palestine-A four thousand year history এই বইটির লেখক নূর মাসালহা। তিনি একজন প্রফেসর এবং প্যালেষ্টাইনের (ফিলিস্তিন) বংশোদ্ভুত। এই বইটি আমি পড়িনি, তবে বইয়ের শুরুতে লেখা ফিলিস্তিনের গোঁড়ার ইতিহাস আমি পেয়েছি। বর্তমানে ফিলিস্তিনি জনগনের উপর যে নির্মম হত্যাযজ্ঞ চলছে তা নিয়ে লেখার আগে এই বই থেকে ফিলিস্তিনের অতীতের কিছু ইতিহাস তুলে ধরছি। তাহলে পাঠকরা জানতে পারবেন ফিলিস্তিনের জন্মের গোড়ার কথা এবং এই বীর জাতির যুদ্ধের ইতিহাস।
লেখক নূর মাসলাহা লিখেছেন, ”প্যালেষ্টাইন বা ফিলিস্তিন নামটা এসেছে বাইবেলের ওল্ড টেষ্টামেন্ট থেকে। তবে প্যালেষ্টাইন দেশটি কিন্তু বাইবেলের থেকেও পুরনো। আর এই বিষয়টিকেই জোর দিয়ে দেখিয়েছেন তিনি। আমরা যদি ফিলিস্তিন জাতি এবং তাদের সংস্কৃতির আদি উৎসবের খোঁজ করতে যাই, তা হলে দেখা যাবে -বাইবেলের বহু আগে থেকেই ফিলিস্তিনি জাতির একটি নিজস্ব সংস্কৃতি এবং পরিচয় রয়েছে। সেই ব্রোঞ্জ যোগ থেকে শুরু করে আমরা যদি বিভিন্ন ধরণের প্রতœতাত্তি¡ক নিদর্শন দেখি, তাহলে দেখা যাবে বাইবেলের বিভিন্ন ঘটনার কারণে আসলে ফিলিস্তিনের প্রকৃত ইতিহাস বিকৃত হয়েছে। ইসরায়েলের সাথে কনফ্লিক্টও এর একটি বড় কারণ। তবে ফিলিস্তিনের ইতিহাস আসলে খুবই রোমাঞ্চকর এবং অনেক জটিল।
সবচেয়ে প্রাচীনকালে যেসব অঞ্চলে মানুষ বসতি স্থাপন করেছিল তার মধ্যে একটি হলো বর্তমান ইসরায়েল-প্যালেষ্টাইন অঞ্চল। কিন্তু এই অঞ্চলের দখল নিয়ে ইতিহাসের প্রথম থেকেই চলছে একের পর এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। ভেবে অবাক হতে হয়, কয়েক হাজার বছরের পুরনো সেই লড়াই এখনো পর্য্যন্ত চলছে। তার অবশ্য কারণও রয়েছে। এদিক থেকে বিবেচনা করলে, এই অঞ্চলটি হলো তিনটি মহাদেশের মিলনস্থল, তাই ভ‚-রাজনৈতিক কারণে অঞ্চলটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কালে কালে বিভিন্ন সম্রাজ্য এই অঞ্চলকে দখলে রাখতে চেয়েছে।
প্রাচীন মিশরীয়রা, প্রাচীন পার্সিয়ানরা, আলেকজান্ডার দ্যা গ্রেট, রোমান সম্রাজ্য, মধ্যযুগীয় মুসলিম রাজবংশ, ক্রুসেডাররা, অটোম্যান সম্রাজ্য, আর একদম হাল আমলে এসে ব্রিটিশ সম্রাজ্য এই অঞ্চল শাসন করেছে। ব্রিটিশরা এই অঞ্চল ছেড়ে দেওয়ার পর সারা বিশ্বের ইহুদীরা এই এলাকার একটি বড় অংশ দখল করে তাদের নিজেদের জাতির জন্য ”ইসরায়েল রাষ্ট্র” স্থাপন করে। আর এর পর থেকে লেগেই আছে বিখ্যাত ইসলাইল-প্যালেষ্টাইন যুদ্ধ।
ইসরায়েলের ইহুদীরা মনে করে যে, প্যালেষ্টাইনের বাসিন্দারা এই অঞ্চলে নতুন এসে বসতি গড়েছে, আর ইহুদীরা নিজেরা হলো এই অঞ্চলের আদি বাসিন্দা। কিন্তু নূর মাসলাহা সম্পূর্ণ ভিন্ন এক বাস্তবতা তুলে ধরেছেন তার এই বইতে। তিনি প্রচুর পরিমান প্রতœতাত্তি¡ক প্রমাণ ও প্রাচীন লিপির সাহায্যে দেখিয়েছেন যে, প্যালেষ্ট্ইান ধারণাটাই আসলে বাইবেলের প্যালেষ্টাইনের চেয়ে অনেক পুরনো। অর্থাৎ ইহুদীরা ওল্ড টেষ্টামেন্টের রেফারেন্স দিয়ে যে ইতিহাস বলে, আসলে এই অঞ্চলের ইতিহাস আরও বেশি পুরনো। তার মানে ওল্ডটেষ্টামেন্টে উল্লিখিত সময়ে আদি ইহুদী গোষ্ঠী যখন এই অঞ্চলে এসে বসতি স্থাপন করে, তার আগের থেকেই এই অঞ্চলে প্যালেষ্টাইনের জনগন বসবাস করতো। তিনি ব্রোঞ্জ যুগ থেকে শুরু করে আধুনিক যুগ পর্যন্ত প্যালেষ্টাইন অঞ্চলের ইতিহাসকে একদম ছবির মত করে তুলে ধরেছেন। ”
