সময়টা ১৯৯৬ কি ৯৭” , কিম্বা তারও দু’পাঁচ বছর আগে হবে ৷ হাওড়ার শ্রীরাম ঢ্যাং লেনে শ্রীরামপুর থেকে লোকাল ট্রেনে চেপে মাঝে মধ্যেই চলে যেতাম পুলক কাকুর বাসায় ৷ পুলক কাকু বলতে , প্রখ্যাত গিতিকার ও কবি পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় ! তখন আমার বয়সটা বলতে পারা যায় অনেকটাই কম বলা যায় ৷ বাপের হোটেলে খাচ্ছিটাচ্ছি আর দিনরাত কবিতা লিখছি , আর এদিক সেদিক কবিতার তারনায় নামি-দামী কবিদের বাসায় যাচ্ছি – আসছি ! ওদের সাথে ঘনিষ্ঠতা বাড়াচ্ছি , এই আর কি !
পুলক কাকুর সাথে এম.সি . সরকার অ্যান্ড সন্স ( বঙ্কিম চ্যাটুজ্যে স্ট্রীট , কলকাতা ) অর্থাৎ মৌচাক” পত্রিকা দপ্তরে সে-ই ৯০” এর শুরুতেই আমার প্রথম সাক্ষাৎ এবং পরিচয় , পরবর্তী সময় ঘন ঘন দেখা সাক্ষ্যৎ ও আন্তরিক ঘনিষ্ঠতা ! মৌচাক”- পত্রিকায় তখন প্রতিমাসেই আমার কবিতা ছাপা হচ্ছে , সেই সুবাদে পত্রিকা দপ্তরে আমার আসা যাওয়া লেগেই ছিল ৷ তখন মৌচাক সম্পাদনা করতেন শমিত সরকার ৷ একদিন শীতের দুপুরে মৌচাক”- এর দপ্তরে বসে আছি , শমিত বাবুর সাথে কবিতা নির্ভর আড্ডা দিচ্ছি চা – সিঙ্গাড়া খেতে খেতে ৷ এটা প্রতি মাসেই চলতো বলা যায় , হঠাৎ সেদিন দুপুরের মিষ্টি রোদ মেখে রাঙা আলোর মত উজ্জ্বল একজন মানুষ এসে হাজির হলেন মৌচাক পত্রিকা দপ্তরে ৷ একগাল হাসি মুখে বললেন ; “কেমন আছেন শমিত বাবু ?” …. আমি আমার কবিতার পান্ডুলিপি থেকে মুখ তুলে তাকালাম , একি কাণ্ড আমার সম্মুখে আমি কাকে দেখছি ! ইনি-তো বাংলা আধুনিক গানের কিংবদন্তী গিতিকার পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় ! সত্যি কথা বলতে কি , আমি তখন আমার নিজের চোখ দুটোকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না , আমি কি সত্যি দেখছি ; নাকি ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন ! সেদিন শামিত বাবু আমার সাথে আলাপ করে দিয়ে ছিলেন পুলক কাকুর সাথে , কথায় কথায় বলেছিলেন “এই যে ছেলেটাকে দেখছেন পুলক দা , ওর নাম বিদ্যুৎ ভৌমিক ৷ এর কবিতা পড়েছেন পুলক দা ?
বিদ্যুৎ এর কবিতা সুনীল দা মানে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় খুব পছন্দ করেন এবং ম্যান্ডেভিলায় বিদ্যুৎ এর সুনীল দার ফ্ল্যাটে ওর নিয়মিত যাতায়াত আছে ৷” শমিত বাবুর মুখে আমার সম্পর্কে কথা গুলো শুনতে শুনতে পুলক কাকু মৃদু হেসে সেদিন বলে ছিলেন ; “শুধু সুনীল দা কেন বিদ্যুৎ ভৌমিক এর কবিতার সাথে আমিও পরিচিত , শুধু সামনা সামনি-ই আলাপ ছিল না এই বাচ্চা ছেলেটার সাথে , মৌচক”-ই এর মেল বন্ধন করে দিল , আপনাকে ধন্যবাদ শমিত বাবু !”
