মানুষে হৃদপিণ্ডে ছিদ্র থাকা মূলত একটি জন্মগত ত্রুটি। সাধারণত গর্ভাবস্থায় শিশুর হৃৎপিণ্ডের বিকাশজনিত সমস্যা কারণে এই ছিদ্র দেখা দিতে পারে।
বাংলাদেশ হৃদরোগ বিশেষজ্ঞদের করা সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা গিয়ে, দেশটিতে প্রতি ১ হাজার শিশুর মধ্যে আট থেকে নয়জন এই হৃদপিণ্ডের ছিদ্রজনিত সমস্যায় ভুগে থাকে।
তবে প্রকৃত সংখ্যা আরো বেশি বলে ধারণা করছেন- বাংলাদেশ শিশু হাসপাতালের শিশু হৃদরোগ বিভাগের প্রধান এবং সিনিয়র কনসালট্যান্ট ডা. খলিফা মাহমুদ তারিক। যদি শুরুতেই সমস্যাটি ধরা পড়ে, তাহলে দ্রুত চিকিৎসার মাধ্যমে শিশুকে সম্পূর্ণ সুস্থ করা সম্ভব। তবে যদি দেরী হয়, জটিলতা ততো বাড়ে।
এর চিকিৎসা কেমন হবে সেটা নির্ভর করে ছিদ্রটি হার্টের কোথায় আছে এবং ছিদ্রটি কতো বড় সেটার ওপর।হৃদপিণ্ডের ছিদ্রের বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল, ব্রিটেনের স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ-এনএইচএস এবং বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের থেকে।
হৃদপিণ্ডে ছিদ্র
মানুষের হৃৎপিণ্ডের চারটি প্রকোষ্ঠ থাকে। ওপরের দুটি হল অলিন্দ বা অ্যাট্রিয়া ও নিচের দুটি নিলয় বা ভেন্ট্রিকল। ওপরের দুটি অ্যাট্রিয়া ইন্টারএট্রায়াল সেপ্টাম নামক পর্দা দিয়ে আলাদা করা থাকে এবং নিচের দুটি ভেন্ট্রিকল আলাদা করে রাখে ইন্টারভেন্ট্রিকুলার সেপ্টাম নামে আরেকটি পর্দা।
শিশুরা হার্টের বিভিন্ন অংশে ছিদ্র নিয়ে জন্মাতে পারে। ওপরের প্রকোষ্ঠের পর্দায় কোন ছিদ্র থাকলে তাকে অ্যাট্রিয়াল সেপ্টাল ডিফেক্ট (এএসডি) বলা হয়। নিচের পর্দার মধ্যে কোন ছিদ্র থাকলে তাকে ভেন্ট্রিকুলার সেপ্টাল ডিফেক্ট (ভিএসডি) বলে।
এই ছিদ্রের কারণে হার্ট ও ফুসফুসের মধ্যে রক্ত চলাচল অস্বাভাবিক হয়ে পড়ে। মানবদেহের ফুসফুস রক্তে অক্সিজেনের যোগান দেয়। আর সেই অক্সিজেনযুক্ত রক্ত সারা শরীরে পরিবহনের কাজ করে হৃদপিণ্ড।
শরীরের দূষিত রক্ত মহাশিরার মাধ্যমে প্রথমে হৃদপিণ্ডের ডান অলিন্দে প্রবেশ করে তার পর ডান নিলয়ে প্রবেশ করে। এই নিলয় থেকে দূষিত রক্ত ফুসফুসীয় ধমনীর মাধ্যমে ফুসফুসে পৌঁছায়।
ফুসফুস ওই দূষিত রক্তে অক্সিজেনের যোগান দেয়। এরপর ফুসফুস থেকে বিশুদ্ধ রক্ত হৃদপিণ্ডের বাম অলিন্দে প্রবেশ করে এরপর বাম নিলয়ে যায়। হৃদপিণ্ডের বাম নিলয়ে আসা এই অক্সিজেন সমৃদ্ধ বিশুদ্ধ রক্ত মহা-ধমনীর মাধ্যমে সারা শরীরে প্রবাহিত হয়।
হার্টে ছিদ্র থাকলে অর্থাৎ এএসডি বা ভিএসডি থাকলে ফুসফুসের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত রক্ত চলাচল অস্বাভাবিক হয়ে পড়ে। কারণ ছিদ্রটি রক্তের স্বাভাবিক গতিপথে বাধা দেয়।
বাম অলিন্দ থেকে অক্সিজেন সমৃদ্ধ বিশুদ্ধ রক্ত বাম নিলয়ে যাওয়ার কথা থাকলেও, এএসডি এর কারণে কিছু বিশুদ্ধ রক্ত ডান অলিন্দে চলে যায়। এতে বিশুদ্ধ রক্ত দূষিত রক্তের সাথে মিশে যায় এবং ফুসফুসের দিকে প্রবাহিত রক্তের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়।
আবার ভিএসডি থাকলে বাম নিলয়ের কিছু বিশুদ্ধ রক্ত ছিদ্র দিয়ে ডান নিলয়ে প্রবেশ করে। এতে বিশুদ্ধ ও দূষিত রক্ত একসাথে মিশে যায়। এই রক্তই আবার ফুসফুসে ফিরিয়ে আনে। ছিদ্র বড় হলে বা দীর্ঘদিন ধরে থাকলে হার্ট এবং ফুসফুসের ক্ষতি করতে পারে।
