মা বাবার স্বপ্ন পুরন করে এখন এলাকায় ফিরে উচ্চসিত সামিরা মুকিত। গ্রামের সবাই এখন মুখরিত সামিরার প্রসংশায়। মা বাবা দুইজনের মধ্যে সে মায়ের তদারকি বেশি পেয়েছে। দেড় লাখ প্রতিযোগিকে পিছনে পেলে গ্রামের মেয়ে সামিরা মুকিত চৌধুরী এখন দেশ সেরা বাংলাবিদ। বৃহস্পতিবার সে মা বাবার সঙ্গে ঢাকা থেকে বাড়ি ফিরেছে।
মা চাইতেন মেয়ে বাংলা ভাষায় দক্ষতা প্রমাণ করে দেশসেরা বাংলাবিদ হোক। মায়ের ইচ্ছা পুরণ করতেই হবিগঞ্জের নবীগঞ্জের পল্লী গ্রামের মেয়ে সামিরা মুকিত চৌধুরী প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়। এরপর সে ধাপে ধাপে দেশের সেরা বাংলাবিদ নির্বাচিত হয়েছে। পুরস্কার হিসেবে পেয়েছে ১০ লাখ টাকার মেধাবৃত্তি।
সামিরার বাড়ি হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ উপজেলার খনকারীপাড়া গ্রামে। সে নবীগঞ্জ উপজেলা হোমল্যান্ড আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের দশম শ্রেণির বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রী। বাবা মোহাম্মদ আবদুল মুকিত চৌধুরী কেন্দ্রীয় যুবলীগের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সম্পাদক ও বিশিষ্ট ব্যবসায়ী এবং মা আছিয়া খাতুন ইয়াছমিন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। দুই বোন ও এক ভাইয়ের মধ্যে সামিরা সবার বড়।
গত ১ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে ‘ইস্পাহানি মির্জাপুর বাংলাবিদ’ প্রতিযোগিতায় বাংলা ভাষায় নিজের দক্ষতা প্রমাণ করে চুড়ান্ত বিজয়ী হয় সামিরা মুকিত চৌধুরী। এবার পঞ্চমবারের মতো এই প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। সারা দেশের দেড় লাখের বেশি প্রতিযোগী এতে অংশ নেয়। এর মধ্যে চুড়ান্ত পর্বে সেরা ছয় প্রতিযোগী লড়াই করে। সেখান থেকে বিজয়ী বাছাই করেন বিচারকেরা।
সামিরা মুকিতের চাচা সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবি জাহিদুল ইসলাম চৌধুরী রফি বলেন, আমার ভাতিজি গ্রামে বসবাস করলেও সে যে এভাবে জাতীয় পর্যায়ে সেরা হবে এটা ছিলো কল্পনার বাহিরে। সে এই সুনাম শুধু আমাদের পরিবারের জন্য নয় সমগ্র হবিগঞ্জের জন্য বয়ে এনেছে।
খনকারিপাড়া গ্রামের শাহ শামীম আলম বলেন, সামিরা মুকিত শুধু আমাদের গ্রামের নয় সারা জেলা ও বিভাগের সুনাম খুড়িয়েছে।তাকে নিয়ে আমরা গ্রামবাসী গর্বিত। আগামীতে সে আরও সুনাম বয়ে আনুক সেই দোয়া করি।
বৃহিস্পতিবার কথা হয় সামিরার সঙ্গে। সে জানায়, তার মায়ের দীর্ঘদিনের ইচ্ছা ছিল সে যেন বাংলাবিদ প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়। তবে করোনা মহামারির সময় এ প্রতিযোগিতা বন্ধ ছিল। মহামারির পর প্রথম আয়োজনে সে অংশ নেয়। গ্রামের মেয়ে হিসেবে সেরা সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রতিযোগীদের সঙ্গে পারবে কি না, তা নিয়ে বিচলিত থাকলেও পরে আত্মবিশ্বাস নিয়ে এগিয়ে যায়। এতেই সাফল্য পেয়েছে সে।
