চেয়ারম্যান এবং বন ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি ইয়াকুব আলী নিজেই, ৩০ একর কাইল্যা কুড়ি গ্রামের আদিবাসী নেতা প্রীতিনাশ নকরেক দখলে রেখেছেন।
টাঙ্গাইল জেলা কৃষক দলের সহসভাপতি আমলীতলা গ্রামের লস্কর মেম্বার জাউস রেঞ্জের গাছাবাড়ি বিটের ১৬ একর, হাগড়াকুড়ি গ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা ওহাব সরকার জোরামগাছার ১৫ একর, হাগড়াকুড়ির আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল হামিদ ২০ একর, আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল করিম ২০ একর, অরনখোলার জাউস রেঞ্জের গাছাবাড়ি বিটের আওয়ামী লীগ নেতা হযরত আলী ৮১ একর, গাছাবাড়ির চানমাহমুদ ছানা ৫১ একর, টেলকি শাখার ট্রাক ড্রাইভার্স ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক সাধুপাড়ার প্রশান্ত মানকিন লহরিয়া বিটের প্রায় ৫০ একর, মধুপুরের কলাচাষি সংগঠনের সভাপতি ও আওয়ামী লীগ নেতা গেছুয়াগ্রামের আবদুর রহিম বেরিবাদ বিটের ৩৪.৫০ একর, মাগন্তিনগরের বিজিত টিটো ৩০ দশমিক ১০ একর, অরনখোলা ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি গাছাবাড়ির মজিবর রহমান ২৯.৫০ একর জমি দখল করে রেখেছেন।
তিনি মধুপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান সরোয়ার আলম খান আবুর আত্মীয় পরিচয় দিয়ে জমি দখলে নিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
এছাড়া চুনিয়ার মোতালেব হোসেনের দখলে রয়েছে ৯.৭৫ একর জমি। অরনখোলা সদর বিটের প্রায় পাঁচ একর জমি দখল করেছেন স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা হিসেবে পরিচিত আবদুস ছালাম, নুরু মিয়া, আবদুল খালেক, কাদের, মুক্তার হোসেন ফকির, আক্তার হোসেন ফকির, আছকের আলী, আজিজুল হক শহিদ ও আবদুর রহিম।সংরক্ষিত বনভূমির বাইরেও অন্য শ্রেণিভুক্ত মধুপুর রেঞ্জের চাড়ালজানি বিটের চুনিয়া মৌজায় বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্যুরো বাংলাদেশ ৬ দশমিক ৮৫ একর, কাকরাইদের ইয়রুন নেছা ৩০ একর, গাছাবাড়ির সরাফত আলী ২ দশমিক ৩০ একর, সোহরাব আলী ২ দশমিক ৩০ একর, কাঠ ব্যবসায়ী আবদুল কাদের মিয়া তিন একর, দিগলবাইদের ব্যবসায়ী আবদুর রহিম ২ দশমিক ৯ একর, জাঙ্গালিয়ার ব্যবসায়ী আজিজ খাঁ প্রায় ৯ একর, দলিল লেখক নুরু মিয়া প্রায় ১২ একর, মাগন্তিনগরের বাদশা মিয়া প্রায় ২০ একর, নয়াপাড়া গ্রামের আফতাবউদ্দিন প্রায় পাঁচ একর জমি জবরদখল করে রেখেছেন।
সরেজমিন বন বিভাগ ও স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মোটের বাজারের ছামান আলী বন বিভাগের জমি কার্টিজ মূলে কিনে মাটি ভরাট করে দখল করেছেন। এভাবে আরও অনেকেই বনের জমি দখল করে নিচ্ছেন। কর্তৃপক্ষের নজরদারির অভাবে স্থানীয় প্রভাবশালীরা বসতি নির্মাণ করে বনের জমিকে নিজের বলে দাবি করে থাকে। দখলদারদের কেউ কেউ বন বিভাগের বিরুদ্ধে মামলাও করেন। বন বিভাগের জায়গা দখল করে ভুয়া দলিল ও কাগজপত্র তৈরি করে অন্যের কাছে বিক্রি করে দেওয়ার অভিযোগও রয়েছে বেশকিছু লোকজনের বিরোদ্ধে। দখলদাররা আইনি ঝামেলা এড়াতে কৌশলে জমি খোলা স্ট্যাম্পে বিক্রি করে দেন। বন বিভাগও জমি উদ্ধার করতে হাজার হাজার মামলা করেছে। কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। এ ছাড়া নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে উচ্ছেদ অভিযানও করতে পারেনি। তবে কয়েকজন দখলদার দাবি করেন, সংরক্ষিত বনের বাইরে ৪ ও ৬ ধারার জমি সিএস পর্চামূলে তারাই মালিক। এসএ ও আরএসে মালিক বন বিভাগ। যখন সরকার রায় পাবে তখন তারা বন বিভাগের জমি ছেড়ে দেবেন।