সেদিন কলেজ স্ট্রীট থেকে শ্রীরামপুরের বাসা ছায়ানীড়”- এ ফিরে পুলক কাকুর কথাগুলো রাতে বিছানায় শুয়ে ভিতরে গভীরে অবিস্মরণীয় ভাবে মনে পড়ছিল , আর মনে মনে এক ঘর নীরব অন্ধকারে ওনার লেখা কত জনপ্রিয় বিখ্যাত শিল্পীদের গান , বিশেষ করে মান্না দে , হেমন্ত , সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের মত আরও কত জনপ্রিয় শিল্পীদের গানগুলো আমি বিছানায় শুয়ে শুয়ে অনেক রাত পর্যন্ত নির্ঘূম যাপনের মধ্যে মনে করতে করতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম , সেটা নিজেও টের পাই নি !
একদিন দুপুরের দিকে হঠাৎ ডাক পিওন এসে আমার নামে একটা পোষ্ট কার্ড দিয়ে গেল ৷ ওটা পড়ে দেখতে গিয়ে দেখি , পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা আমাকে চিঠি ! “বিদ্যুৎ একবার সময় করে আমার বাড়িতে আসবি , তোর সাথে আমার কিছু কথা আছে ৷” পরের দিন সকাল সকাল ট্রেনে চেপে সোজা হাওড়া স্টেশন , তারপর শ্রীরাম ঢ্যাং লেনে পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাসায় গিয়ে আমি হাজির ! এই রকম ঘটনা পরবর্ত্তী সময়ে অনেক বারই হয়েছে , তবে ওই দিন প্রথম ওনার পোষ্ট কার্ড হাতে পেয়ে আমার রাতের ঘুমের দফারফা হয়ে গিয়েছিল ! অবশেষে পৌঁছালাম ঢ্যাং লেনে পুলক কাকুর বাসায় ৷ কলিং বেলে বাজালাম , দরজার বাহিরে অপেক্ষা করতে লাগলাম কখন কেউ এসে দরজা খুলবে ৷ মিনিট পাঁচেক এই ভেবে ভেবে কেটে গেল সময় ৷ শেষমেশ ভিতর থেকে দরজা খোলার শব্দ হতেই নিজেকে একটু সামলে নিলাম ৷ দেখি আমার সম্মুখে দুয়ার খুলে একগাল হাসি মুখে দাঁডিয়ে পশ্চিম বঙ্গের প্রখ্যাত গিতিকার পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় ! স্নেহবসত বললেন ; “আয় বিদ্যুৎ ভিতরে আয় ৷ তুই যে এতটা সময় সচেতন এটা আজ প্রমান হল !” আমি বললাম , কাকু আমাকে কেন ডেকেছেন ? উত্তরে তিনি যা বললেন সেটা শুনে মনে মনে ভীষণ উৎসাহিত ও আনন্দে আত্মহারা হয়ে যাবার উপক্রম হয়েছিল আর কি ৷ “আজ তোকে এক জায়গায় নিয়ে যাব ৷” কোথায় ? “কোথায় আবার , একজন সংগীত শিক্ষকের সাথে তোকে আলাপ করতে ৷” পুলক কাকুর কথা শুনে ভাবলাম , কার সাথে আবার আলপ করতে হবে ! মনের ভিতরে গভীরে রাস্তাগুলো দিয়ে একটা কৌতুহল সেই সময় এ প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে দাপিয়ে চলছিল ! কে ? …. কে ? …. কে ? কে তিনি যাঁর সাথে আমার প্রথম পরিচয় হবে !! প্রশ্নটা বারে – বারে অন্তরের অন্তঃস্থল জুড়ে ভীষণ ভাবে আলোরণ তুলছিল ! মৃদু হেসে পুলক কাকু বললেন ; “আজ মহাজাতি সদনে তুই আমার সঙ্গে যাবি , মান্না বাবু আসছেন ৷ তোর সাথে পরিচয় করিয়ে দেব ৷” হঠাৎ করে পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কী এমন হল যে আমার মত একজন সাধারণ অক্ষরকর্মী নবীন কবির সাথে প্রবাদপ্রতীম কিংবদন্তী শিল্পী মান্না দে’র সাথে পরিচয় করিয়ে দেবেন ! ব্যাপারটা ঠিক মনেপ্রাণে অনুধাবন করতে পারছিলাম না ৷ সেই সময় আমার অন্তরটা মৃত মানুষের মত নীরবস্তব্ধ হয়ে গিয়ে ছিল ! আমি নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করেছিলাম , সত্যি কি আমি ঠিক শুনলাম , না কি ‘স্বপনে বাজে গো বাঁশি’-র মত কিছু একটা শুনলাম ! ভীষণ মনটা অশান্ত ও নিতান্তই অস্থির হয়ে ছিল , নিজেকে সামলে নিতে সেই সময় প্রায় বেশ কিছুক্ষণ সময় লেগে ছিল ! ওই মূহুর্তে নিজেকে হরিয়ে ফেলার মত একটা নিদারুন অবস্থা হয়ে ছিল আমার !