সামিরা বলে, ‘সব সময় শুদ্ধ বানান শেখার চেষ্টা করতাম। কখনো যেন বানান ভুল না হয়, সে জন্য সচেতন থাকতাম। তবে বাংলা বানান যেন শুদ্ধভাবে জানি, সে জন্য মা আমাকে নানাভাবে সহযোগিতা করেছেন। বাবার অনুপ্রেরণাও ছিল। বাংলা ভাষা ও ব্যাকরণ এবং বাংলা সাহিত্য সম্পর্কে আমার জানার তীব্র আগ্রহ আছে। তাই পাঠ্যপুস্তকের বাইরে কবিতা, গল্প, উপন্যাসসহ বিচিত্র বিষয়ের বই পড়ি। আর এই প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার পর বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি আগ্রহ আরও বেড়ে গেছে।’
দেড় লক্ষ প্রতিযোগীকে পেছনে ফেলে প্রথম হওয়ার বিষয়ে সামিরা বলেন, ‘কল্পনাও করিনি, আমি দেশসেরা হব। শুরুর দিকে খুব একটা ভালো না করলেও শেষের দিকে ভালো করি। আসলে কোন জায়গা থেকে আমি এসেছি, সেটা গুরুত্বপুর্ণ নয়। মুলত, আমি কী জানি, সেটাই গুরুত্বপুর্ণ। নিজেকে যোগ্য করে তুলতে হবে। নিজের মেধাকে যথাযথভাবে কাজে লাগালে প্রত্যাশা অনুযায়ী সাফল্য আসবেই।’ এর সঙ্গে সে যোগ করে, ‘এটা ঠিক, আমি শুরু থেকে অনেক ভয়ে ছিলাম। দেশের ভালো ভালো বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এ প্রতিযোগিতায় ছিল। এর বিপরীতে আমি মফস্বলের একটা বিদ্যালয় থেকে এসেছি। তবে একটা পর্যায়ে নিজের মনোবল ফিরে পাই। বুঝতে পারি, আত্মবিশ্বাস থাকলে সাফল্য অর্জন করা খুব একটা কঠিন নয়।’
সামিরা মুকিত চৌধুরী এখন নিজের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শুদ্ধ বাংলা ভাষা, বানান ও সাহিত্যের চর্চা ছড়িয়ে দিতে একটা সংগঠন চালু করার পরিকল্পনার কথা জানায়। সে বলে, ‘আমার সাফল্যে নিশ্চয় অন্যরা অনুপ্রাণিত হবে। তারা যেন বাংলা সাহিত্যের ভালো ভালো বই পড়তে আগ্রহী হয়, সে জন্য তাদের উদ্বুদ্ধ করব। এ জন্য একটি সংগঠন কিংবা সংঘ গড়তে চাই। সেই সংগঠনের মাধ্যমে শুদ্ধ বাংলা ভাষার চর্চাকে ছড়িয়ে দিতে চাই।’
মেয়ের সাফল্যে খুশি সামিরার বাবা মোহাম্মদ আবদুল মুকিত চৌধুরী বলেন, আমার মেয়ে এলাকার জন্য সুনাম বয়ে এনেছে এটার জন্য সবার দোয়া চাই। তিনি বলেন আমরা সব সময় চিন্তা করতাম মেয়েকে ভালো কাজে সম্পৃক্ত করার জন্য। বাংলাবিদ প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার জন্য তার খুবই আগ্রহ ছিলো। তার আগ্রহ ও মেধা থেকে সে সেরা হয়েছে। আগামীতে তাকে ভালো কাজে সম্পৃক্ত রাখার চেষ্টা করবো।
সামিরা মুকিতের মা আছিয়া খাতুন ইয়াছমিন বলেন ‘নবীগঞ্জ একটা প্রান্তিক অঞ্চল। এমন জায়গার একটা বিদ্যালয় থেকে রাজধানীতে গিয়ে আমার মেয়েটি যে কৃতিত্ব অর্জন করেছে, এটা সবাইকে উজ্জীবিত করেছে। এ সাফল্যে অন্য শিক্ষার্থীরাও উজ্জীবিত হয়েছে