‘আজি ঝরো ঝরো মুখর বাদরদিনে, জানি নে জানি নে কিছুতে কেন যে মন লাগে না…’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জনপ্রিয় এ গানটি মন উচাটন করে তোলে, বিরহী করে তোলে। প্রিয়জনের সান্নিধ্য পেতে মরিয়া হয়ে ওঠে। প্রণয় নিবেদনের দিন আজ। পঞ্জিকার হিসাবে পহেলা আষাঢ়। মানে বর্ষা ঋতুর প্রথম দিন। চার দিকে কদমের ফুটন্ত সৌন্দর্য বর্ষার আগমনী বার্তা বয়ে আনছে। কদম ফুলকে বলা হয়ে থাকে বর্ষার বিশ্বস্ত দূত। কাঠফাটা রোদে মানুষের হাঁসফাঁস করা গরমে অঝোর ধারায় বৃষ্টি-বর্ষণের জন্য প্রতীক্ষা বাসা বাঁধছে।
বর্ষা বাঙালির প্রেম, কৃষ্টি, আনন্দ, বেদনা, উৎসব, ব্যবসা-বাণিজ্য, সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে জাগিয়ে তুলে। এ ঋতুর রূপ-ঐশ্বর্যে মুগ্ধ হয়ে অনেক কবি বাংলা সাহিত্যকে ঋদ্ধ করেছেন। বর্ষা ঋতু তার বৈশিষ্ট্যের কারণেই স্বতন্ত্র।
ষড়ঋতুর এ দেশে বর্ষা অনন্য, তার রূপের সৌন্দর্যে। প্রকৃতি সাজে নবযৌবনের রূপে। পুষ্পে-বৃক্ষ, পত্রপলস্নবে পায় নতুন প্রাণের সুর। চারদিকে যেন নব উচ্ছ্বাসের জোয়ার জাগে। ‘বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর নদে এলো বান, শিব ঠাকুরের বিয়ে হবে তিন কন্যা দান’। বর্ষা নিয়ে কাব্যের অভাব নেই বাংলা সাহিত্যে। বাঙালি মননে সবচেয়ে বেশি রোমান্টিকতা-আধ্যাত্মিকতার সুর বাজে বর্ষায়। সাহিত্যজুড়ে তারই প্রমাণ মিলে।
বর্ষার আগমনের শুরু থেকে মূষলধারে ঝরে বৃষ্টি। বর্ষার নবধারা জলের সঙ্গে সঙ্গে নেচে ওঠে প্রকৃতি। নতুন প্রাণের আনন্দে অঙ্কুরিত হয় গাছপালা, ফসলের মাঠ। মাঠে মাঠে কৃষকের মুখে ফুটে ওঠে হাসি। বৃষ্টির রিমঝিম ধ্বনিতে পেখম মেলে ময়ূর।
নদী-নালা, খাল-বিল ফিরে পায় প্রাণের ছোঁয়া। মৃত খাল-বিলগুলোও যেন বেঁচে থাকার স্পদনে জেগে ওঠে। গ্রামের মাঠঘাটগুলো বর্ষার ছোঁয়ায় জল থই থই করে। নতুন পানিতে মাছ ধরার ধুম পড়ে, বর্ষার অফুরন্ত জলে কৃষক আমনের ধান বুনতে বুনতে নতুন দিনের স্বপ্ন দেখেন। আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে বজ্রপাত শুরু হলে মাছ, ব্যাঙ ও সরীসৃপ প্রাণীদের প্রজনন শুরু হয়। দেশের প্রধান তিনটি নদী পদ্মা, মেঘনা ও ব্রহ্মপুত্রের শাখা নদীগুলোতে মা-মাছ এসে ডিম পাড়ে। এ সময় পাট জাগ দিতে প্রয়োজন হয় পানির।
গাছে গাছে ফুটেছে কদম । ছবি: সংগৃহীত
মেঘদূত কাব্যে বহুকাল আগে কালিদাস মুগ্ধ হয়েছিলেন আষাঢ়ের রূপে। আষাঢ় শব্দে আছে স্বপ্নাবিষ্ট এক মোহমুগ্ধতা। গানে-কবিতায় বাংলার কবিরা করেছেন বর্ষা-বন্দনা। বর্ষার প্রবল বর্ষণে নির্জনে ভালোবাসার সাধ জাগে, চিত্তচাঞ্চল্য বেড়ে যায়। শত ঘটনার ভিড়েও কোথায় যেন মেলে এক চিলতে বিশুদ্ধ সুখ। আষাঢ়েই শোনা যায় রিমঝিম বৃষ্টির ছন্দ।
বৃহস্পতিবার (১৫ জুন) ভোর থেকে দেশের আকাশ ছিল কালো মেঘে ঢাকা। আবহাওয়ার অফিস বলছে, দেশের ১০ জেলার ওপর দিয়ে দুপুরের মধ্যে ৪৫-৬০ কিলোমিটার বেগে ঝড় আঘাত হানতে পারে। এসব এলাকার নদীবন্দরগুলোকে ১ নম্বর সতর্ক সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে। একই সঙ্গে দেশের কোথাও কোথাও মাঝারি ধরনের ভারি থেকে ভারি বৃষ্টি হতে পারে বলেও বলা হয়েছে পূর্বাভাসে।
বর্ষাকে নিয়ে নানা মিথ রয়েছে, বিশেষ করে দেশের নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে। কক্সবাজারের রাখাইন সম্প্রদায় বর্ষাকে বরণ করে ভিন্ন রকমভাবে। প্রতিবছর তারা কক্সবাজারে সমুদ্র সৈকতে মাসব্যাপী বর্ষাবরণ উৎসবের আয়োজন করে থাকে। দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে রাখাইন সম্প্রদায়ের লোকেরা এ বর্ষাবরণ উৎসবে যোগ দেন।
রবি ঠাকুরের ভাষায়— ‘আবার এসেছে আষাঢ় আকাশ ছেয়ে/ আসে বৃষ্টির সুবাস বাতাস বেয়ে। এই পুরাতন হৃদয় আমার আজি/ পুলকে দুলিয়া উঠিছে আবার বাজি/ নূতন মেঘের ঘনিমার পানে চেয়ে/ আবার এসেছে আষাঢ় আকাশ ছেয়ে। রহিয়া রহিয়া বিপুল মাঠের ‘পরে/ রহিয়া রহিয়া বিপুল মাঠের ‘পরে/ নব তৃণদলে বাদলের ছায়া পড়ে। এসেছে এসেছে এই কথা বলে প্রাণ/ এসেছে এসেছে উঠিতেছে এই গান/ নয়নে এসেছে, হৃদয়ে এসেছে ধেয়ে। আবার আষাঢ় এসেছে আকাশ ছেয়ে।
নিউজ /এমএসএম