ফিনল্যান্ডের সাবেক প্রধানমন্ত্রী সানা মারিন। ২০১৯ সালে মাত্র ৩৪ বছর বয়সে বিশ্বের সবচেয়ে কমবয়সী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেশটির দায়িত্ব নেন। ২০২৩ সালের এপ্রিলে সাধারণ নির্বাচনে হেরে যাওয়ার পরপরই পদত্যাগের ঘোষণা দেন, তবে ২০ জুন পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। এর আগে ১৭ মে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটিতে সমাবর্তন বক্তা হিসেবে অনুপ্রেরণামূলক এই ভাষণ দেন। নির্বাচিত অংশের অনুবাদ করেছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষার্থী রওশন আরা অমি
সানা মারিন,
সুপ্রিয় সদ্য স্নাতক বন্ধুরা, আজকের এই শুভদিনে, এই বিশেষ দিনে তোমাদের কী যে বলব, ভেবে কূল পাই না। আজ তোমাদের স্নাতক হওয়ার দিন। এই দিনে তোমরা জীবনের একটি অধ্যায় শেষ করলে। এবং একই সঙ্গে জীবনের নবতর এক অধ্যায় শুরু করলে। এ দিন আসলে বাঁকবদলের দিন, পরিবর্তনের দিন।
তাই ভাবলাম, এই দিনে তোমাদের সঙ্গে পরিবর্তন নিয়ে কথা বলার সুবর্ণ সুযোগ। আমার নিজস্ব অভিজ্ঞতার আলোকেই কথাগুলো বলছি আমি।
মাত্র ৩৪ বছর বয়সে আমি বিশ্বের সবচেয়ে কম বয়সী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে [ফিনল্যান্ডের] নেতৃত্বভার নিয়েছিলাম। এর পর থেকে প্রায়ই আমাকে দুটো প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়। দুটোই পরিবর্তন প্রসঙ্গে।
প্রথম প্রশ্নটা হলো : আপনি কি ছোট থেকেই প্রধানমন্ত্রী হতে চেয়েছিলেন? আর দ্বিতীয় প্রশ্নটা হলো : আপনি কীভাবে প্রধানমন্ত্রী হলেন?
আমার উত্তরগুলো তোমাদের সঙ্গে ভাগ করে নিচ্ছি, যেন ভবিষ্যতে একইরূপ প্রশ্নের মুখে পড়লে তোমরা নিজেদের মতো জবাব দিতে পার।
প্রথম প্রশ্নটায় আমার উত্তর হলো : না। শৈশবে আমি রাজনীতিক বা প্রধানমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্ন দেখিনি।
দ্বিতীয় প্রশ্নটায় আমার উত্তর হলো : আমি শেষপর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী হয়েছি, কারণ আমি অনেক কিছুই বদলে দিতে চেয়েছিলাম, আমি এই বিশ্ব টাকে বদলে দিতে চেয়েছিলাম। আমার মনে হয়েছিল, পরিবর্তনের দায়িত্ব আমারই, এই ভার অন্য কারও ওপর ছেড়ে দেওয়া ঠিক নয়।
জানি, তোমরা জীবনে অনেক লেকচার শুনেছ। না হলে কি আর কেউ স্নাতক হতে পারে নাকি! তা-ও আবার এমন বিশেষ প্রতিষ্ঠান থেকে। তবু আমার মনে হয়, আরও কিছু অন্তর্দৃষ্টি নিয়ে তোমাদের সঙ্গে আমি কথা বলতে পারি। আর এই কারণেই পরিবর্তন বিষয়ে তোমাদের তিনটি পরামর্শ দিতে চাই।
প্রথম পরামর্শ : কোনো কিছু চাওয়ার অধিকার তোমাদের আছে এবং কোনো কিছু পরিবর্তন করবার ইচ্ছার অধিকারও তোমাদের আছে।
দ্বিতীয় পরামর্শ : শুধু চাওয়াই যথেষ্ঠ নয়। কোনো কিছু বদলাতে হলে, তোমাদের দায়িত্ব নিতে হবে।
তৃতীয় পরামর্শ : ভয় পেলে চলবে না। ভয় পাওয়া বন্ধ করতে হবে।
আমার প্রথম পরামর্শটা কোনো কিছু পরিবর্তনের ইচ্ছা নিয়ে। আমার বয়স যখন ঠিক তোমাদের মতো, তখন রাজনীতি নিয়ে আমার আগ্রহ বেড়ে যায়। সিদ্ধান্তগ্রহণ-ব্যবস্থা নিয়ে তখন ভাবিনি, কিংবা ভাবিনি যে একজন নির্বাচিত প্রতিনিধি হব। বরং আমি কিছু বিষয় নিয়ে ভাবতে শুরু করি। যেমন জলবায়ু পরিবর্তন, জীববৈচিত্র্য ধ্বংস, মানবাধিকার ও সংখ্যালঘুর অধিকার, লৈঙ্গিক সমতা ও সামাজিক ন্যায়বিচার। মানে, আমার চারপাশের যা কিছু তা আমি পরিবর্তন করতে চেয়েছিলাম। আমার মনে হয়, তোমাদের অনেকেই এরকম ভাবনা এখন ভাবছ। দেখো, আমি একটি ‘রামধনু পরিবার’ (বাবা বিবাহবিচ্ছেদ ঘটালে মা এক নারী সঙ্গীকে নিয়ে জীবনযাপন করেছেন) থেকে উঠে এসেছি। আমি এমন এক সমাজের স্বপ্ন দেখতাম, যেখানে প্রত্যেকে তার পছন্দসই মানুষের সঙ্গে প্রেম করতে পারে। বিবাহ ও অন্যান্য মানবাধিকার প্রশ্নে সব জেন্ডারই সমান অধিকার