সোমবার, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০৬:০৬ পূর্বাহ্ন

ওয়েলসের সোয়ানসিতে

বিপুল উৎসাহ আনন্দ উল্লাসে ’সোয়ানসী মেলা’ অনুষ্ঠিত

দেওয়ান ফয়ছল
  • খবর আপডেট সময় : বৃহস্পতিবার, ২৪ আগস্ট, ২০২৩
  • ৩৫৪ এই পর্যন্ত দেখেছেন

আনন্দ উল্লাসে ’সোয়ানসী মেলা’ পরিণত হয় মিলন মেলায় সাউথ ওয়েলসের একটি প্রচীনতম শহর সোয়ানসী। বাংলাদেশীদের অনেক ইতিহাস বিজড়িত, স্মৃতিবিজড়িত শহর এই সোয়ানসী। যারা প্রথম বাংলাদেশ (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) থেকে ওয়েলসের এই সোয়ানসী এসেছিলেন তাঁদের অনেকেই চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন এই শহরে।

আজ তাদের বংশধরেরাই লেখাপড়া, ব্যবসা বাণিজ্য, চাকুরী থেকে শরু করে বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠন গড়ে তুলে মাতিয়ে রেখেছেন সোয়ানসী সহ তার আশেপাশের শহর পোর্ট টালবট, নীথ, ব্রিজেন্ড কার্ডিফ সহ অন্যান্য এলাকাগুলোকে।

কয়েক বছর পূর্বে এসব এলাকার মৌলভী বাজারের উৎসাহী ব্যবসায়ী, চাকুরীজীবি মিলে গড়ে তুলেন ”মৌলভী বাজার ডিস্ট্রিক্ট এসোসিয়েশন-মিড এন্ড ওয়েষ্ট গ্লামারগন” নামে একটি সামাজিক, সাংস্কতিক সংগঠন। এই সংগঠনের উদ্দেশ্য হচ্ছে, আমাদের বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ছেলে মেয়েদের আমাদের দেশের কৃষ্টি এবং সংস্কৃতিকে তাদের সামনের তুলে ধরা, যাতে তারা বিদেশী কৃষ্টি এবং সংস্কতির প্রতি আকৃষ্ট না হয়ে বরং আমাদের কৃষ্টি ও সংস্কৃতিকে বুঝতে পারে এবং ধরে রাখতে পারে।

সে লক্ষ্যেই রোববার (২০ আগষ্ট) ’২০২৩ সোয়ানসী শহরের প্রাণকেন্দ্র ’সেন্ট হেলেন ক্রিকেট গ্রাউন্ডে, সোযানসী’ তে প্রধমবারের মতো একটি ’সামার মেলার অনুষ্ঠিত হয়। এই মেলা’টি হাজারো মানুষের উপস্থিতিতে আনন্দ উল্লাসে পারিণত এক পারিবারিক মিলন মেলায়। বাঙালী জাতির সংস্কৃতিকে আমাদের বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে তুলে ধরে তাদেরকে জানান দেয়ার লক্ষ্য নিয়েই অনুষ্ঠিত হলো এই মেলা।

ওয়েলসের আবহাওয়া বড়ই বৈচিত্রময়। এখানে বেশ কয়েক বছর থাকার পরও এখানকার আবহাওয়া কখন যে কেমন হয় বুঝে উঠতে পারিনি। গত কয়েক দিন ধরেই কখনও অবিরাম বর্ষণ, আবার কখনও থেমে থেমে বৃষ্টি আবার মাঝে মধ্যে যেন রোদের একটু মুচকি হাসি দেখা যায়। মোবাইলে আবহাওয়ার অবস্থা জানতে গিয়েও তার মিল পাওয়া যায় না।

