রবিবার, ০৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ০২:৪৭ পূর্বাহ্ন

দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থায় অনাস্থা: চিকিৎসকদের ইমেজ সংকট

সেবিকা দেবনাথ
  • খবর আপডেট সময় : শুক্রবার, ২৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩
  • ১৫৭ এই পর্যন্ত দেখেছেন

অপারেশন টেবিলে রোগীকে রেখে পালালেন ডাক্তার-নার্স; ডাক্তার নেই, সুইপার করলেন অস্ত্রোপচার; ভুল চিকিৎসায় রোগীর মৃত্যু; পেটে সুই ও গজ-ব্যাণ্ডেজ রেখেই সেলাই; কিংবা ভুয়া প্রতিষ্ঠানে ভুয়া চিকিৎসক আটক- এমন শিরোনাম হরহামেশাই গণমাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছে। যা থেকে দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা সম্পর্কে সাধারণ মানুষের উদ্বেগের চিত্রই ফুটে ওঠে।

দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা এবং চিকিৎসক ও নার্সদের আচরণ নিয়ে রোগীদের অভিযোগ দীর্ঘদিনের। বিভিন্ন সময় মন্ত্রী, এমপিরাও এ বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। একই ইস্যুতে সংসদও অনেক সময় উত্তপ্ত হয়। কিন্তু সমস্যা থেকে উত্তরণ হচ্ছে না। একের পর এক হাসপাতাল গড়ে উঠছে। কিন্তু সেখানে পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসার ব্যবস্থা নেই। বেসরকারি ক্লিনিক ও হাসপাতালে চিকিৎসা নেয়ার কথা দেশের দরিদ্র ও নি¤œ মধ্যবিত্ত মানুষের কাছে স্বপ্নের মতো। একদিকে গরিব মানুষ দেশেই পয়সার অভাবে চিকিৎসা করতে পারছে না; অন্যদিকে ধনীরা দলে দলে চিকিৎসা নেয়ার জন্য হরহামেশাই যাচ্ছেন বিদেশে। সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড ও ভারতের বিভিন্ন হাসপাতালের অসংখ্য তথ্যকেন্দ্র ঢাকাসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন শহরে স্থাপন এই ইঙ্গিত দেয়- আসলে আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থারই চিকিৎসা দরকার।

স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ২০২২-২৩ স্বাস্থ্য খাতে বাজেট বরাদ্দ ৩৬ হাজার ৮৬৩ কোটি টাকা, যা গত বছরের তুলনায় মাত্র ৪ হাজার ১৩২ কোটি টাকা বেশি। নতুন বরাদ্দের মাধ্যমে স্বাস্থ্য খাতে মোট বাজেটের ৫ দশমিক ৪ শতাংশ পাওয়া গেছে, যা গত বছরের বাজেটে ছিল ৫ দশমিক ২ শতাংশ। প্রকৃতপক্ষে চাহিদা ও মুদ্রাস্ফীতির কথা বিবেচনায় নিলে বাজেট গত বছরের তুলনায় কম। আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী, স্বাস্থ্য খাতে মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির বরাদ্দ কমপক্ষে ৫ শতাংশ থাকা প্রয়োজন হলেও বাংলাদেশে তা শূন্য দশমিক ৯২ শতাংশ মাত্র। দেশে রোগীর সংখ্যা বেশি, চিকিৎসার সরঞ্জামাদি ও ওষুধপত্র সীমিত, ডাক্তারসহ অন্যান্য লোকবলও সীমিত। ফলে সত্যিকারের সেবাদান সম্ভব হচ্ছে না।

গত বছরের ২৬ নভেম্বর এক অনুষ্ঠানে সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী মো. আশরাফ আলী খান খসরু বলেছেন, বাংলাদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা উন্নত নয়। দেশের হাজার হাজার রোগী চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাড়ি জমায়। দেশের চিকিৎসকদের সমালোচনা করে আশরাফ আলী খান খসরু বলেন, আমাদের সমস্যা হচ্ছে- আমরা একজন রোগীর সঙ্গে সময় দিতে চাই না। কত তাড়াতাড়ি এই রোগীকে বিদায় করে আরো একজন রোগী দেখব, এই মানসিকতাই সবচেয়ে বড়। আমি অনেক দেশে দেখেছি, সে দেশে ডাক্তাররা রোগীর সঙ্গে অনেক সময় কাটান। একজন ডাক্তার যদি রোগীর সঙ্গে কথা বলেন, তাহলে রোগী মানসিকভাবে অনেক শক্তিশালী হয়। এতে রোগী খুব তাড়াতাড়ি ভালো হয়ে যায়।