এতে ফুসফুসের ধমনীতে রক্তচাপ বেড়ে যায়। হৃৎপিণ্ডকে তখন রক্ত পাম্প করার জন্য আরও কঠোর পরিশ্রম করতে হয়। এতে হার্টের ভালভের ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি হয়। ফলে ভালভ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
এছাড়া ফুসফুসের ধমনীতে উচ্চ রক্তচাপ বা পালমোনারি হাইপারটেনশন দেখা দিতে পারে। যা স্থায়ীভাবে ফুসফুসের ক্ষতি করতে পারে। এতে ফুসফুস অক্সিজেন সরবরাহে ব্যর্থ হয়। যা শিশুকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিতে পারে।
শিশুর হার্টে ছিদ্র কেন হয়
শুরুতেই বলা হয়েছে হৃদপিণ্ডে ছিদ্র হওয়া একটি জন্মগত ত্রুটি। অর্থাৎ শিশু হার্টে ছিদ্র নিয়েই জন্মায়। বাহ্যিক কোন কারণে হার্টে ছিদ্র হওয়ার নজির নেই।
মাতৃগর্ভে শিশুর হৃৎপিণ্ড একটি নল থেকে বিকশিত হয়, এরপর সেটি চারটি প্রকোষ্ঠে ভাগ হয়। সেই প্রকোষ্ঠের দুটি অংশ আলাদা করতে পর্দা গড়ে ওঠে।
এই প্রক্রিয়া চলাকালীন কোন সমস্যা হলে ছিদ্র দেখা দিতে পারে বলে জানিয়েছেন, ডা. খলিফা মাহমুদ তারিক।
জেনেটিক সমস্যা যেমন: ডাউন সিনড্রোম থাকলে শিশুর হার্টে ছিদ্র দেখা দিতে পারে। সেইসাথে গর্ভবতী হওয়ার প্রথম কয়েক মাসের মধ্যে যদি মায়ের রুবেলা হয় তাহলে শিশুর হার্টে ছিদ্র বা হার্টের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে জন্মানোর ঝুঁকি বাড়ে।
মায়ের যদি অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস থাকে।গর্ভকালীন মায়ের ভাইরালজনিত ইনফেকশন হলে। মা গর্ভকালীন অপুষ্টিজনিত রোগে ভুগলে। সেইসাথে মায়ের মদ ও তামাক জাতীয় পণ্য খাওয়ার অভ্যাস থাকলে এবং বিভিন্ন মাদক সেবনের কারণেও এমনটা হতে পারে।
এছাড়া গর্ভবতী থাকাকালীন মা যদি খিঁচুনি প্রতিরোধী ওষুধ, কোলেস্টরেল কমানোর ওষুধ, ব্রণের ওষুধ এবং মানসিক রোগের চিকিৎসার জন্য ওষুধ খেয়ে থাকেন। সেটিও শিশুর ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে। এছাড়া কোন সুস্পষ্ট কারণ ছাড়াও শিশুর হার্টে ছিদ্র দেখা দিতে পারে।
লক্ষণ
শিশু বড় হতে থাকলে তাদের ছুটোছুটি বাড়ে। এতে হার্টের ওপর চাপ বাড়ে। তখন লক্ষণ প্রকাশ পেতে শুরু করে। হার্টের এ ছিদ্র ছোট-বড় হওয়ার ওপর নির্ভর করে লক্ষণগুলো কেমন হবে।
যদি ছিদ্র বড় হয়, তাহলে উপরের সমস্যার পাশাপাশি শিশু উচ্চ-রক্তচাপে ভোগে। ফুসফুসে পর্যাপ্ত রক্ত সরবরাহের অভাবে অক্সিজেন স্বল্পতায় অনেক সময় শিশুর ঠোঁট, জিহ্বা নীল হয়ে ওঠে। এ ধরণের লক্ষণ দেখা দেয়ার সাথে সাথে দেরি না করে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে বলা হয়েছে।
চিকিৎসা
সাধারণত চেস্ট এক্স-রে, ইলেক্ট্রোকার্ডিওগ্রাম (EKG), ইকোকার্ডিওগ্রাম, কার্ডিয়াক ক্যাথেটারাইজেশন ইত্যাদি পরীক্ষার মাধ্যমে এই ছিদ্র আছে কী না তা শনাক্ত করা হয়। হার্টের জন্মগত এসব ছিদ্রের চিকিৎসা নির্ভর করে ছিদ্রের আকার ও অবস্থানের ওপর। ছোট আকারের ছিদ্র কয়েক মাস পর নিজে থেকেই বন্ধ হয়ে যায়।