কোন সময় দেখায় সারা দিন বৃষ্টি অথচ কিছুক্ষণ পরই দেখা যায় রৌদ্রোজ্বল দিন। যাই হোক, এসোসিয়েশনের আয়োকরা কয়েক মাস আগেই এই ক্রিকেট মাট’টি বুকিং দিয়ে রেখেছিলেন। সুতরাং বৃষ্টি হোক আর রোদ হোক মেলাতো করতেই হবে। তবে আল্লাহর মেহেরবানীতে ২০ আগষ্ট রোববার ছিলো ঝলমলে রৌদ্রোজ্বল দিন। রৌদ্রোজ্বল দিনটি দেখে সবারই মনে আনন্দের বন্যা বয়ে গেলো। সকালে ঘুম থেকে উঠেই নাস্তা করে ১০টার মধ্যেই ঘর থেকে সবাই বেড়িয়ে চলে গেলেন মাঠে।

যার যা দায়িত্ব ছিলো তা পালন করতে। কার্য্যকরী কমিটির সকল সদস্যদের প্রচেষ্টায়ই অনুষ্ঠিত হলো এই মেলা। সবাই মিলে রাতদিন ভীষণ পরিশ্রম করেছেন তারা। এই মেলা অনুষ্ঠানের মূল দ্বায়িত্বে ছিলেন এসোসিয়েশনের সভাপতি আব্দুল কাদির। আব্দুল কাদিরের সাথে যিনি ভীষণ পরিশ্রম করেছেন তিনি হচ্ছেন মোহাম্মদ আমিন শাহ (আঙ্গুর)।

এছাড়াও কার্য্যকরী কমিটির অন্যান্য সবাইকে মেলার দিনে বিভিন্ন দায়িত্ব অর্পন করা হয়। যার ফলে যদিও প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠিত হলো এই মেলা কিন্তু বাস্তবে দেখা গেলো মেলার শুরু থেকে শেষ পর্য্যন্ত এতো নিখুত ভাবে তাদের দায়িত্ব পালন করেছেন যার ফলে শতভাগ সফল হয়েছেন তারা।

আমার অনেক মেলাতেই যাওয়ার সুযোগ হয়েছে, সেখানে দেখেছি কোন না কোন একটা ঝামেলা হয়ে যায়। কিন্তু সোয়ানসী মেলাতে গিয়ে আমি অবাক হয়ে ভেবেছি, কি ভাবে এতো নিখুঁত ভাবে তা করা সম্ভব হলো। আমার মতে, তার প্রধান কারণ হচ্ছে, তাদের মধ্যে আন্তরিকতা, সমঝোতা এবং এই মেলাকে যে ভাবেই হোক কৃতকার্য্য করতে হবে এই মনোভাব নিয়ে সবাই কাজ করেছেন। তাদের মনোভাবই ছিলো ’ডু অর ডাই’। এটা প্রতিজ্ঞাই হচ্ছে মেলাকে সফল করার মূল মন্ত্র।

এসোসিয়েশনের সবার সাথেই আমার গত কয়েক বছরে ঘনিষ্ঠতা জমে ওঠেছে, কাজেই মেলায়তো যেতেই হবে। সকালে ঘুম থেকে ওঠে রৌদ্রোজ্বল দিনটি দেখে নিজেকে আর সামলাতে পারলাম না। সকাল সাড়ে ১১টার ট্রেন ধরে ব্রিজেন্ড থেকে রওয়ানা দিয়ে সোয়ানসী গিয়ে পৌছলাম ১২টায়। স্টেশন থেকে নেমে হেঁটে হেঁটে চলে যাচ্ছি মেলার গন্তব্য স্থলে।

পথিমধ্যে পরে ’আনারকলি রেষ্টুরেন্ট’। যখন অতিক্রম করে যাচ্ছি এমন সময় রেষ্টুরেন্টে স্বত্বাধিকারী আমার খুবই প্রিয় মানুষ, উক্ত এসোসিয়েশনের একজন উপদেষ্ঠা পরিষদের সদস্য খালিক সাহেব দরজার বাইরে এসে পেছন থেকে ডাক দিলেন দেওয়ান সাহেব কোথায় যাচ্ছেন? ভাবলাম ফাঁকি দেয়া আর হলো নাতো ফিরে গিয়ে রেষ্টুরেন্টে ঢুকলাম, কিছুক্ষণ আলাপ করে এক বোতল কোক পান করে বললাম, আর সময় নষ্ট করতে চাইনা এবার চলি। হেসে হেসে বললেন, ওকে যান, আমিও আসছি একটু পর।