পাবে এমনভাবে আইন-শাসনের সমাজ দেখতে চেয়েছিলাম। নর-নারীর মজুরি-বৈষম্য দূর করতে চেয়েছিলাম। এমন পরিবারব্যবস্থা দেখতে চেয়েছিলাম, যেখানে মা-বাবারা তাদের সন্তানদের প্রতি সমান ভালোবাসা দেখাবেন, যেন মেয়েরা ছেলেদের মতোই পেশাজীবন নিয়ে উচ্চাশা করতে পারে। সবাই সমান অধিকার ও সুযোগ পাবে এমন সমাজের স্বপ্ন দেখেছিলাম। শিক্ষাব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে চেয়েছিলাম, যেন সব শিশুই তাদের স্বপ্নপূরণের জন্য শিক্ষা নিতে পারে। এসব কিছু পরিবর্তন চেয়েছিলাম বলেই আমি রাজনৈতিক দলে যোগ দিয়েছিলাম, নির্বাচনে দাঁড়িয়েছিলাম। ইচ্ছা ছাড়া কোনো পরিবর্তনই ঘটতে পারে না। এই কারণেই তোমাদের প্রতি আমার প্রথম পরার্মশ : তোমরা যে কোনো কিছুই চাইতে পার এবং ভালোর জন্য যে কোনো কিছুই পরিবর্তন করতে চাইতে পার।
আমার দ্বিতীয় পরামর্শ হলো : নেতৃত্বের ভার নিজেদের কাঁধে তুলে নিতে হবে। পৃথিবীটা আজ বড্ড বেশি জটিল। ভূরাজনৈতিক পালাবদল চলছে, আমাদের আদর্শ প্রশ্নের মুখে পড়ছে। জলবায়ু পরিবর্তন ও জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হচ্ছে। এতে আমাদের অস্তিত্ব হুমকির মুখে। ডিজিটাইজেশন ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিকাশ আমাদের সমাজে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটাতে যাচ্ছে। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে পারতে হবে। আর এটা করার জন্য তোমাদেরই দায়িত্ব নিতে হবে, অন্য কারও ওপর ভার ছেড়ে দিলে চলবে না। এসব সংকট আমাদের আদর্শকে রক্ষার লড়াই। আমাদের অবশ্যই একটা পক্ষ নিতে হবে। তফাতে চলে মধ্যম হওয়ার মধ্য দিয়ে মহৎ হওয়ার কোনো জো নেই। প্রিয় স্নাতক বন্ধুরা, বর্তমান ও ভবিষ্যৎকে জানো। এর পর পরিবর্তনের কাজে নেমে পড়। তবে খেয়াল রাখবে, পরিবর্তন যেন ভালোর পক্ষে, ন্যায়ের পক্ষে হয় এবং জানো কি? তোমরা চাইলেই তা পার। তোমরা যদি বিশ^াস কর যে, সমাজ ব্যবস্থা ও পুরো বিশ^কে খোলনলচে বদলে ফেলতে হবে, আরও গণতান্ত্রিক করতে হবে পৃথিবীকে, জেন্ডার ও জাতিগত সমতা আরও নিশ্চিত করতে হবে, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সুনিশ্চিত করতে হবেÑ তা হলে তোমরা এসবই বাস্তবায়ন করতে পার।
কীভাবে পরিবর্তন আনবে, আমার তৃতীয় পরামর্শটা তা নিয়েই। আমি যখন আমার কৈশোর ও পেশাজীবনের দিকে ফিরে তাকাই, তখন বুঝতে পারি, একটা জিনিস মানুষকে পিছে টেনে ধরে। তা হলো : ভয়। কোনো কিছু সম্পর্কে যথাযথ ও পর্যাপ্ত না জানা থাকলে মনে ভয় থাকে। বিব্রত হওয়ার ভয়, ভুলের ভয় নানাবিধ ভয় ভিড় করে থাকে আমাদের মনে। আমি কি যোগ্য, আমি কি অন্যদের প্রত্যাশার মতো এমন নানা ভয়, নানা সংশয় মেঘের মতো মনে জমে থাকে। মুখের চেহারা ও মুখের ভাষা দুই নিয়ে হীনমন্যতা থেকেও ভয় হয়। তবে মনে রাখবে, তুমি যদি তোমার মতো থাকতে চাও, তোমার মনের মতো হতে চাও, কোনো কিছু যদি পরিবর্তন করেত মনে বাঞ্ছা কর, তা হলে তোমার ওপর মোড়লি করার মতো বিশ্বে আর কোনো আধিকারিক নেই। আমার ইচ্ছাগুলো পূরণ করার জন্য আমি যদি কারও অনুমতির অপেক্ষা করতাম, নিশ্চিত থাকো, আজও আমাকে অপেক্ষাই করতে হতো। এজন্য আমার এই পরামর্শটাই প্রধান : ভয় পাওয়া বাদ দাও, ভয় পাওয়া ভুলে যাও।
প্রিয় বন্ধুরা, অনুষ্ঠান শেষে এই স্টেডিয়াম থেকে তোমরা যখন চলে যাবে, তখন আমি চাই কথা তিনটি মনে রাখো : এক. তোমাদের মনে সমাজ পরিবর্তনের ইচ্ছা থাকতে হবে, দুই. পরিবর্তনের দায়িত্ব তোমাদেরই নিতে হবে; তিন. সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ : ভয় পেয়ো না। পরিবর্তনের জন্য তোমরা যোগ্য। তোমরাই যথেষ্ট।
সবাইকে নিয়ে তোমরা সব কিছুই করতে পার। তোমাদেরই সব করতে হবে। মনে রেখো, তোমরা ছাড়া আর কেউ সমাজ পরিবর্তন করতে পারবে না।
নিউজ /এমএসএম