অবশেষে এই অধমের সমস্ত মানসিক চিন্তার অবসান ঘটলো ! গাড়ি এসে থামলো মহাজাতি সদনের সামনে ৷ আমি , পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় এবং অন্য একজন অনুষ্ঠান কর্মকর্তা গাড়ি থেকে নামলাম ৷ ভিতরে প্রবেশ করলাম ৷ তখন মঞ্চে সংগীত শিল্পী পিযূষ কান্তি সরকার রবীন্দ্র সংগীত পরিবেশন করছেন ৷ পুলক কাকুর পিছন পিছন এক’পা , দু’পা করে গ্রীনরুমে পৌঁছলিম ৷ দেখি সোফায় বসে আছেন আমার স্বপ্নের সংগীত শিল্পী মান্না দে ! নিজের চোখ’কে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না ! আমি কি বেঁচে আছি , নাকি ঘুমন্ত ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে আবোল তাবোল স্বপ্ন দেখছি ! হঠাৎ করেই সম্বিত ফিরে পেলাম একটা বাজখাই গলা শুনে ! “আরে আসুন আসুন পুলক বাবু , আপনার জন্যই অপেক্ষা করছি ৷ পিযূষের গানের পরই আমি মঞ্চে উঠবো ৷ আপনাকে কিন্তু আমার পাশে বসতে হবে , কেননা আপনি ভালো ভাবে জানেন পুলক বাবু যে আমি কি গান করবো , কোনটা করবো , তাছাড়া গানের কথা আমি ভীষণ ভুলে যাই !”– ( ওই সব কথা বলতে বলতে বেশ বুদ্ধিদিপ্ত হাসি মুখে আমার দিকে মাঝে মাঝে তাকাচ্ছিলেন ) “আরে এই অল্প বয়সী ছেলেটা কে , আপনার সাথে দেখছি ?” পুলক কাকু বললেন , ” এ হল বিদ্যুৎ ৷ বিদ্যুৎ ভৌমিক ৷ ইদানিং কালের হাতে গোনা তরুণ প্রজন্মের কবিদের মধ্যে অন্যতম একজন ৷ কবি হিসাবে বেশ নামটাম করছে বিদ্যুৎ !” পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মুখে আমার প্রসংশা শুনে আমি যেন ভীষণ ভাবে লজ্জায় মিশে যাচ্ছিলাম ! “বেশ বেশ , কি কবিতা লিখেছো একটু শোনাও দেখি ছেলে ?” হঠাৎ করে মান্না দে আমার কবিতা শুনতে চাইছেন ভেবে কবিতা – টোবিতা সব ওই মূহুর্তের জন্য ভুলতে বসে ছিলাম ৷ পুলক কাকু বললেন , “আরে ওটা বল না ৷” কোনটা কাকু ? “ওই যে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের যুবমানষ পত্রিকায় গত মাসে তোর যে কবিতাটা প্রকাশ হয়েছে , সেটা বল দেখি ৷” মান্না দে’র মুখোমুখি বসে কবিতাটা বলতে লাগলাম ৷
কবিতার নাম ,— সময় /
ঘরে ফেরার সময় হতেই
মৃদু কান্নার শব্দে মনে হয় ; কিছু ফেলে যাচ্ছি না তো !