অনুষ্ঠানের কর্মসূচীর মধ্যে ছিলো উদ্বোধনী অনুষ্ঠান, সঙ্গীতানুষ্ঠান, রাফেল ড্র, ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের খেলার জায়গা সহ ’ফাইভ এ সাইড টুর্নামেন্ট’ তরুণদের জন্য আকর্ষণীয় ফুটবল প্রতিযোগিতা। সকাল ১১টায় সোয়ানসীর লর্ড মেয়র মি: গ্রাহাম থমাসের বাংলাদেশ এবং ওয়েলসের জাতীয় পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে মেলার কার্যক্রম আনুষ্ঠানিক ভাবে শুরু হয়। মাঠের মধ্যে যখন ঢুকলাম তখন ১টা বাজে। লোকজন আসতে শুরু করেছে।

সেখানে বন্ধুবান্ধবদের সাথে অনেক্ষণ হাঁটাহাটি করলাম, সবকিছু দেখলাম। মেলায় আগত মানুষের নিরাপত্তার জন্য পুলিশের গাড়ি, এম্বুলেন্স মাঠের পাশে পার্ক করা। আরও চোখে পড়লো বাউনছার, এদেরকে রাখা হয় সাধারণত: কোন প্রকার অপ্রীতিকর ঘটন্রা সৃষ্টি হলে তা সামাল দেয়ার জন্য। সংক্ষেপে বলা যায়, মেলাকে সফল করে তুলতে যা যা করণীয় তার সবই করতে তারা ত্রুটি করেননি।

মাঠে ঢুকার পর পরই দেখলাম মাঠের মধ্যখানে ফুটবল খেলা চলছে। লোকজন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খেলা উপভোগ করছে। মাঠের এক পাশে লাইন করে তৈরী করা হয়েছে স্টল। এই স্টলগুলোর অধিকাংশই ছিলো বিভিন্ন ধরণের খাবারের। বিরিয়ানী, সমসা, ডালপুরি, চানাচুর, চটপটি, চা-কফি, ড্রিংকস সহ শাড়ী কাপড়, পাজামা-পাঞ্জাবী, ছোট বাচ্চাদের কাপড়, টাট্টু ওয়ালী সহ বিভিন্ন ধরণের মালামাল দিয়ে সাজানো প্রতিটি স্টল। বিশেষ করে খাবারের স্টলগুলোতে ছিলো মানুষের লাইন।

মজার কথা হল, কার্ডিফ থেকে আসা বন্ধুদের সাথে গিয়ে যখন আমরা কেউ চানাচুর, কেউ চটপটি, ড্রিঙ্ক কিনে টাকা পে করার পর আমাদের হাতে মহিলাটি হেসে হেসে একটি কাগজ হাতে দিয়ে বললো, ভাইয়া এই আপনার টিকেট নং ৪১। আপনারা কিছুক্ষণ পর আসেন। আমরা সবাই এই টিকেট দেখে খুব আনন্দ করলাম। প্রায় ১৫ মিনিট পর স্টলে গিয়ে টিকেট দিলে বললো আপনাদের আগে আরও ২ জন আছে, একটু দাঁড়ান। যারা স্টল দিয়েছেন তারা সবাই ভালো ব্যবসা করেছেন।

সোয়ানসী এসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে তারা ফুটবল গ্রাউন্ডের ক্যান্টিন ভাড়া নিয়েছিলেন। সেখানে ছিলো বিরিয়ানী, ছমছা সহ অন্যান্য  স্ন্যাক ও চা কফির ব্যবস্থা। তারাও ভালো ব্যবসা করেছেন। শুধু স্টলই নয়, সেখানে ছিলো ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের জন্য বিভিন্ন ধরণের খেলার আয়োজনও। তাদের পছন্দ মতো এসব খেলাতে অংশ গ্রহণ করে তারা যে আনন্দ উপভোগ করছে,তা দেখে মনে হয়েছে, তারা যেন ঘরের মধ্যে বন্দী জীবন থেকে বেরিয়ে এসে আজ খোলা আকাশের নীচে এই মেলায় তাদের আনন্দটা উজাড় করে দিচ্ছে। এ কারণেই এ ধরণের আয়োজন মাধ্যে করা দরকার।

