ঘটনাবহুল, তরঙ্গায়িত ও বিপ্লবমুখর জীবনের অধিকারী বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা) মানব ইতিহাসের সবচেয়ে বড়, সফল ও প্রভাবশালী মহামানব। বিশ্বের সবচেয়ে অধঃপতিত ও পশ্চাৎপদ সমাজ থেকে সবচেয়ে উন্নত সভ্যতার উন্মেষ ঘটানোর কৃতিত্ব দেখিয়েছেন তিনি।
মানবতার মুক্তি-দূত এবং মহান আল্লাহর সবচেয়ে বড় রহমতের প্রকাশ তথা বিশ্বজগতসমূহের জন্য রহমত হিসেবে প্রেরিত সর্বকালের সেরা এই মহামানব দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছিলেন ২৮শে সফর। এ উপলক্ষে সবাইকে জানাচ্ছি গভীর শোক ও সমবেদনা।
যার ছবি কখনও আঁকা যায় না
জগতে কতো ছবি আঁকা হলো
কত মনোহর উদ্যান আর ফুলে ফলে সুশোভিত ছবি দিলেন উপহার মহাপ্রভু!
এ জগতের সব রূপ-সজ্জা যেন তাঁর প্রিয়তমের তরে সাজানো হলো
কত পাখি কতো হিরণ্ময় তরুলতা স্বর্গীয় বুলবুল!
স্বর্গ ও মর্ত্যে ফুটে আছে কতই না চোখ-জুড়ানো ফুল
তারি মাঝে অপরূপ অতুল খোদার হাবিব মুহাম্মাদ রাসুল! (সা)
তাঁর প্রেমে কোনো আশিকের মন ভরে নাকো কভু!
মুহাম্মদি সৌরভের নেই কোনো তুলনা
পরম করুণাময়ের সেরা উপহার অনন্য করুণা
এনেছেনে ধরার বুকে তাঁরে অনন্যা নারী মা আমেনা।
মুহাম্মাদ নামের সব রহস্য কেউ কোনোদিন জানবে না!
যে পেয়েছে নবিজীর সুঘ্রাণ বা পরশপাথরের ঠিকানা
অন্য কিছুই আর তার কাছে কখনও ভালো লাগবে না!
দিবসকে করেছিল আঁধার তাঁকে হারানোর বেদনা!
মহতী মানবতা ও খোদায়ি সব গুণের তিনি প্রোজ্জ্বল আয়না!
শুয়ে আছেন যদিও তিনি পবিত্র মাদিনায়
তবুও তিনি চিরঞ্জীব ফাতিমার বেদনার্ত অশ্রুমালায়
উদ্দীপক তিনি প্রথম মুসলিম বিবি খাদিজার অনন্য ত্যাগের
উদ্দীপক তিনি মহাপ্রাণ আবু তালিবের অমর অপত্য স্নেহের!
নবীজি মিশে আছেন বীর হামজার প্রতিরক্ষায়!
নবীজি মিশে আছেন হাসানকে দেয়া বিষের পেয়ালায়
নবীজি চিরঞ্জীব আলীর জুলফিকারের অব্যর্থ আঘাত, অনুপম আনুগত্য ও শহীদী রক্তধারায়
নবীজি চিরঞ্জীব হুসাইনের শোক-সাগরের স্রোতধারায়
চিরঞ্জীব আহলে বাইত ও ইমামকুলের গুলবাগিচায়
চির-জাগ্রত তিনি বরেণ্য সাহাবিদের নীতি-নৈতিকতায়!
তিনি ছিলেন সব নবী-রাসুলের দাওয়াতি কাফেলার পুরোধায়!
তিনি ছিলেন ইব্রাহিম ও ইসমাইলের পূণ্যস্নাত পবিত্র বংশধারায়
তিনি আছেন ও থাকবেন চিরসত্য আর সৌন্দর্যের অপার মহিমায়!
সত্য ও মিথ্যার প্রভেদকারী পবিত্র কুরআনের গভীর অন্তরাত্মায়!
পাপী উম্মতের কাণ্ডারি ও শাফি হওয়ার খোদায়ি মহানুভবতায়!
