সফিকুল ইসলাম: ঐতিহ্যবাহী দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ৭৩তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী আজ বৃহস্পতিবার। তবে এবারের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে বাড়তি আমেজ হিসেবে যুক্ত হচ্ছে পদ্মা সেতুর উদ্বোধনী উৎসব। এ দেশের সুদীর্ঘ রাজনীতি এবং বাঙালি জাতির আন্দোলন-সংগ্রামের গৌরবোজ্জ্বল ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক। প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী দলটির নেতৃত্বেই এদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয়। সব আন্দোলন-সংগ্রামে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেওয়া দলটির অর্জন পাহাড়সম। টানা তৃতীয়বারসহ চতুর্থ মেয়াদে ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ। দলটির সভাপতি শেখ হাসিনা টানা সাড়ে ১৩ বছর ধরে দেশের প্রধানমন্ত্রী। তার যোগ্য নেতৃত্ব দেশকে উন্নয়নের পথে এগিয়ে নিচ্ছে। অর্জনের এই ধারাবাহিকতায় এবারের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর একদিন পরেই যুক্ত হচ্ছে নতুন মাইলফলক। এক কথায় বলতে গেলে রোজগার্ডেনে জন্মগ্রহণের পর থেকে নানা লড়াই, সংগ্রাম, চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে দলটি এখন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায়।
বহুল প্রত্যাশিত পদ্মা সেতু উদ্বোধন হচ্ছে। তবে অমসৃণ দীর্ঘ এই চলার পথে আওয়ামী লীগের সামনে এসেছে নানা বাধা-বিপত্তি, দুর্যোগ-দুর্বিপাক। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা থেকে শুরু করে, সামরিক জান্তাদের রোষানল, নিষেধাজ্ঞা, হামলা-মামলাসহ কণ্টকাকীর্ণ দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হয়েছে। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী ঘিরে নানা কর্মসূচি হাতে নিয়েছে আওয়ামী লীগ। বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি ও সমাধিতে শ্রদ্ধা নিবেদন, আলোচনা সভা, আলোকচিত্র প্রদর্শনী, র্যালিসহ ব্যতিক্রমী আরও কিছু আয়োজন থাকবে। রাজধানীকে বর্ণিল সাজে সাজাবে আওয়ামী লীগ। বিভিন্ন স্থানে দলের ঐতিহ্য তুলে ধরে সাজসজ্জা করা হবে। প্রতিষ্ঠার স্মৃতিবিজড়িত রোজ গার্ডেন হয়ে নবাবপুর, নবাবপুর থেকে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে কেন্দ্রীয় কার্যালয় ও রাজধানীজুড়ে ঐতিহ্যের আলোয় সজ্জিত করে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর কর্মসূচি পালন করবে দলটি। তবে এবার দলটির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর সব কর্মসূচিতে থাকবে পদ্মা সেতুর উদ্বোধনী উৎসবের আমেজ। আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড থেকেও তৃণমূলে পাঠানো নির্দেশনাতেও এমনটাই বলা হয়েছে বলে জানা গেছে। একাধিক জেলা আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা জানান, এবার প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে আলোচনা সভা এবং জেলা-উপজেলা কার্যালয়কে সাজানোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। একইসঙ্গে সভায় আগামী ২৫ জুন স্বপ্নের পদ্মা সেতুর উদ্বোধন ঘিরেও নানা কর্মসূচি পালন করতে বলা হয়েছে ।
আওয়ামী লীগের কর্মসূচি: আওয়ামী লীগের ৭৩তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী যথাযোগ্য মর্যাদায় পালন করতে সংগঠনটির পক্ষ থেকে বিস্তারিত কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে।কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে-বৃহস্পতিবার সূর্যোদয়ক্ষণে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয় ও দেশব্যাপী দলীয় কার্যালয়ে জাতীয় ও দলীয় পতাকা উত্তোলন এবং সকাল ৮ টায় সীমিত পরিসরে স্বাস্থ্য সুরক্ষা বিধি মেনে ধানমন্ডিস্থ বঙ্গবন্ধু ভবনের সামনে রক্ষিত জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন। সকাল সাড়ে ১০টায় গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় চিরনিদ্রায় শায়িত জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমাধিতে আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করা হবে।
টুঙ্গিপাড়ার কর্মসূচিতে যথাযথভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য লে. কর্নেল (অব.) মুহাম্মদ ফারুক খান এমপি, কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সদস্য ইকবাল হোসেন অপু এমপি ও সৈয়দ আবদুল আউয়াল শামীম উপস্থিত থাকবেন। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ১০ টায় বঙ্গবন্ধু এভিনিউস্থ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে দলের পক্ষ থেকে এক আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছে। আলোচনা সভায় ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে গণভবন থেকে সভাপতির বক্তব্য রাখবেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
