শেষবারের মতো এলাকাবাসীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় সিক্ত হলেন সাবেক ধর্মমন্ত্রী বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যক্ষ মতিউর রহমান (৮১)। বিপুল সংখ্যক মানুষের অংশগ্রহণে সোমবার (২৮ আগস্ট) বাদ আছর ময়মনসিংহ নগরীর আঞ্জুমান ঈদগাহ মাঠে তার প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হয়েছে।
আওয়ামী লীগের সাবেক কার্যনির্বাহী সদস্য অধ্যক্ষ মতিউর রহমান ছিলেন ময়মনসিংহের রাজনৈতিক অঙ্গনের অবিসংবাদিত নেতা। স্থানীয় রাজনীতির বটবৃক্ষ ও সিংহপুরুষ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয় তাকে। বর্ষীয়ান এ রাজনীতিকের চিরবিদায়ে শোকের ছায়া নেমে এসেছে ময়মনসিংহে। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ছাড়াও সাধারণ মানুষও শোকে বিহ্বল হয়ে পড়েছে। মতিউর রহমানের মৃত্যুতে শোক প্রকাশের জন্য এদিন নগরের বিভিন্ন এলাকার বিপণীবিতান বন্ধ রাখা হয়। তার আত্মার মাগফেরাত ও শান্তি চেয়ে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছেন নেটিজেনরাও।
গতকাল রোববার রাত ১১টার দিকে ময়মনসিংহ নগরীর ধোপাখোলা এলাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন অধ্যক্ষ মতিউর রহমান। দীর্ঘদিন ধরেই বার্ধক্যজনিত নানা রোগে ভুগছিলেন তিনি। মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী, এক পুত্র ও দুই কন্যাসহ অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন।
কীর্তিমান এই রাজনীতিবিদের মৃত্যুতে শোক জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিরোধীদলীয় নেত্রী ও ময়মনসিংহ-৪ (সদর) আসনের সংসদ সদস্য বেগম রওশন এরশাদ, সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কেএম খালিদ, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী শরীফ আহমেদ, ময়মনসিংহ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ইকরামুল হক টিটু, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. এমদাদুল হক চৌধুরীসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, পেশাজীবী ও সকল শ্রেণি-পেশার মানুষ।
সোমবার সকালে নগরীর আলমগীর মনসুর মিন্টু মেমোরিয়াল কলেজ প্রাঙ্গণে অধ্যক্ষ মতিউর রহমানের মরদেহ রাখা হয় সকলের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য। তাকে শেষবার দেখতে কলেজ মাঠে আসেন দলমত-নির্বিশেষে সব শ্রেণির মানুষ। এ সময় জাতীয় সংসদের হুইপ আতিকুর রহমান আতিক, সিটি মেয়র, বিভাগীয় কমিশনার, ডিআইজি, জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, ময়মনসিংহ প্রেসক্লাবসহ বিভিন্ন সংগঠন ও হাজারো মানুষ মরহুমের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানায়। পরে বাদ আছর ময়মনসিংহ নগরীর আঞ্জুমান ঈদগাহ মাঠে মরহুমের জানাজা অনুষ্ঠিত হয়।
জানাজার আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষ থেকে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাকসহ প্রতিনিধি দল শ্রদ্ধা জানায়। পরে শোক জানিয়ে বক্তব্য দেন কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক, আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন, শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল, গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী শরীফ আহমেদ, সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ, সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী আশরাফ আলী খান খসরু, ধর্মপ্রতিমন্ত্রী ফরিদুল হক খান, প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী মশিউর রহমান হুমায়ুন, সিটি মেয়র ইকরামুল হক টিটু, মরহুমের ছেলে ও ময়মনসিংহ মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোহিত উর রহমান প্রমুখ।
কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ছাত্রজীবন থেকে অধ্যক্ষ মতিউর রহমানের সাহচার্যে রাজনীতি করেছি। ইতিহাসে অধ্যক্ষ মতিউর রহমানের সাহসিকতা স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। তিনি সকলের ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার মানুষ ছিলেন। আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে এমন নেতা বিরল।
সিটি মেয়র ও মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ইকরামুল হক টিটু বলেন, আমরা রাজনৈতিক অভিভাবককে হারিয়েছি। বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যক্ষ মতিউর রহমান ছিলেন আওয়ামী লীগের একজন নিবেদিতপ্রাণ নেতা। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে তিনি আজীবন লালন করেছেন। তার মৃত্যু আওয়ামী লীগের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি।
জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এহতেশামুল আলম বলেন, আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে যে ত্যাগ অধ্যক্ষ মতিউর রহমানের, তার সেই আদর্শকে ধারন করে দলকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে।
