এম শাহজাহান মিয়া: আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, আওয়ামী লীগ নিজেদের ভাগ্য গড়তে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নেয়নি, বরং এ দল যখনই সরকারে এসেছে, দেশের মানুষের উন্নতি হয়েছে। তিনি বলেন, এদেশের যা কিছু অর্জন, তা আওয়ামী লীগের হাত ধরে। বাংলাদেশের মানুষ যথেষ্ট সচেতন। তারা জানে আওয়ামী লীগের নৌকা মার্কা। এবার বন্যায়ও তো নৌকার জন্য হাহাকার। নৌকা ছাড়া তো গতি নাই বাংলাদেশে- এটাও মনে রাখতে হবে। অন্যদিকে বিএনপি নেতৃবৃন্দের প্রতি এদেশের যে ধারণা হয়েছে, তাতে জনগণ তাদের গ্রহণ করবে না বলেও মন্তব্য করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, বিএনপি মিথ্যার কারখানা।
গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের ৭৩তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আলোচনাসভায় সভাপতির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে সভায় যুক্ত হন। এতে দলের সভাপতিম-লীর সদস্য মতিয়া চৌধুরী, জাহাঙ্গীর কবির নানক, আব্দুর রহমান, মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া বীরবিক্রম, এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন, দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ, আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক ড. শাম্মী আহমেদ, কেন্দ্রীয় সদস্য পারভীন জামান কল্পনা, মহানগর উত্তর সভাপতি শেখ বজলুর রহমান ও দক্ষিণের সভাপতি আবু আহমেদ মান্নাফী প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। গণভবন থেকে আলোচনা অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক ড. আবদুস সোবহান গোলাপ।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বাংলাদেশের ইতিহাস আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে যদি দেখা যায়, আজ পর্যন্ত এদেশের মানুষের যতটুকু অর্জন, সবটুকুই আওয়ামী লীগের হাতে। আওয়ামী লীগ যখনই সরকারে এসেছে, এদেশের মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটেছে। ১৯৯৬ সালে সরকারে এসে আমরা যতটুকু অর্জন করতে পেরেছিলাম, ২০০১-এ বিএনপি ক্ষমতায় এসে সবই নস্যাৎ করে বাংলাদেশকে জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস ও দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন করেছিল।’ তিনি বলেন, ‘খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী থাকার সময় পাঁচ পাঁচ বার বাংলাদেশ দুর্নীতিতে এক নম্বর চ্যাম্পিয়ন। সেই ভাবমূর্তি বাংলাদেশের জন্য কতটা অসম্মানজনক!’ সেই অবস্থারও পরিবর্তন আওয়ামী লীগ করেছে মন্তব্য করে শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশকে এখন বিশ্বে একটা সম্মানজনক স্থানে আমরা নিয়ে গেছি। বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের রোল মডেল এবং উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা আমরা পেয়েছি।
এ দেশের প্রাণ-প্রকৃতি নিয়ে আওয়ামী লীগের ‘ভালো জানাশোনা’ আছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, দেশটা আমাদের। এদেশের প্রকৃতি, এদেশের পরিবেশ, এদেশের মানুষ, মানুষের কল্যাণ আওয়ামী লীগ যতটা বুঝবে; অন্যরা তা বুঝবে না। বুঝবে কী করে? বিএনপির মনেই আছে পাকিস্তান। দিল মে হ্যায় পেয়ারে পাকিস্তান। সারাক্ষণ ওই গুনগুন করে গানই গায়।… আঁখো কি তারা, আসমান কি চাঁন। মেরে জান, পাকিস্তান।’ এই হলো খালেদা জিয়ার কথা।