নূর মাসলাহার উপরোক্ত লেখাটি পড়ে জানা গেলো যে, প্যালেষ্টাইনের বাসিন্দারা কোন দিনই তাদের দেশে স্বাধীন ভাবে থাকার বা চলাফেরা করার স্বাধীনতা পায়নি। কি দুর্ভাগ্য তাদের। প্রাচীন মিশরীয়রা থেকে শুরু করে ব্রিটিশ সম্রাজ্য পর্যন্ত এই অঞ্চল শাসন করেছে হাজার হাজার বছর, শাসন আর শোষনের মধ্য দিয়ে কাটাতে হয়েছে এই বীর ফিলিস্তিনীদের। হাজার হাজার বছরে কত লাখ লাখ ফিলিস্তিনী মানুষ তাদের দেশের জন্য প্রাণ দিয়েছেন দখলদার বাহিনীর সাথে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে তার কোন হিসাব নেই! আমার ভাবতেও অবাক লাগে যে, এই হাজার হাজার বছরের মধ্যেও কি মুসলমান রাষ্ট্রগুলো একত্রিত হয়ে ফিলিস্তিনীদের জন্য একটি স্বাধীন রাষ্ট্র ঘোষণার আওয়াজ তুলতে পারলো না? যদিও এই অঞ্চলটি তিনটি মহাদেশের মিলনস্থল, তাই ভু-রাজনৈতিক কারণে অঞ্চলটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, তার পরওতো এই মানুষগুলোকে তাদের চলাফেরা, নিজেদের কৃষ্টি বজায় রেখে স্বাধীনভাবে চলা ফেরার সুযোগ দেয়া উচিৎ ছিলো।
এই হাজার হাজার বছর ধরে কোন মুসলমান দেশই তাদের কোনো গুরুত্ব দেয়নি বলেই আজও চলছে তাদের উপর অত্যাচার নির্য্যাতন, হত্যাযজ্ঞ। এই ইহুদীরা জানে যে, তাদের সাথে রয়েছে বর্তমান বিশ্বের একটি বৃহৎ শক্তি আমেরিকা এবং তাদের সাথে যুক্তরাজ্য সহ ইউরোপীয়ান ইউনিয়নের দেশগুলো। তারাই মুসলমান দেশগুলোর মধ্যে একটি সাথে আরেকটির দ্বন্ধ বাঁধিয়ে রেখেছে। যদিও তারা বৃহৎ শক্তি কিন্তু তারপরও তারা মুসলমানদের ভয়ে আতঙ্কিত। তারা ভালো করেই জানে যে, যদি মুসলিম দেশগুলো একই ছাদের নীচে চলে আসে, তাহলে তারা যতো শক্তিশালী হোক না মুসলমানের সাথে যুদ্ধ করে জয়ী হতে পারবে না। এ কারণেই তারা ভবিষ্যৎ মাষ্টার প্লান করে অধিকাংশ মুসলমান দেশগুলোতে আমেরিকা তাদের সামরিক ঘাঁটি তৈরী করে শক্ত আসন গড়ে তুলেছে এবং বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা দিয়ে এই দেশগুলোকে তাদের হাতের মুঠোয় রেখে দিয়েছে। সুতরাং ফিলিস্তিনের বর্তমানের এই ক্রান্তিলগ্নে, তাদের দু:সময়ে যেখানে গত কয়েক সপ্তাহের যুদ্ধে প্রায় ৬ হাজার মানুষ, সদ্য ভুমিষ্ট হওয়া শিশু থেকে শুরু বুড়ো লোককে আত্মাহুতি দিতে হয়েছে এবং দিন দিন শত শত মানুষ ইরায়েলের আগ্নেয়াস্ত্রের হামলায় মারা যাচ্ছে।
দেখে মনে হচ্ছে, ”মৃত্যুই যেন তাদের স্বাধীনতা!” একমাত্র ইরান, ইরাক, সৌদি আরব ছাড়া এই যুদ্ধের বিরুদ্ধে কোন মুসলমান দেশই এ ব্যাপারে কোন মাথা গলাচ্ছে না, তবে এর মধ্যে একমাত্র বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই ইসরায়েলের এই আগ্রাসনের বিরুদ্ধে কঠোর ভাষায় নিন্দা জ্ঞাপন করেছেন এবং অনতিবিলম্বে যুদ্ধ বন্ধের আহ্বান জানিয়েছেন।
আল জাজিরা ডট কম এর ৩১ অক্টোবরের খবরে প্রকাশ, গত ৭ অক্টোবর থেকে ইসরায়েলী দখলদার বাহিনীর এয়ার রেইড এবং গ্রাউন্ড এটাক’এ গাজায় এখন পর্যন্ত প্রতিদিন প্রায় ৪২০ জন করে ছোট ছোট শিশুরা নিহত হচ্ছে এবং আহত হচ্ছে। হাজারো শিশু এবং মহিলা, পুরুষ নিহত হওয়ার কারণে পুরো গাজা উপত্যকা একটি কবরস্থানে পরিণত হয়েছে।