শোলাকুড়ি ইউনিয়নে চেয়ারম্যান,মধুপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি এবং স্থানীয় বন ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি ইয়াকুব আলী বলেন, ওই জমির মধ্যে কিছু জমি তাদের পৈত্রিক সম্পত্তি। তবে বেশ কিছু জমিতে বন বিভাগ সামাজিক বনায়ন করেছে। সব জমিতে সামাজিক বনায়ন করলে তাদের কোনো আপত্তি থাকবে না। অরনখোলা ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি মজিবর রহমান বলেন, বন বিভাগ ওই জমি ১০ বছরের জন্য তাকে প্লট করে দিয়েছে। তার দলিলও রয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে তারা ওই জমি ভোগদখল করে আসছেন। টাঙ্গাইল জেলা কৃষক দলের সহসভাপতি লস্কর মেম্বার বলেন, স্ত্রী, ছেলে ও তার নামে সামাজিক বনায়নের জন্য ১২ একরের তিনটি প্লট রয়েছে। সরকার চাইলেই ফেরত দিয়ে দেবেন।
মধুপুর জয়েনশাহী আদিবাসী উন্নয়ন পরিষদের সভাপতি ইউজিন নকরেক বলেন, বহুকাল থেকে তারা এখানে বসবাস করছেন। তারা তাদের স্বত্ব দখলীয় ভূমির স্বীকৃতি চান। তারা বনের জমি দখল করেননি দাবি করে তিনি বলেন, সরকার যখন প্রাকৃতিক বন কেটে সামাজিক বনায়ন কর্মসূচি শুরু করে তখন প্লট বরাদ্দের নামে বহিরাগতদের বৈধভাবে বনের ভেতরে অনুপ্রবেশের সুযোগ করে দেয়। তখন তারা প্রভাব খাটিয়ে ও বন কর্মকর্তাদের আর্থিক সুবিধা দিয়ে শত শত একর জমি দখল করেছে। বন বিভাগ পারলে তাদের উচ্ছেদ করুক। এদিকে বন এলাকার ১০ কিলোমিটারের মধ্যে স মিল স্থাপনের বিধান না থাকলেও বন বিভাগের গুটিকয়েক কর্মকর্তাকে অনৈতিক সুবিধা দিয়ে অনুমোদনহীনভাবে চলছে অনেকগুলি স মিল। এসব মিলে দিনরাত চলছে বনের কাঠ চেরাই। চুরি হচ্ছে বনের গাছ। বন বিভাগের নজরদারির অভাবে বিভিন্ন প্লটের গাছ কেটে নেওয়া হচ্ছে।
হাজীপাড়া এলাকার খোরশেদ আলম জানান, ওমর ফারুক মহিষমারা বিটের বনায়ন ব্যবস্থাপনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক। সামাজিক বনায়ন ব্যবস্থাপনা কমিটির দায়িত্বে থেকেও তিনি অবাধে গাছ কেটে সামাজিক বনায়নের বৃক্ষ উজাড় করছেন। তবে ওমর ফারুক এ অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, অংশীদার খোরশেদ আলম আসবাবপত্র বানানোর জন্য তার কাছে গাছ চেয়েছিলেন বলে গাছ কাটা হয়েছে। গাছ চাইলেই সরকারি গাছ কাটতে পারেন কিনা- এমন প্রশ্নের জবাব দেননি তিনি। ওমর ফারুক আওয়ামী লীগের নেতা হওয়ায় তার বিরুদ্ধে স্থানীয়রা মুখ খুলতে সাহস পায় না। তার বিরুদ্ধে একাধিক বন মামলাও রয়েছে। পরিবেশবাদীদের মতে, প্রাকৃতিকভাবে তৈরি বনাঞ্চল পরিবেশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রাকৃতিকভাবে জন্মানো গাছগুলো পরিবর্তন করে ব্যাপক হারে নতুনভাবে লাগানো গাছ পরিবেশের ভারসাম্য ও ইকো সিস্টেম নষ্ট করে দেয়। এতে করে অনেক উপকারী উদ্ভিদ ও প্রাণী বিলুপ্ত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়। প্রাকৃতিকভাবে তৈরি বনাঞ্চলগুলোকে তাদের মতো করে বাড়তে দেওয়া উচিত। পরিবেশের ভারসাম্য টিকিয়ে রাখতে দখলকারীদের হাত থেকে বনের জমি উদ্ধারের বিকল্প নেই। একটি সূত্র জানিয়েছে, বনভূমির জায়গা দখলে নিতে প্রভাবশালীরা উপজাতীয়দের ব্যবহার করছে। তারা উপজাতিদের দিয়ে প্রথমে বনভূমি দখল করেন এবং পরবর্তীতে ওই জবরদখলকৃত জায়গা উপজাতিদের কাছ থেকে সামান্য পরিমান টাকা পয়সা দিয়ে কার্টিজ পেপার বা ননজুডিশিয়াল স্টাম্পে স্বাক্ষর নিয়ে নিজেরা ভোগদখল করে থাকেন। আবার বনবিভাগ যখন তাদের জবরদখলকৃত জায়গা উদ্ধারে তৎপর হয়, তখন ওই প্রভাবশালীরা উপজাতিদের সংগঠিত করে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধে উদ্বুদ্ধ করে থাকেন। উপজাতিদের ব্যবহার করায় মানবাধিকার সংগঠন ও সুশিলসমাজ উপজাতিদের পক্ষ নেওয়ার ফলে বন বিভাগ বিরম্বনায় পড়েন। টাঙ্গাইল বন বিভাগের বিভাগীয় কর্মকর্তা মোঃ সাজ্জাদুজ্জামান বলেন, বন বিভাগের জবরদখলমুক্ত করতে বন বিভাগের কর্মচারী, কর্মকর্তাদের সদিচ্ছার অভাব নেই। কিন্তু বিশাল এই বনভূমিতে জনবল সংকটের কারণে ইচ্ছা থাকলেও অনেক কিছু করা যায় না। এর ওপর তো আছে রাজনৈতিক চাপ। এ কারণে অনেকেই দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। । যে কোনো মূল্যে বনের জমি উদ্ধার করতে আমরা তৎপর আছি । বনভূমি দখলে সহযোগিতার ক্ষেত্রে বন বিভাগের কোনো কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলে তা খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।