এ ধরনের মানসিকতা যাদের, তাদের বাংলাদেশের ভালো না চাওয়াটাই স্বাভাবিক মন্তব্য করে আওয়ামী লীগ সভাপতি দলের নেতাকর্মীদের উদ্দেশে বলেন, ‘এটা নিয়ে আপনাদের এত দুঃখ করার, চিন্তা করার কিচ্ছু নাই। আর ওদের কথা যতটা না বলা যায়, ততটাই ভালো। কারণ ওরা বাংলাদেশের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে না। বরং এগুলোকে সবগুলোকে গাট্টি বাইন্ধা পাকিস্তানে পাঠায় দিলেই ভালো হয়। কারণ পাকিস্তানের এখন যা অবস্থা ওখানে থাকলেই তারা ভালো থাকবে। এখনো লাহোরে সোনার দোকানে খালেদা জিয়ার বড় ছবি আছে, ওই দোকানের সোনার গহনা তার খুব প্রিয়। তাদের মানসিকতা ওই দিকেই, আমাদের বাংলাদেশের জন্য না।’ জিয়াউর রহমান, খালেদা জিয়া, এইচএম এরশাদ- কারও জন্মই বাংলাদেশে নয় বলেও প্রধানমন্ত্রী মন্তব্য করেন।
শেখ হাসিনা বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারে থাকুক বা বিরোধী দলে থাকুক, সব সময় দুর্যোগ-দুর্বিপাকে সবার আগে মানুষের পাশে থাকতে ছুটে গেছে এবং সহযোগিতা করেছে। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই আওয়ামী লীগ জনগণের সেবা করে। জনগণের সেবক। জনগণের পাশে থাকে এবং জনগণের পাশেই থাকবে; সেই আদর্শই আমাদের জাতির পিতা শিখিয়েছেন আর সেই আদর্শ নিয়েই আওয়ামী লীগ চলবে।
মানুষের বিশ্বাসই আওয়ামী লীগের শক্তি মন্তব্য করে সরকারপ্রধান বলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতার চেতনা প্রত্যেকটা- যা ওই জিয়াউর রহমান ক্ষমতা দখল করে নিষিদ্ধ করেছিল, একে একে আমরা সব ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় আমাদের এই দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। ইনশাল্লাহ এই দেশ উন্নত, সমৃদ্ধ সোনার বাংলা হিসেবে বিশ্বদরবারে মাথা উঁচু করে চলবে। অর্থসম্পদ আজীবন থাকে না, সেই কথা মনে রেখে জাতির পিতার আদর্শ বুকে ধারণ করে ‘জনগণের সেবক’ হিসেবে কাজ করতে দলীয় নেতাকর্মীদের নির্দেশ দেন শেখ হাসিনা।
তিনি বলেন, অনেক অর্থ থাকলেও কিছু আসে-যায় না, এবার করোনার সময় অনেক বিত্তশালীও টের পেয়েছে। কাজেই সেটা মাথায় রেখেই জনগণের সেবক হিসেবে কাজ করবে আওয়ামী লীগের প্রত্যেকটা নেতাকর্মী, জাতির পিতার আদর্শ মেনে চলবে।
গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বিষয়ে শেখ হাসিনা বলেন, সেই নির্বাচনে বিএনপি মনোনয়ন-বাণিজ্য করেছিল। নেতৃত্বশূন্য একটা দল ইলেকশন করবে, জনগণ ভোট দেবে কী দেখে? ওই চোর, ঠকবাজ, এতিমের অর্থ আত্মসাৎ করা, খুন, অস্ত্র চোরাকারবারি, সাজাপ্রাপ্ত আসামি- তাদের এ দেশের জনগণ ভোট দেবে এ দেশ চালানোর জন্য? তা তো এ দেশের জনগণ দেবে না। বাংলাদেশের মানুষ এ ব্যাপারে যথেষ্ট সচেতন। তারা জানে আওয়ামী লীগের নৌকা মার্কা। এবার বন্যায়ও তো নৌকার জন্য হাহাকার। নৌকা ছাড়া তো গতি নাই বাংলাদেশে- এটাও মনে রাখতে হবে।
বিএনপির বিরুদ্ধে মিথ্যাচারের অভিযোগও আনেন শেখ হাসিনা। বলেন, মিথ্যা কথা বানানো আর মিথ্যা কথা বলার যদি কারখানা থেকে থাকে, সেটা হলো বিএনপি। তারা মিথ্যা কথা বানানো, বলতে খুব ভালো পারে। আমাদের কিছু লোক সেটা বিশ্বাস নিয়ে বসে থাকে।