নীলফুল , টকঝাল স্বপ্ন , ছদ্ম আদর্শ ,
কিম্বা রুঢ় অস্বীকারে বিমুখ প্রেম ……
অগাধ ধোওয়া বুক ভাড় করে তোলে ;
লোকে ভাবে কিছু দোষ করে ফিরছি ! তাকিয়ে দেখি ; পরে আছে আমার জন্মঋণ ,
আমার স্মৃতিছুট্ স-ম-য় !!
কবিতাটা বলা শেষ হতেই মান্না বাবু কিছুক্ষণের জন্য মৌন হয়ে গেলেন ! আমি তো ভাবলাম , গেল আমার কবিতা লেখা ! হঠাৎ চশমাটা রুমাল দিয়ে মুছতে মুছতে বললেন ,— “বাঃ – বাঃ বেশ বেশ ! তুমি তো বাবা বিদ্যুৎ ছুপাররুস্তম ! বেশ গভীর জলের মাছ ! বিশাল একটা চিন্তার জট আমার মনের গর্তে পাকিয়ে ফেলে দিয়ে বেশ নিশ্চিন্তি চুপ করে বসে আছ ! পুলক বাবু , এ ছেলে দেখি বড় রেশের ঘোড়া ! তোমার কবিতার হাত বেশ চমৎকার বিদ্যুৎ, তবে কি কবিতার পাশাপাশি গান লেখো ৷ আমরা যারা গান গেয়ে থাকি, আমাদের সব সময় একটু ভালো সুরের ভেতর শুদ্ধশব্দের কথা ভালো লাগে ! প্রত্যেক শিল্পী চায় , সে যে গানটি গাইছেন তার কথা ও সুর যেন সমান সমান হয় তবেই সেই গানের সার্থকতা, তাই না বিদ্যুৎ ? তুমি কবিতার লেখার পাশাপাশি গান লেখার চেষ্টা করে দেখো , পুলক বাবু তোমাকে সাহায্য করবেন !” এভাবে অনেকক্ষণ মান্না বাবুর সাথে মুখোমুখি অনেক কথাই আমার হয়েছিল ৷ তবে উনি বলছিলেন , আর আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো কথাগুলো তাঁর বসে বসে শুনছিলাম ! এরপর অনেকবার ওনার সাথে কলকাতার বিভিন্ন অনুষ্ঠানে দেখা সাক্ষাৎ হয়েছে ৷ এমন কি তিনি এও বলেছিলেন , মুম্বাইতে বিদ্যুৎ কবিতা বলতে গেলে আমার ফ্ল্যাটে আসতে ভুলো না , এসো কিন্তু ” ৷
আজ অনেক কথাই আমার কাছে স্মৃতি ! একে একে সবাই না ফেরার দেশে চলে গেলেন , মান্না দে , পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় , সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় , সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় আরও কত প্রিয় ও শ্রদ্ধার মানুষ ৷ যাঁদের আন্তরিক ভালোবাসা , আদোর , শাসন , স্নেহ শিক্ষা ও দীক্ষা আমি পেয়েছি ! এর জন্য আমি আমার অদেখা ঈশ্বরের কাছে আমৃত্যু ঋণী ৷
সব শেষে বলি ; পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় যদি না আমাকে আমার প্রিয় গাওয়ক মান্না দে’র সাথে সেদিন আলাপ করিয়ে না দিতেন আমার জীবনটা অনেকটাই অপূর্ণ থেকে যেতো ! আজ ভীষণ এই দু’জন মানুষের কথা মনে করে চোখের জল ধরে রাখতে পারছিনা !
পরিশেষে গিতিকার পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় এবং সংগীত শিল্পী মান্না দে’র প্রতি আমার অন্তরের অন্তঃস্থলের শ্রদ্ধা ও প্রণাম নিবেদন করলাম ৷ যেখানেই থাকুন এই দু’জন প্রিয় মানুষ , শান্তিতে থাকুন …..
ওঁ শান্তি …. ওঁ শান্তি …. ওঁ শান্তি …..
লেখকঃ বাংলা কাব্য সাহিত্যের অন্যতম জনপ্রিয় কবি, ছড়াকার ও বাচিক শিল্পী বিদ্যুৎ ভৌমিক