এদিকে গত ১৯ ডিসেম্বর এক অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক জেলা-উপজেলার নার্সদের সেবার মান সন্তোষজনক নয় বলে মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেন, দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থায় অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। চিকিৎসাসেবায় নিয়োজিতরা যদি সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করেন, তাহলে সব সমস্যা ধীরে ধীরে সমাধান হবে। চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করতে হাসপাতালের পরিবেশ ও শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা সবচেয়ে বড় কাজ।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে অনেক উন্নয়ন হয়েছে। কিন্তু উন্নত বা বিশেষায়িত স্বাস্থ্যসেবায় এখনো তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি। এছাড়া বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের ঘাটতি, চিকিৎসকদের ইমেজ সংকট রোগীদের মধ্যে অনাস্থা তৈরি করছে। চিকিৎসকদের ‘ইমেজ বিল্ডিং’ এর জন্য, রোগী-চিকিৎসক সম্পর্ক উন্নয়নে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো তেমন কাজ করে না। এর প্রভাব চিকিৎসা ব্যবস্থায় পড়ছে।

বাংলাদেশে হৃদরোগ, ডায়াবেটিসের ক্ষেত্রে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। কিন্তু স্বাস্থ্যসেবা পেতে যে ব্যয় তা সাধারণ মানুষের পক্ষে বহন করা সম্ভব হয় না। সরকারি হাসপাতালেও সেবা মেলে না। এই আস্থার সংকট কেন- সে প্রসঙ্গে রোগী এবং স্বাস্থ্য অধিকার নিয়ে যারা কাজ করেন তারা বলছেন, দেশে চিকিৎসাসেবার ক্ষেত্রে বাণিজ্যিক মানসিকতাই বেশি। রোগ নির্ণয় ও সঠিক চিকিৎসায়ও কমতি আছে। এছাড়া যারা স্বাস্থ্যসেবা দেন তাদের বেশির ভাগেরই আচরণ আন্তরিক নয়। রোগীকে পর্যাপ্ত সময় ও মনোযোগ দেয়ার মানসিকতা অনুপস্থিত।

অনাস্থার কারণ সম্পর্কে ইমেরিটাস অধ্যাপক ও প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ বলেন, চিকিৎসকদের ওপর অবিশ্বাস, কিছু ভুল রিপোর্টের কারণে আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে। যেখানে আস্থার সংকট হয় সেখানে মানুষ যাবে না। প্রাইভেট মেডিকেল কলেজ অর্থের বিনিময়ে চিকিৎসক বানাচ্ছে, তাদের ওপর রোগীরা আস্থা রাখতে পারছে না। আর চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে মানুষের অভিযোগ- তারা মনোযোগ দিয়ে কথা শোনেন না, একগাদা ওষুধ লিখে দিয়ে কোম্পানির কাছ থেকে কমিশন নেন। অবকাঠামো, জনবল, সুযোগসুবিধা না বাড়ালে, ভালো চিকিৎসক তৈরি না হলে মানুষের আস্থা আসবে না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আবদুল হামিদ এ প্রসঙ্গে বলেন, রোগ নির্ণয়ে নির্ভুল পরীক্ষা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আমাদের দেশে ডায়াগনস্টিক টেস্টের মান ভালো না হওয়ায় অনেক সময় চিকিৎসক রোগ নির্ণয়ে ব্যর্থ হন। সঠিক রোগ নির্ণয় না হওয়ায় রোগীর চিকিৎসা দেয়া সম্ভব হয় না। রোগীর দুর্ভোগ বাড়তে থাকে। বাধ্য হয়েই রোগী বিকল্প পথে যায়।

জনস্বাস্থ্য বিশ্লেষক ও হেলথ এন্ড হোপ স্পেশালাইজড হাসপাতালের পরিচালক ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, আমাদের কাছের কয়েকটি দেশ (সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, ভারত) বাংলাদেশ থেকে রোগী সংগ্রহের জন্য নিবিড়ভাবে একধরনের মার্কেটিং পরিচালনা করে থাকে। সেই মার্কেটিং নেটওয়ার্কের সঙ্গে চিকিৎসক, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের লোকজন, দালাল শ্রেণির লোকজন ওতপ্রোতভাবে যুক্ত। বিদেশে চিকিৎসার বিষয়টি তারা মানুষের মনোজগতে প্রবেশ করিয়ে দেয়। তারা মানুষকে বোঝায়- বিদেশ গেলে সমান খরচে ভালো চিকিৎসা মিলবে। কিন্তু বাস্তবে তা হয় না। সূত্র: ভোরের কাগজ

নিউজ /এমএসএম

দয়া করে খবরটি শেয়ার করুন

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

এই ক্যাটাগরিতে আরো যেসব খবর রয়েছে
All rights reserved © UKBDTV.COM
       
themesba-lates1749691102