আগামীকাল মঙ্গলবার নগরের আকুয়ায় দ্বিতীয় জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে অধ্যক্ষ মতিউর রহমানের মরদেহ দাফন করা হবে বলে জানিয়েছেন তার বড় ছেলে মোহিত উর রহমান শান্ত।
মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ও ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যক্ষ মতিউর রহমানের নেতৃত্বে ১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর ময়মনসিংহকে মুক্ত ঘোষণা করা হয়। মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে গত বছর একুশে পদক পান সামরিক, স্বৈরাচার বিরোধী, সব গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অন্যতম এই নেতা।
আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা জানান, ১৯৫৮ সালে আওয়ামী রাজনীতিতে নাম লেখানো অধ্যক্ষ মতিউর রহমান হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার মতো মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর আদর্শতলে ভিড়িয়েছেন অসংখ্য মানুষকে। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত দুই মেয়াদে দীর্ঘ ২৩ মাস কারাবরণও করেন। তিনি ২০০২ সালে ময়মনসিংহের চারটি সিনেমা হলে বোমা হামলার মিথ্যা মামলাতেও কারাবরণ করেন। শত প্রলোভনের মুখে আওয়ামী লীগের রাজনীতির প্রতি অবিচল থেকে তিনি তার সাংগঠনিক দায়িত্ব পালনে পিছপা হননি। সাংগঠনিক জীবনে অধ্যক্ষ মতিউর রহমান দুইবার ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তিনি জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে ১৯৯৬ সাল থেকে টানা ১৮ বছর দায়িত্ব পালন করেন।
দলীয় নেতৃত্বের প্রতি আনুগত্য ও জাতীয় স্বার্থে ত্যাগ স্বীকারের কারণে ১২ জানুয়ারি ২০১৪ থেকে ৬ জানুয়ারি ২০১৯ পর্যন্ত মতিউর রহমান ধর্মমন্ত্রী (টেকনোক্রেট কোটা) হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন। তিনি ময়মনসিংহ-৪ (সদর) আসন থেকে ১৯৮৬ ও ২০০৮ সালের নির্বাচনে সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন।
দলীয় সূত্রে জানা যায়, ২০০৮ সালের পর থেকে বিভিন্ন সময়ে তিনি জাতীয় সংসদের অর্থ মন্ত্রণালয়, রেলপথ মন্ত্রণালয়, ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি ও সদস্য হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়াও জাতীয় সার সমন্বয় ও বিতরণ কমিটি এবং বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের সদস্য, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের বোর্ড অব গভর্ন্যান্সের গভর্নর, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট সদস্য হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়াও তিনি ১৯৯৬ সালে একবার বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সদস্য এবং ২০০৮ সাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত তিনবার সিন্ডিকেট সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। স্বাধীনতার পর থেকে মোট তিনবার তৎকালীন ময়মনসিংহ পৌরসভার নির্বাচিত চেয়ারম্যানও ছিলেন অধ্যক্ষ মতিউর রহমান।
অধ্যক্ষ মতিউর রহমান ১৯৪২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি ময়মনসিংহ সদর উপজেলার আকুয়া গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছোটবেলা থেকেই শিক্ষার প্রতি অনুরক্ত ছিলেন। রাজনীতি করলেও পড়ালেখা থেকে দূরে থাকেননি।
১৯৫৩ সালে আকুয়া মডেল প্রাইমারি স্কুল থেকে বৃহত্তর ময়মনসিংহ তথা শেরপুর, টাঙ্গাইল, জামালপুরসহ বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলায় প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করেন। ১৯৫৮ সালে ম্যাট্রিক পরীক্ষায়ও কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হন। ১৯৬১ সালে ময়মনসিংহের সরকারি আনন্দ মোহন কলেজ থেকে বিজ্ঞান বিভাগে উচ্চ মাধ্যমিক ও একই কলেজ থেকে ১৯৬৪ সালে বিএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এ সময় কিছুদিন গফরগাঁও থানার পাঁচবাগ উচ্চ বিদ্যালয়ে ও মনোহরদী থানার হাতিরদিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ে বিএসসি শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৬ সালে পুনরায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগে ভর্তি হয়ে ১৯৬৭ সালে এমএসসি ডিগ্রি অর্জন করেন।
এরপর শিক্ষকতা দিয়ে শুরু করেন পেশাগত জীবন। ১৯৬৭ সালের দিকে তিনি জামালপুরের নান্দিনা কলেজের অধ্যাপক পদে নিযুক্ত হন। ৬৯’এর গণঅভ্যুত্থানে ময়মনসিংহের রাজপথে আলমগীর মনসুর মিন্টু শহীদ হবার পর তার স্মৃতিকে ধরে রাখতে ওই বছরই প্রতিষ্ঠিত হয় আলমগীর মনসুর মিন্টু মেমোরিয়াল কলেজ। ওই সময় কলেজটির অধ্যক্ষের দায়িত্ব নেন মতিউর রহমান। ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত কলেজটি থেকে কোনো বেতন-ভাতা না নিয়ে অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করে তিনি বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন।
নিউজ /এমএসএম