সাংবাদিক সংগঠনগুলোর তীব্র আপত্তির মুখে অবশেষে সাইবার নিরাপত্তা বিলের কয়েকটি ধারায় সংশোধন আনা হচ্ছে। তবে সন্দেহভাজনকে বিনা পরোয়ানায় তল্লাশি ও গ্রেপ্তারের ধারার তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি। প্রস্তাবিত আইনের ৪২ ধারায় বিনা পরোয়ানায় তল্লাশি ও গ্রেপ্তারের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। সাংবাদিকদের কয়েকটি সংগঠন এটি বাতিলের দাবি জানালেও তা পুরোপুরি গ্রহণ না করে এখানে সন্দেহভাজনদের পুলিশ পরিদর্শক পর্যায়ের কর্মকর্তারা এই ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারবেন, এমন সংশোধনী আনা হচ্ছে।
বৃহস্পতিবার (৭ সেপ্টেম্বর) ডাক টেলিযোগাযোগ ও তথ্য প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে কয়েকটি ধারা সংশোধনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়। বৈঠক শেষে আইনমন্ত্রী আনসুল হক সাংবাদিকদের জানান, আগামী দুয়েকদিনের মধ্যে সংশোধিত খসড়া প্রকাশ করা হবে।
দুপুরে জাতীয় সংসদ ভবনে এ বৈঠকে কয়েকটি সাংবাদিক সংগঠনের নেতারা অংশ নেন। বিশেষ আমন্ত্রণে বৈঠকে ছিলেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক এবং ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার। বিতর্কিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন রহিত করে গত মঙ্গলবার সাইবার নিরাপত্তা বিল সংসদে তোলা হয়। এরপর বিলটি পরীক্ষা করে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য ৫ দিনের সময়সীমা বেধে দিয়ে ডাক টেলিযোগাযোগ ও তথ্য প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে পাঠানো হয়।
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক এর আগে বলেছিলেন, বিলটি সংসদীয় কমিটিতে গেলে সেখানে অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা করা হবে। গতকালের বৈঠকে শুধু সাংবাদিকদের কয়েকটি সংগঠনের নেতারা উপস্থিত ছিলেন। তবে তাদের সবাইও পুরোপুরি সন্তুষ্ট হননি।
বৈঠক শেষে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা অনেক পরিবর্তন করেছি। ২১ ধারার বিষয়ে বিএফইউজে থেকে পরামর্শ দেয়া হয়েছে, আমরা তা গ্রহণ করেছি। ৩২ ধারার অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট আমরা বাতিল করে দিয়েছি, এ আইনে সেটা থাকবে না। মিথ্যা মামলার বিষয়ে যে পরামর্শ এসেছে সেটা আমরা গ্রহণ করেছি। সেটা থাকবে। আজকের বৈঠকে এটি চূড়ান্ত হয়েছে।
জাতীয় প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক শ্যামল দত্ত সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা সুনির্দিষ্টভাবে কিছু প্রস্তাব দিয়েছি। যে সমস্ত বিষয়ে সাংবাদিকতা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। যে বিষয়গুলেঅ নিয়ে আমাদের উদ্বেগ আছে সেটা আমরা কমিটিতে জানিয়েছি। তারা বলেছেন, তারা এগুলো সংশোধন করবেন। দুয়েকদিনের মধ্যে সংশোধিত খসড়া আইন ওয়েবসাইটে পাওয়া যাবে।’ তিনি বলেন, ‘২১, ৩২ ধারাসহ কিছু কিছু ক্ষেত্রে তারা সংশোধন এনেছেন। ৪২ ধারায় সংজ্ঞায় কিছুটা সংশোধন আনা হয়েছে।’
বৈঠকে ১৪ দফা দাবি জানিয়েছিল বিএফইউজে (একাংশ)। বৈঠক শেষে এই অংশের সভাপতি এম আবদুল্লাহ বলেন, তারা কয়েকটি দাবি মেনে নিয়েছে। দু-একটি জায়গায় ভাষাগত পরিবর্তনে এনেছে। তবে, আমরা এতে সন্তুষ্ট নই। আমরা আলোচনাকালে আমাদের ১৪ দফা দাবির বিষয়ে অনড় ছিলাম। বিশেষ করে ৪২ ধারায় বিনাপরোয়ানায় গ্রেফতার, তল্লাশির বিষয়ে আপত্তি জানিয়েছি। ওনারা সেটা গ্রহণ করেননি। আমরা বলেছি, স্বাধীন সাংবাদিকতায় বাধাগ্রস্ত হয় এমন ধারাগুলো বাতিলে করে সংশোধনী আনলেই কেবল আমরা মেনে নেবো।
