বাংলাদেশের দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন নিয়ে সব রকমের জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে শেষ পর্যন্ত ৭ই জানুয়ারী ২০২৪ অনুষ্ঠিত হয়ে গেলো নির্বাচন। একমাত্র বিএনপি ছাড়া জাতীয় পার্টি, জাসদ, তৃণমূল বিএনপি, ইসলামী আন্দোলন সহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করে এবং তাদের অনেক প্রার্থীই জয় লাভ করেছেন।
আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে তাঁর প্রতিজ্ঞা অনুযায়ী বাংলাদেশের জনগণকে একটি সুন্দর, সুষ্ঠু এবং অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের অংশ গ্রহণের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রেখে জনগণের স্বত:স্ফুর্ত অংশ গ্রহণের মাধ্যমে যে নির্বাচন উপহার দিলেন, তা দেখে শুধু দেশের জনগণই নয়, বিভিন্ন দেশ থেকে আসা নির্বাচন পর্যবেক্ষক দলও সন্তোষ প্রকাশ করেছেন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, রাশিয়া, স্কটল্যান্ড সহ বিভিন্ন দেশের পর্যবেক্ষকরা নির্বাচনকে অবাধ, সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ, সফল এবং বৈধ বলে অভিহিত করেছেন। পর্যবেক্ষকরা রবিবার ৭ই জানুয়ারী বাংলাদেশের ১২তম সাধারণ নির্বাচন পর্যবেক্ষণের পর এই মন্তব্য করেন। নির্বাচন পর্যবেক্ষণ শেষে এক সংবাদ সম্মেলনে মার্কিন কংগ্রেসের সদস্য জিম বেটস বলেন, ”আমি নির্বাচনকে অত্যন্ত শান্তিপূর্ণ, অবাধ এবং সুষ্ঠু বলে মনে করছি।” সংবাদ সম্মেলনে বিদেশী পর্যবেক্ষকদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন রাশিয়ান ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশনের সদস্য আন্দ্রে ওয়াই শুতোভ, ফিলিস্তিনের কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশনের সিইও হিশাম কুহাইল, গাম্বিয়া হাই কমিশনের মোহাম্মাদ মুসা এনজি, স্কটিশ এমপি মার্টিন ডে, ওআইসি’র শাকির মাহমুদ বান্দর, আরব পার্লামেন্টের সদস্য আবদি হাকিম মোয়ালিয়াম, দক্ষিণ এশিয়া গণতান্ত্রিক ফোরামের নির্বাহী পরিচালক পাওলো কাসাকা, ভিক্টর ও এইচ এবং কানাডার চন্দ্রকান্ত আর্য।
ভোটে প্রায় ৪০ শতাংশ ভোটার উপস্থিতি সম্পর্কে মার্কিন কংগ্রেসের সদস্য মি. জিম বলেন, বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত ভোট গ্রহণের যে সময় নির্ধারণ করা হয়েছে তা বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় সবচেয়ে কম। তিনি বলেন, অনেক দেশে ভোট সকাল থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত হয়।
আমেরিকান গ্লোবাল স্ট্র্যাটেজিসের সিইও আলেকজান্ডার বি গ্রে বলেন, আমি নিজের চোখে দেখেছি যে নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হয়েছে, যা ভোটার, পোলিং স্টাফ এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্যদের পেশাদারিত্ব ব্যাপক উৎসাহের সঙ্গে অনুষ্ঠিত হয়েছে।’ গ্রে দশটি ভোট কেন্দ্রৃ পরিদর্শনের পর তার অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে বলেন, একজন ভোটার বা কেউ তার কাছে তাদের উদ্বেগ বা অভিযোগ জানাননি। তিনি আরও বলেন, এই নির্বাচন গণতান্ত্রিক জবাবদিহীতা এবং পেশাদারিত্বের সর্বোচ্চ মান পূরণ করেছে এবং আমি অত্যন্ত নিশ্চিত যে, নির্বাচন কমিশন সততার সঙ্গে পেশাদার কাজ করেছে।