রাফেল ড্র’র টিকেট বিক্রির দায়িত্বে ছিলেন ছমছু মিয়া। তিনি ২ জন ভলান্টিয়ারের মাধ্যমে টিকেটগুলো বিক্রির ব্যবস্থা করেন। তারা মাঠের মধ্যে ঘুরে ঘুরে আগত অতিথিদের কাছে টিকেট বিক্রি করে। এরপর অনুষ্ঠিত হয় রাফেল ড্র। রাফেল ড্র’তে বিজয়ীরা হলেন ১ম পুস্কার একজন সুদানের অধিবাসী, ২য় পুরস্কার সুহেল আহমদ এবং ৩য় পুরস্কার মোহাম্মদ আমিন আলী শাহ (আঙ্গুর)।

ফুটবল থেলা পরিচালনা করেন মোহাম্মদ আমিন শাহ (আঙ্গুর)। উক্ত খেলায় সোয়ানসী, কার্ডিফ, ব্রিজেন্ড, নীথ এবং পোর্ট টালবট থেকে মোট ১৬টি টীম অংশ গ্রহণ করে। খেলার শেষ পর্যায়ে এসেস বনাম মাডনি এফসি এই দু’টিমের মধ্যে ফাইনাল অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত ফাইনালে কার্ডিফ এর মাডনি এফসি ২-০ গোলে সোয়ানসীর এসেস’কে হারিয়ে বিজয়ী হয়।

বিজয়ীদের মধ্যে পুরস্কার বিতরণ করেন সোয়ানসীর লর্ড মেয়র গ্রাহাম থমাস, মৌলভী বাজার এসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট আব্দুল কাদির, মোহাম্মদ আমিন শাহ-স্পোর্ট অফিসার-মৌলভী বাজার এসোসিয়েশন, আনসার মিয়া জয়েন্ট ট্রেজারার ও আব্দুল কাইয়ুম সেক্রেটারী।

এছাড়াও লন্ডন থেকে আগত বিশিষ্ট শিল্পীদের কন্ঠে পরিবেশিত হয় বিভিন্ন ধরণের মনমাতানো নাচ, গানের অনুষ্ঠান। নাচ আর গানের তালে তালে দর্শকদের মধ্য থেকে পুরুষ, মহিলারা তাদের সাথে তাল মিলিয়ে শুরু করেন নাচ আর গান। এই দৃশ্যটি ছিলো অপূর্ব, দেখার মতো। দর্শকদের এই আনন্দ দেখে মনে মনে ভাবছিলাম, আর যাই হোক অন্তত এই মেলাতে এসে তারা তাদের মনের আনন্দটা সবার সাথে ভাগ করে হাসি মুখেই ঘরে ফিরছেন। বিকাল ২টার পর থেকে নাচ আর গানের অনুষ্ঠান শুরু হয়ে চলতে থাকে মেলা শেষ হওযা পর্যন্ত।

”মৌলভী বাজার ডিস্ট্রিক্ট এসোসিয়েশন-মিড এন্ড ওয়েষ্ট গ্লামারগণ” এর উদ্যোগে সোয়ানসী শহরে প্রথমবারের মতো এই মেলার আয়োজন এবং সুশৃঙ্খল ভাবে পরিচালনা করে যে সফলতা দেখিয়েছেন, সে জন্য আমি তাদের সবাইকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আমি মনে করি, কার্যকরী পরিষদের সদস্যরা যারা ভীষণ পরিশ্রম করে ’সোয়ানসী মেলা’কে সফল করে তুলেছেন, এই কৃতিত্বটি তাদেরই।

দয়া করে খবরটি শেয়ার করুন

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

এই ক্যাটাগরিতে আরো যেসব খবর রয়েছে
All rights reserved © UKBDTV.COM
       
themesba-lates1749691102