খসড়া আইনের ৩২ ধারায় বলা হয়েছিল, যদি কোনো ব্যক্তি অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টের আওতাভুক্ত কোনো অপরাধ কম্পিউটার, ডিজিটাল ডিভাইস, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক, ডিজিটাল নেটওয়ার্ক বা অন্য কোনো ডিজিটাল বা ইলেকট্রনিক মাধ্যমে সংঘটন করেন বা করিতে সহায়তা করেন, তাহা হইলে তিনি অনধিক ৭ (সাত) বৎসর কারাদণ্ডে, বা অনধিক ২৫ (পঁচিশ) লক্ষ টাকা অর্থদণ্ডে বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হইবেন। এই ধারাটি বাতিল করা হচ্ছে।
বিলের ২১ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি ডিজিটাল বা ইলেকট্রনিক মাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, জাতীয় সংগীত বা জাতীয় পতাকার বিরুদ্ধে কোনো প্রকার প্রপাগান্ডা ও প্রচারণা চালান বা তাতে মদদ দেন, তাহলে তা হবে অপরাধ। এর সাজা হবে সর্বোচ্চ ৫ বছরের কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ এক কোটি টাকা অর্থদণ্ড বা উভয়দণ্ড।
এই ধারায় কিছু শব্দগত পরিবর্তন আনা হচ্ছে। এই ধারায় বিএফইউজের প্রস্তাব ছিল ‘বিদ্বেষ, বিভ্রান্তি ও কুৎসামূলক প্রচারণা চালানো হবে অপরাধ’ এটি প্রতিস্থাপন করা। তাদের এই প্রস্তাবটি গ্রহণ করেছে সংসদীয় কমিটি। প্রস্তাবিত আইনের ৪২ ধারায় বিনা পরোয়ানায় তল্লাশী ও গ্রেপ্তারের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। সাংবাদিকদের কয়েকটি সংগঠন এটি বাতিলের দাবি জানিয়েছিল। তবে তা পুরোপুরি গ্রহণ করা হয়নি। এখানে পুলিশ পরিদর্শক পর্যায়ের কর্মকর্তারা এই ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারবেন, এমন সংশোধনী আনা হচ্ছে।
জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক মনজরুল আহসান বুলবুল বলেন, ‘তারা কিছু বিষয়ে সংশোধনী এনেছে। ৪২ ধারায় সংজ্ঞাগত কিছু পরিবর্তন এনেছে। সাব- ইন্সপেক্টার পর্যায়ের কর্মকর্তার স্থলে ইন্সপেক্টর পর্যায়ের কর্মকতার করা হয়েছে। তবে আমরা এক্ষেত্রে সন্তুষ্ট নই। আমরা প্রেস কাউন্সিলের কথাই বলেছি।’
বৈঠক শেষে সংসদ সচিবালয়ের এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বৈঠকে “সাইবার নিরাপত্তা বিল, ২০২৩” বিলের উপর বিস্তারিত আলোচনা শেষে পরীক্ষা-নিরীক্ষাপূর্বক সংশোধিত, সংযোজিত ও পরিমার্জিত আকারে রিপোর্ট সংসদে উত্থাপনের সিদ্ধান্ত গৃহিত হয়।
সংসদীয় কমিটির সভাপতির অনুপস্থিতিতে কমিটির সদস্য রেজওয়ান আহাম্মদ তৌফিকের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয় বৈঠকে কমিটির সদস্য তথ্য ও প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক, ফাহমী গোলন্দাজ বাবেল, আহমেদ ফিরোজ কবির, মোঃ নুরুল আমিন, মনিরা সুলতানা এবং জাকিয়া পারভীন খানম বৈঠকে অংশ নেন। সভাপতির বিশেষ আমন্ত্রণে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক এবং ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বৈঠকে অংশ নেন। এছাড়া বিএফইউজে একাংশের মহাসচিব দীপ আজাদ, বিএফইউজে আরেকাংশের সভাপতি এম আব্দুল্লাহ, মহাসচিব নুরুল আমিন রোকন, প্রেসক্লাব সভাপতি ফরিদা আক্তার, ডিইউজে’র সভাপতি সোহেল হায়দার চৌধুরী, সাধারণ সম্পাদক আকতার হোসেন প্রমুখ বিশেষ আমন্ত্রণে উপস্থিত ছিলেন।
নিউজ /এমএসএম