রাশিয়ান ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশনের সদস্য আন্দ্রে ওয়াই শুটোভ বলেন, জনগণই এই দেশের ভবিষ্যত নির্ধারণ করতে পারে এবং এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে এই নির্বাচন বৈধ। তিনি নির্বাচনের উন্মুক্ততা এবং স্বচ্ছতা দেখে মৃগ্ধ হয়েছেন, প্রতিটি ভোটার ভোট সম্পর্কে সমস্ত তথ্য পেয়েছেন। এই নির্বাচন ছিল উন্মুক্ত ও স্বচ্ছ এবং আমরা মনে করি বাংলাদেশের নির্বাচনী ব্যবস্থা কার্যকর। বাংলাদেশে নিবর্’াচনের একটি দীর্ঘ ঐতিহ্য রয়েছে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রক্রিয়া স্তিতিশীলভাবে বিকশিত।
কানাডার চন্দ্রকান্ত আর্য বলেন, ২৮টি রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিত্বকারী রেকর্ড সংখ্যক ১৯০০ প্রার্থী নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন। সকল প্রার্থীদের জনগনের কাছে অবাধ প্রবেশাধিকার রয়েছে এবং তাদের নিজের পক্ষে প্রচারে কোনও বাধা ছিলনা। একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও সফল নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য আমরা নির্বাচন কমিশনকে অভিনন্দন জানাই।
স্কটিশ এমপি মার্টিন ডে বলেন, ভোটারদের উপস্থিতি কিছুটা কম হলেও ভোটের দিনের কার্যক্রম খুব স্বাভাবিক এবং বেশ মনোরম ছিল। (সূত্র : ইউকে বিডি টিভি.কম)
এই নির্বাচন অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের দেশ পরিচালনার উপর যেমন বাংলাদেশের জনগণের আস্থা রয়েছে, ঠিক তেমনি দেশের সব দিক দিয়ে উন্নয়নের ধারাকে আরও বেগবান করে অব্যাহত রাখার প্রচেষ্টাকে সর্বোত ভাবে সমর্থন করে যাবে। এই নির্বাচনের ফলাফলে আরও প্রমাণিত হলো যে, বাংলাদেশের জনগণ দেশের স্বাধীনতা বিরোধী চক্রকে পুরোদমে প্রত্যাখ্যান করেছে, যে ভাবে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা লাভের পর জামায়াত ও তাদের অনুসারীদের প্রত্যাখ্যান করেছিলো।
আমাদের দেশে একটি প্রবাদ আছে, অসদুপায়ে টাকা উপার্জনই হোক আর ক্ষমতা দখলই হোক তা বেশি দিন টেকে না, বড়জোর এক সিঁড়ি বা দু’সিঁড়ি অর্থাৎ প্রথম প্রজন্ম অথবা দ্বিতীয় প্রজন্মেই শেষ হয়ে যায়। মুরুব্বিদের এই কথার প্রমাণ পেলাম এবারের এই নির্বাচনের মাধ্যমে। বিএনপি’র প্রতিষ্ঠাতা জেনারেল জিয়াউর রহমান জনগণের রায় না নিয়ে নিজেই তাঁর ইচ্ছে মতো হ্যা না ভোটের মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি জনগণের আস্থা অর্জনের লক্ষ্যে ’খাল খনন’ নামে একটি প্রকল্প হাতে নেন। এই প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য ছিলো, বিভিন্ন জেলাগুলোর মধ্য দিয়ে, বিশেষ করে ভারত থেকে নেমে আসা নদীগুলো দিয়ে বর্ষার দিনে প্রবল স্রোতের কারণে নদী পারের শহরগুলো ভাঙ্গনের আশংকায় ছিলো। তিনি শহরের পাশ দিয়ে বহমান নদীগুলোর ঐ অংশকে অন্যদিকে ডাইভারশন দিয়ে অর্থাৎ ঐ অংশটি বড় করে খাল কাটিয়ে পানির গতি পরিবর্তন করে শহরগুলোকে রক্ষা করার চেষ্টা করেছেন।
এ সময় আমি হবিগজ্ঞ বৃন্দাবন কলেজের ছাত্র। তখন হবিগজ্ঞ শহরের পাশ দিয়ে প্রবাহিত ভারত থেকে নেমে আসা খোয়াই নদীর ভয়াভহ স্রোত থেকে শহরকে রক্ষা করার জন্য খাল খননের কাজ শেষ হওয়ার পর প্রেসিডেন্ট জিয়া খাল উদ্বোধন করার জন্য হবিগজ্ঞে আসেন। খাল উদ্বোধন করার পর তিনি সংবাদ সম্মেলন করে সাংবাদিকদের ব্রিফিং করেন তার প্ল্যান সম্বন্ধে। সে সময় সাংবাদিকরা তাকে বিভিন্ন ধরণের প্রশ্ন করেন এবং তাদের উত্তর তিনি দেন। সে সময় আমি কুমিল্লা থেকে প্রকাশিত ”সাপ্তাহিক আমোদ” পত্রিকার হবিগজ্ঞ প্রতিনিধি। আমি তাকে প্রশ্ন করেছিলাম, আপনার প্ল্যান শুনে আমার কাছে মনে হচ্ছে জনগণের সংস্পর্শে আসার পর আপনি কোন একটা রাজনৈতিক দল গঠনের চিন্তা ভাবনা করছেন, আমার অনুমান কি সত্য? প্রেসিডেন্ট জিয়া মৃদু হাঁসি দিয়ে বলেছিলেন, যদি জনগণ চায় তা হলে হয়তো করতে পারি। সে দিনই আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে তিনি একটি রাজনৈতিক দল গঠন করবেন।