২৮ সফর ইতিহাসের সবচেয়ে শোকাবহ দিন। কারণ দশম হিজরির এই দিনে দুনিয়া থেকে বিদায় নেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব ও মানবজাতির মুক্তির শ্রেষ্ঠ দিশারী বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা)। শুধু তাই নয় চল্লিশ বছর পর ৫০ হিজরির একই দিনে শাহাদত বরণ করেন মহানবীর প্রথম নাতি ও তাঁরই আদর্শের অন্যতম প্রধান সুরক্ষক হযরত ইমাম হাসান (আ)। চারিত্রিক মাধুর্য, নৈতিকতা, মানবীয় মূল্যবোধ, চিন্তাগত দূরদর্শিতা, রাজনৈতিক, আর্থ-সামাজিক, সাংস্কৃতিক, আধ্যাত্মিক ও নৈতিক ক্ষেত্রসহ জীবনের সবক্ষেত্রে বিশ্বজনীন এবং শ্রেষ্ঠ খোদায়ি আদর্শের সর্বোত্তম দৃষ্টান্ত ছিলেন মহানবী (সা)। তিনি ছিলেন শান্তি, সাম্য, ভ্রাতৃত্ব ও মানবীয় ঐক্যের শ্রেষ্ঠ রূপকার। মানবজাতির নৈতিক উন্নয়নসহ সার্বিক উন্নয়নকে পরিপূর্ণতা দিতেই ঘটেছিল তাঁর আবির্ভাব।
বিশ্বনবী (সা.)’র আবির্ভাব ঘটেছিল মানব জাতির এক চরম দুঃসময়ে যখন বিশ্বজুড়ে বিরাজ করছিল হানাহানি, জাতিগত সংঘাত, কুসংস্কার, অনাচার এবং জুলুম ও বৈষম্যের দৌরাত্ম্য। নারী জাতির ছিল না কোনো সম্মান। শির্ক ও কুফরির অন্ধকারে গোটা পৃথিবী হয়ে পড়েছিল আচ্ছন্ন। কিন্তু বিশ্বনবী (সা.) তাঁর শুভ জন্মের ৪০ বছর পর নবুওতি মিশন তথা ইসলামের বৈপ্লবিক নানা বাণী নিয়ে অজ্ঞ, কুসংস্কারাচ্ছন্ন এবং সব ধরনের উন্নত নৈতিক গুণ-বিবর্জিত মূর্তি পূজারী বর্বর আরব জাতির মধ্যে এমন পরিবর্তন সৃষ্টি করেন যে তারা মানব জাতিকে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও নৈতিকতাসহ নানা ক্ষেত্রে সবচেয়ে উন্নত সভ্যতা উপহার দিতে সক্ষম হয়।
ইসলামের দৃষ্টিতে মহান আল্লাহর পবিত্র অস্তিত্ব ছাড়া বিশ্বনবীর (সা) চেয়ে বড় ও মহীয়ান আর কিছুই নেই। বিশ্বনবীর শ্রেষ্ঠ চরিত্র ও শ্রেষ্ঠ সংগ্রামী জীবন ছাড়া শ্রেষ্ঠ ধর্ম তথা শ্রেষ্ঠ খোদায়ী বিধান ইসলামের বাস্তবায়ন কল্পনাও করা যেত না। আর এ জন্যই বলা হয় বিশ্বনবী (সা) যখন রেসালাত পান তখন বড় শয়তান আর্তনাদ করে ওঠে এবং সব সহযোগী শয়তানদের জড়ো করে বলে যে, আমাদের কাজ তো কঠিন হয়ে গেলো!
পবিত্র কুরআনের ভাষায় জীবনে চলার পথ, মত ও স্বভাব বা আচরণের দিক থেকে বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা) ছিলেন শ্রেষ্ঠ আদর্শ বা উসওয়াতুন হাসানাহ। জীবনের সব ক্ষেত্রে এবং কখন কোথায় কী করতে হবে তা জানার শ্রেষ্ঠ উৎস হলেন মহানবী (সা)। ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, আধ্যাত্মিক, ধর্মীয়, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, আইনি ও রাষ্ট্রীয় জীবনসহ জীবনের সব ক্ষেত্রেই তিনি রেখে গেছেন মানবজাতির জন্য সর্বোত্তম আদর্শ। কথায় ও কাজে সবক্ষেত্রে বিশ্বনবী (সা)-কে অনুসরণ করাই হবে একজন প্রকৃত মুসলমানের জন্য ঈমানের দাবি। তা না হলে আল্লাহর সর্বশেষ রাসুলের রেসালাতের প্রতি বিশ্বাস রাখার দাবি করাটা হবে প্রতারণা মাত্র।
কেউ যদি মহান আল্লাহর প্রিয় বান্দাহ হতে চান তাহলে তাঁর জন্য পবিত্র কুরআনে উল্লেখিত মহান আল্লাহর যে পরামর্শটি হৃদয়ে গেঁথে নেয়া উচিত তা হল: ‘হে রাসুল! আপনি তাদের বলুন, যদি আল্লাহকে ভালবাস, তাহলে আমার তথা আল্লাহর শেষ রাসুলের অনুসরণ কর যাতে আল্লাহও তোমাদের ভালবাসেন।’