ফিলিস্তিনীদের উপর ইসরায়েলের এই আক্রমনের প্রধান লক্ষ্যই হচ্ছে, পুরো গাজা এবং ফিলিস্তিন এলাকা দখলে নেয়া এবং ভবিষ্যতে যাতে তারা মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে সে জন্য সদ্য ভুমিষ্ট হওয়া সন্তানদের থেকে শুরু করে মধ্যবয়সী যুবক যুবতীদের হত্যা করা। এটি হচ্ছে আমেরিকা- ইসরায়েলের একটি মাষ্টারপ্ল্যান। এ কারণেই তারা গাজায় বসবাসরত অধিবাসীদের গাজা ছেড়ে যাওয়ার জন্য আহ্বান জানিয়েছে সেই সঙ্গে ফিলিস্তিনীদেরও। গাজাবাসী এবং ফিলিস্তিনীরা যদি আত্মরক্ষার জন্য তাদের বসতি ছেড়ে চলে যায়, তা হলে হয়তো দেখা যাবে যে, জাতিসংঘের মাধ্যমে হামাস, হিজবুল্লাহ এবং ইসলামিক জেহাদের নেতৃবৃন্দদের গাজায় যুত্থবিরতির প্রস্তাব দেয়া হবে। এই যুদ্ধ বিরতি মেনে নিলে তখন তারা গাজা এবং ফিলিস্তিনকে সুন্দর ভাবে ঘরবাড়ি তৈরী করে দেয়ার জন্য এলাকা থেকে সরে যাওয়ার জন্য বলবে। তারা সরে গেলে এই এলাকাগুলোকে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচ করে ঠিকই সুন্দর ভাবে বড় বড় অট্টালিকা গড়ে তোলা হবে, তবে এখানে স্থান হবে ইহুদীদের। এভাবেই তারা দখল করে নেবে পুরো গাজা, ফিলিস্তিন এলাকা।
এখন কথা হচ্ছে, বিশ্বের ৫৭টি মুসলিম দেশের শাসকরা কি ইহুদীদের এই মাষ্টার প্লানের চিন্তাধারা বুঝতে পারছেন? যদি বুঝে থাকেন, তাহলে এখনই সব মুসলিম দেশগুলোকে একত্রিত হয়ে একই ছাদের নীচে আসতে হবে এবং সিদ্ধান্ত নিতে হবে কি ভাবে ইরায়েলের হাত থেকে গাজা এলাকা রক্ষা করা যায় এবং ফিলিস্তিনী জনগণকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে মূল্যায়ন করা যায়। এ ব্যাপারে বলিষ্ট ভুমিকা রাখতে পারে সৌদি আরব। কেননা, সৌদি আরব হচ্ছে বিশ্বের মুসলমান দেশগুলোর মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ দেশ। সৌদি বাদশা যদি ইসরায়েলের বিরুদ্ধে এক হয়ে কাজ করার জন্য মুসলমান দেশগুলোর রাষ্ট্র প্রধানদের আহ্বান জানান তাহলে আমার মনে হয়, এই আহ্বানে সবাই সাড়া দেবে। এরপর কোন এক দেশে রাষ্ট্রপ্রধানরা একত্রে বসে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন কি ভাবে ইসরায়েলের এই আগ্রাসনের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেয়া যায়। এই বিষয়টি ভালো ভাবে চিন্তা ভাবনা করে একটা ফর্মুলা বের করার জন্য সব মুসলমান দেশের রাষ্ট্র প্রধান এবং জনগণকে অনুরোধ জানাচ্ছি।
তবে একটি কথা মনে রাখতে হবে বিশ্বের যতো অ-মুসলিম দেশগুলো আছে তারা কিন্তু সবাই একই ছাদের নীচে আছে অর্থাৎ এরা সবাই মুসলমানদের বিরুদ্ধে এক। সুতরাং এদের বিশ্বাস করতে নেই।
নাসারাদের ব্যাপারে আল্লাহ পাক কোরআন শরীফে স্পষ্টই বলে দিয়েছেন, যার অর্থ হচ্ছে- ”হে মুমিনগণ, ইহুদী ও নাসারাদের তোমরা বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না। তারা একে অপরের বন্ধু। আর তোমাদের মধ্যে যে তাদের সাথে বন্ধুত্ব করবে, সে নিশ্চয় তাদেরই একজন। নিশ্চয় আল্লাহ যালিম কওমকে হিদায়াত দেন না।”- আল বায়ান
লেখকঃ দেওয়ান ফয়সল, কলামিষ্ট, সিনিয়র সাংবাদিক ও সদস্য লন্ডন বাংলা প্রেসক্লাব