১৯৭৭ সলে তিনি গঠন করলেন, ”জাগদল” নামে একটি রাজনৈতিক দল। এরপর ১৯৭৮ সালের ১লা সেপ্টেম্বর ”জাগদল” নাম পরিবর্তন করে রাখলেন ”বিএনপি”। বিএনপি গঠন করার পর প্রহসনমূলক একটি নির্বাচন দিয়ে সরকার গঠনের ইতিহাস বাংলাদেশের মানুষের অজানা নয়। যেখানে ছিলো বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিরোধীদের একচ্ছত্র প্রাধান্য। অত:পর ১৯৮১ সালের ৩০ মে বাংলাদেশ আর্মির অভ্যন্তরীণ কোন্দলের ফলে আর্মির একটি দল চট্টগ্রাম সার্কিট হাউস ঘেরাও করে তাকে হত্যা করে।
উল্লেখ্য যে, ঐদিন তিনি চট্টগ্রামের লাল দিঘী ময়দানে এক জনসভায় ভাষণ দেয়ার পর সার্কিট হাউসে ফিরে আসেন রাত্রি যাপনের জন্য এবং ঐ রাতই আনুমানিক ৪টার দিকে আর্মির একটি দল সার্কিট হাউস ঘেরাও করে প্রবল গুলিবর্ষন করে। সার্কিট হাউস গুলিবর্ষণের ফলে একেবারে ঝাঁঝরা হয়ে যায় এবং এই গুলাগুলির মধ্যে পরে তিনি নিহত হন। ঐ সময় জিয়ার খন্ড-বিখন্ড মরদেহটি আর্মিরা রাতের মধ্যেই সরিয়ে ফেলে। ঐ সময় চট্টগ্রামের টাইগার পাসে আমার একটি রেষ্টুরেন্ট ছিল। তখন টাইগার পাসেই থাকতাম যার ফলে বিস্তারিত জানার সুযোগ পেয়েছিলাম।
এরপর বেগম জিয়াও দেশ শাসন করেছেন। তাঁর শাসনামলে দলটি মোটামুটি জনপ্রিয়তা পেলেও তা রক্ষা করতে পারেন নি তার দু’ ছেলের জন্য। বর্তমানে তারেক রহমানের হাতে ক্ষমতা আসার পর থেকেই দলে ভাঙ্গন শুরু হয় যা আজ অবধি চলছে। বর্তমানে জনপ্রিয় এই দলটি কি টিকে থাকবে কি না তাই রাজনৈতিক মহলে গুঞ্জন শুরু হয়েছে।
বিএনপি নেতৃবৃন্দ যদি বাইরের দেশের নেতাদের বুদ্ধি না নিয়ে এবং তাদের উপর ভরসা করে ক্ষমতা যাওয়ার আশা না করে বরং নিজেদের বুদ্ধিতে ’একদফা’ আন্দোলন থেকে সরে এসে জনগণকে সাথে নিয়ে নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করতো, তাহলে তারা সরকার গঠন না করতে পারলেও অন্তত: শক্তিশালী বিরোধী দল হিসেবে সংসদে আসতে পারতো। যা দলের জন্য যেমন ভাল ছিলো, জনগণেরও মঙ্গল হতো। জনগণ তা-ই আশা করেছিলো।
বাংলাদেশের সব রাজনৈতিক দলেরই এবারের নির্বাচনে বিএনপি’র ভুল রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত থেকে শিক্ষা নেয়া উচিত, ’পরের ঘাড়ে বন্দুক রেখে শিকার করা’ যায় না।
এই কথাগুলো লেখার উদ্দেশ্যই হলো, যে কোন রাজনৈতিক দলই হোক না কেন, যদি দলের নেতৃত্ব ঠিক না থাকে, যদি দেশের জনগণের সাথে সম্পৃক্ততা না থাকে, তাহলে দলকে টিকিয়ে রাখা সম্ভব হয় না। সুতরাং বিএনপিও যদি সঠিক নেতৃত্বের অভাবে একদিন বিলিন হয়ে যায়, তা হলে অবাক হওয়ার কিছু নেই।
সে যা-ই হোক, আওয়ামী লীগ সভানেত্রী মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের উন্নয়নের জন্য যে অক্লান্ত পরিশ্রম করে বিশ্বের বুকে বাাংলাদেশকে উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে পরিচিত করে তুলেছেন, গত ৭ই জানুয়ারীতে অনুষ্ঠিত এই নির্বাচনে তারই স্বীকৃতি তিনি পেয়েছেন দেশবাসী সহ বিশ্ব নেতৃবৃন্দের কাছে।
ইতিমধ্যেই মন্ত্রীপরিষদও গঠন করা হয়েছে এবং দায়িত্বও বন্টন করা হয়েছে। দেশবাসী আশা করছে, দেশ চালানোর ব্যাপারে সরকারের অতীতে যে ভুলভ্রান্তি হয়েছে তা শুধরিয়ে আগামীতে এই সরকার একটি সুন্দর বাংলাদেশ এবং সুশৃঙ্খল জাতি হিসেবে গড়ে তুলে বিশ্ববাসীকে হতবাক করে দিবেন।