সরকারপ্রধান উল্লেখ করেন, আমরা পদ্মা সেতু করেছি আমাদের নিজস্ব অর্থায়নে। এটা নিয়েও প্রশ্ন তোলে। বিএনপি আবার প্রশ্ন তোলে কোন মুখে, যাদের আপাদমস্তক দুর্নীতিতে ভরা? এতিমের অর্থ আত্মসাৎ করে সাজা পেয়েছেন খালেদা জিয়া। শুধু এতিমের অর্থ কেন, নাইকো, গ্যাটকো- এ রকম বহু কেস ঝুলে আছে। ওই কেসে সে তো কখনো কোর্টেই যেতে চায়নি। প্রত্যেকটা প্রজেক্টে দুর্নীতি করে তারা টাকা বানিয়েছে। তারেক জিয়া, খালেদা জিয়া, কোকো সবই তো।
যমুনা সেতু নির্মাণের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, ‘খালেদা জিয়া ক্ষমতায় এসে খুব বেশি এগোতে পারেননি। কারণ, সব জায়গায় তো কমিশন খাওয়ার অভ্যাস। আবার কমিশন তো একজনকে দিলে হবে না। মায়ের জন্য একটা, দুই ছেলের জন্য দুইটা, ফালুর জন্য একটা, অমুকের জন্য একটা- এই করতে করতে কেউ আর ওখানে কাজ করতে পারত না। এত ভাগে ভাগে তাদের কমিশন দিতে হতো। সেই কারণেই কোনো কিছু এগোতে পারেনি। আমরা ’৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে এই যমুনা সেতুতে রেললাইন, গ্যাসলাইন, বিদ্যুতের লাইন নিয়ে এটার ডিজাইনটা পাল্টে মাল্টিপারপাস ব্রিজ করে আমরাই তৈরি করি।’
সিলেট অঞ্চল ও উত্তরের বন্যায় বিএনপি দুর্গতদের পাশে দাঁড়ায়নি বলেও অভিযোগ করেন প্রধানমন্ত্রী। বলেন, তারা সেখানে না গিয়ে ঢাকায় বসে নানা কথা বলছে। আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, ‘আজ বন্যা হয়েছে, আজ পর্যন্ত কোনো বিএনপির নেতা বা কেউ কোনো সাহায্য দিয়েছে বন্যাবাসীদের? দেয়নি। ঢাকায় বসে বসে নানা কথা বলে বেড়াচ্ছে। কিন্তু আমাদের আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা এমন এমন দুর্গম এলাকায় গেছেন, যেখানে বন্যার পানির জন্য কেউ পৌঁছতে পারছে না। আওয়ামী লীগ ছাড়াও যুবলীগ, ছাত্রলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগও ত্রাণ বিতরণ করে যাচ্ছে। তারা মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছে, খাদ্য সাহায্য দিচ্ছে, উদ্ধার কাজ করছে।’
বানভাসি মানুষের পাশে সশস্ত্র বাহিনী, বিজিবি, কোস্টগার্ড, পুলিশ, প্রশাসন সবাইকেই নিয়োগ করা হয়েছে বলেও জানান প্রধানমন্ত্রী। বলেন, ‘তারা সবাই সেখানে কাজ করে যাচ্ছে। প্রতিনিয়ত উদ্ধার করা, চিকিৎসার ব্যবস্থা করা, খাদ্য দেওয়ায় সেখানে এতটুকু গাফিলতি নেই। ডে ওয়ান থেকে আমরা এই বানভাসি মানুষের পাশে আছি। বন্যা- এটা প্রাকৃতিক কারণেই বাংলাদেশে আসবে, হবেই। এর সঙ্গে আমাদের বসবাস করতে হবে।
আগামী সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বন্যা চলতেই থাকবে বলেও সতর্ক করেন প্রধানমন্ত্রী। বলেন, এই পানি আস্তে আস্তে নিচে যত নামতে থাকবে ধীরে ধীরে একেকটা এলাকা প্লাবিত হতে থাকবে। আমাদের সেই প্রস্তুতিও রাখতে হবে। এটা কিন্তু একেবারে ভাদ্র মাস পর্যন্ত চলবে। অর্থাৎ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চলতে পারে এই বন্যা। সেটা মাথায় রেখেই আমাদের কিন্তু প্রস্তুতি নিতে হবে। করোনা আবার বাড়ছে বলে সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি? মেনে চলার আহ্বানও জানান শেখ হাসিনা।
এর আগে সকালে ধানমন্ডি ৩২-এ জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে ফুলেল শ্রদ্ধা জানান আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। পরে দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতৃবৃন্দ ও সহযোগী সংগঠনের নেতৃবৃন্দ ফুলেল শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।
ইউকেবিডিটিভি/ বিডি / এমএসএম