নানা চ্যালেঞ্জ ও ষড়যন্ত্রে আওয়ামী লীগ: প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী প্রসঙ্গে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন সামনের দিনগুলোতেও নানা চ্যালেঞ্জ ও ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করেই এগিয়ে যেতে হবে আওয়ামী লীগকে। তাদের মতে, অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা রক্ষা ক্ষমতাসীন দলটির অন্যতম চ্যালেঞ্জ। পাশাপাশি দুর্নীতিমুক্ত দেশ এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠার বিষয়েও মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দেওয়া দল আওয়ামী লীগকেই কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। এ ছাড়া করোনার ধাক্কা না কাটতেই নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের অসহনীয় মূল্যবৃদ্ধিতে মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে। সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বন্যা। এগুলো মোকাবিলায় কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে আওয়ামী লীগকেই। পাশাপাশি দলকে তৃণমূল পর্যন্ত আরও সুসংগঠিত করে আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে হবে তাদের। সবার আস্থা অর্জন করে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের দায়ও আওয়ামী লীগেরই বেশি। তবে নেতারা বলছেন, যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবিলা করে তারা এগিয়ে যাবেন। ঢাবির সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাকালীন লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল বাঙালির তথা বাংলাদেশের মানুষের উন্নয়ন ও কল্যাণ। আমরা চাই সেই লক্ষ্যে দলটি এগিয়ে যাক। কিন্তু ইতিহাস থেকে দেখা গেছে এই দলের বাইরে তো তাদের শত্রু আছেই, এমনকি ভেতরেও অনেক শত্রু ঘাপটি মেরে আছে। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড তার প্রমাণ। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কাজ করেছে খন্দকার মোশতাক, তাহেরউদ্দিন ঠাকুর; তারাই বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিল। তিনি বলেন, আমি মনে করি, আজ আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ যারা আছেন, তাদেরকেও সেই ব্যাপারে খুবই সতর্ক থাকতে হবে। একইসুরে কথা বলেছেন সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া দল। তাই তাদের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব আছে। আমাদের স্বাধীনতার যে ঘোষণা আছে, আমাদের সংবিধানের যে অঙ্গীকার আছে, যেমন মানুষের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, সাম্য, ন্যায়বিচার, মানবিক মর্যাদা, এগুলো আমাদের দেশের ‘ফাউন্ডিং প্রিন্সিপাল’। দুর্ভাগ্যজনকভাবে জাতি হিসেবে আমরা এগুলো থেকে বিচ্যুত হয়ে গেছি। আমাদের প্রত্যাশা, স্বাধীনতার নেতৃত্বদানকারী দল হিসাবে আওয়ামী লীগ এগুলো প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা নেবে। আমি এটাও মনে করি এগুলো প্রতিষ্ঠার নেতৃত্ব আওয়ামী লীগের একার পক্ষে দেওয়া সম্ভব নয়। এজন্য আমাদের দরকার সম্মিলিত প্রচেষ্টা।
দলের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠার গৌরবোজ্জ্বল ৭৩তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে জাতীয় ও দলীয় পতাকা উত্তোলন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদনসহ সীমিত পরিসরে স্বাস্থ্য সুরক্ষা বিধি মেনে কেন্দ্রীয় কর্মসূচির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ কর্মসূচি গ্রহণের পাশাপাশি বিভিন্ন উপযোগী কর্মসূচির মাধ্যমে যথাযথ মর্যাদায় প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন করার জন্য আওয়ামী লীগ, সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের সকল জেলা, উপজেলাসহ সকল স্তরের নেতা-কর্মী, সমর্থকদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। গতকাল বুধবার এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানিয়েছেন দলের দফতর সম্পাদক ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া।
প্রসঙ্গত, ১৯৪৯ সালের এই দিনে পুরান ঢাকার রোজ গার্ডেনে আওয়ামী মুসলিম লীগ নামে সংগঠনটি প্রতিষ্ঠিত হলেও পরবর্তীতে অসাম্প্রদায়িক রূপ লাভ করে আওয়ামী লীগ নামে আত্মপ্রকাশ করে। মুসলিম লীগের প্রগতিশীল নেতা-কর্মীরা সংগঠন থেকে বেরিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন আওয়ামী মুসলিম লীগ।
ইউকেবিডিটিভি/ বিডি / এমএসএম