হার্টের এই ছিদ্র বড় নাকি ছোট সেটা নির্ভর করে রোগীর বয়সের ওপর। এ বিষয়ে মি. তারিক বলেন, “একজন প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষের জন্য চার থেকে পাঁচ মিলিমিটার ছিদ্র অনেক ছোট। কিন্তু এই ছিদ্র শিশুদের ক্ষেত্রে অনেক বড়।”
হার্টে ছিদ্রের কারণে যেহেতু দূষিত ও বিশুদ্ধ রক্ত মিশে যায়। ছিদ্র ছোট হলে কম রক্ত মিশ্রিত হয়, ছিদ্র বড় বলে বেশি রক্ত মিশে।সেক্ষেত্রে ছোট ছিদ্রগুলো বন্ধ হওয়ার আগ পর্যন্ত কিছু ক্ষেত্রে ওষুধ প্রয়োগ করে ফুসফুসের বাড়তি রক্তের চাপ কমিয়ে রাখা হয়।
তবে মাঝারি বা বড় আকারের ছিদ্র হলে জটিলতা প্রতিরোধ করার জন্য শিশুদের জীবনের প্রথম দিকে অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন হতে পারে।আবার রক্তনালীর ভালভের খুব কাছে ছিদ্র থাকলে অস্ত্রোপচার ছাড়া উপায় নেই।
অস্ত্রোপচার সাধারণত শিশু জন্মের প্রথম কয়েক সপ্তাহ থেকে কয়েক মাসের মধ্যে করা হয়। সবচেয়ে ভালো স্কুলে ভর্তি করার আগে অস্ত্রোপচার সেরে নিলে।
সার্জন বুকের দেয়ালে একটি ছেদ তৈরি করে অস্ত্রোপচার করে থাকেন।সার্জন সরাসরি ছিদ্রটি সেলাই করতে পারেন বা ছিদ্রের উপরে একটি প্যাচ বসিয়ে দিতে পারেন। হার্টের টিস্যু প্যাচ বা সেলাইয়ের অংশটি নিরাময় করে।
এভাবে অস্ত্রোপচারের ছয় মাসের মধ্যে টিস্যুটি সম্পূর্ণ ছিদ্রটিকে ঢেকে দেয়।আবার কার্ডিয়াক ক্যাথেটারাইজেশনের মাধ্যমেও অস্ত্রোপচার করা হয়। এজন্য শিশুর পায়ের রক্তনালীতে একটি পাতলা, নমনীয় টিউব (ক্যাথেটার) ঢুকিয়ে হার্টের দিকে নিয়ে যাওয়া হয়। এই ক্যাথেটারের আগায় জালের মতো ডিভাইস বসানো থাকে।
এরপর হার্টের ছিদ্রের ভেতরে ডিভাইসটি ঢুকিয়ে জালটি ছিদ্রের আশেপাশের পর্দায় ছড়িয়ে বসানো হয়।সময়ের সাথে সাথে শরীরের নতুন কোষ ডিভাইসের ওপর তৈরি হতে থাকে। অন্তত ছয় মাসের মধ্যে যন্ত্রটি শরীরের নিজস্ব অংশ হয়ে যায়।
এই ধরণের অস্ত্রপচারে কাটাছেঁড়া না হওয়ায় কম সময় লাগে, শিশুরা অল্প সময়েই সেরে ওঠে।তবে ছিদ্র অনেক বড় হলে বা ছিদ্রটি জটিল জায়গায় হলে ওপেন হার্ট সার্জারি ছাড়া উপায় নেই। শিশুর জন্মের দুই মাস বয়সের পর থেকে এই অস্ত্রপচার করা সম্ভব।
করণীয়
শিশুর হার্টে ছিদ্র শনাক্ত হলে চিকিৎসকের পরামর্শে শিশুকে নিয়মিত ওষুধ খাওয়ানোর সঙ্গে সঙ্গে শিশুর প্রতি বেশি যত্নবান হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসকরা।
এই খেলাধুলা, ছুটোছুটি বা কায়িক শ্রম হয় এমন কাজ থেকে বিরত রাখতে বলা হয়েছে।যদি ছিদ্র বড় হয় সেক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শে যত দ্রুত সম্ভব অপারেশন করাতে পারলে ভালো। এতে শিশুটি দ্রুত স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবে।
চিকিৎসার পর শিশুরা সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠলেও চিকিৎসকরা দীর্ঘসময় ধরে তাদের নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করেন। এজন্য নিয়মিত ফলো-আপ ভিজিট করতে হবে।
সঠিক সময়ে চিকিৎসা না করালে হার্ট বড় হয়ে যেতে পারে। সেই সাথে হৃৎপিণ্ডের ভেতরের পৃষ্ঠে রক্তের ব্যাকটেরিয়াজনিত সংক্রমণ এন্ডোকার্ডাইটিস হওয়ার ঝুঁকি থাকে, হার্টের ভালভ নষ্ট হওয়া, এরিথমিয়া এমনকি হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোকের ঝুঁকিও বাড়ে।
নিউজ /এমএসএম