জীবনের সবক্ষেত্রেই মহানবীর (সা) অনুসরণ করতে মহান আল্লাহ মুসলমানদের নির্দেশ দিয়েছেন। মহানবী কেবল তাঁর বক্তব্যে নয়, আচার-আচরণে, জনগণের সঙ্গে মেলামেশায় ও লেনদেনে, পরিবার-পরিজন ও বন্ধুদের সঙ্গে আচরণে, শত্রু ও বিজাতীয়দের সঙ্গে আচরণে এবং দুর্বল ও দরিদ্র আর শক্তিশালী বা ধনীদের সঙ্গে আচরণের ক্ষেত্রসহ সবক্ষেত্রেই সর্বোত্তম আদর্শ।
মহানবী (সা) চেয়েছিলেন তাঁর আশপাশের সব মানুষকে তাঁরই আদর্শের ধারায় শ্রেষ্ঠ বা পূর্ণাঙ্গ মহামানব হিসেবে গড়ে তুলতে। কিন্তু সবাই তাঁর দাওয়াতকে গ্রহণ করেনি। অনেকেই মুশরিক ও কাফিরই থেকে গেছেন। কেউ কেউ নামে মুসলমান হলেও বাস্তবে ছিলেন মুনাফিক। কিন্তু বিশ্বনবীর আহলে বাইতের সদস্যরা ছিলেন তাঁরই কাছাকাছি পর্যায়ের আদর্শ মহামানব যাঁদের নিষ্পাপ হওয়ার স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে পবিত্র কুরআনেই।
তাই মহানবীর (সা) আদর্শ ও পবিত্র কুরআনকে ভালোভাবে বুঝতে হলে জানতে হবে পবিত্র আহলে বাইতের জীবন-ধারাকে। জানতে হবে কিভাবে মুসলমানদের মধ্যে প্রবেশ করেছিল নানা বিচ্যুতি, অনাচার, জুলুম ও ইয়াজিদি স্বৈরতন্ত্র, রাজতন্ত্র প্রভৃতি। বিশ্বনবীর আহলে বাইতের আদর্শকে ছেড়ে দেয়ার কারণেই যে মুসলমানদের মধ্যে নানা বিভক্তি এবং অনৈক্য সৃষ্টি হয়েছিল তাও বোঝা সম্ভব হবে ইসলামের ইতিহাসের বস্তুনিষ্ঠ বিচার-বিশ্লেষণের মাধ্যমে।
সুরা আহজাবের ৫৬ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন, “আল্লাহ ও তাঁর ফেরেশতাগণ নবীর প্রতি দরুদ পাঠান। হে মুমিনগণ! তোমরা নবীর জন্যে রহমতের তরে দোয়া কর এবং তাঁর প্রতি সালাম পাঠাও।”
এ থেকে বোঝা যায় মহানবী (সা.) মানব জাতির জন্য মহান আল্লাহর সবচেয়ে বড় উপহার। নিরপেক্ষ বিশ্লেষণে অভ্যস্ত কোনো অমুসলিম পণ্ডিতও কখনও বিশ্বনবী (সা.)’র অতুল ব্যক্তিত্বের অনন্য প্রভাব, মহত্তম মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠ গুণগুলোর কথা অস্বীকার করতে সক্ষম নন। কারণ, মানব সভ্যতার সবচেয়ে সমৃদ্ধ পর্যায়গুলোর প্রতিটি ক্ষেত্রে বিশ্বনবী (সা.)’র অতুলনীয় মহত্ত্ব ও গুণের ছাপ স্পষ্ট।
সুরা আহজাবের ৪৫ ও ৪৬ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন, “হে নবী! আমি আপনাকে সাক্ষী, সুসংবাদ দাতা ও সতর্ককারীরূপে পাঠিয়েছিএবং আল্লাহর আদেশক্রমে তাঁর দিকে আহবায়ক ও উজ্জ্বল প্রদীপরূপে।”
বিশ্বের জাতিগুলো যখন নানা ধরনের মনগড়া খোদা বা মূর্তির পূজা করছিল এবং অজ্ঞতা, উদাসীনতা ও কুসংস্কার সর্বত্র জেঁকে বসে তখন মক্কা শহরে ইসলামের চির-উজ্জ্বল মশাল নিয়ে আবির্ভূত হন বিশ্বনবী (সা.)। তিনি মানবীয় মর্যাদা, মানবাধিকার ও স্বাধীনতার বিষয়ে উপহার দেন সবচেয়ে সুন্দর এবং সর্বোত্তম বক্তব্য। এভাবে তিনি মানবজাতির ইতিহাসের সবচেয়ে বড় শিক্ষকের অক্ষয় আসনে সমাসীন হন।
বিশ্বনবীর(সা.) মধ্যে সব নবী-রাসূল ও আওলিয়ার গুণের সমাবেশ ঘটেছে, তিনি উচ্চতর সেইসব গুণাবলীর পরিপূর্ণ ও পরিপক্ব সংস্করণ-যেসব গুণ যুগে যুগে নবী-রাসূল ও আওলিয়ার মধ্যে দেখা গেছে। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ির ভাষায়, ” যখন মহানবী (সা.)’র পবিত্র নাম মুখে আনি, এর অর্থ যেন হযরত ইব্রাহিম (আ.), নুহ (আ.), মুসা (আ.), হযরত ঈসা (আ.), হযরত লোকমান (আ.) এবং সব সালেহ বা সৎ ও খ্যাতনামা মহত ব্যক্তিদের ব্যক্তিত্ব বিশ্বনবী (সা.)’র মহান ব্যক্তিত্বের মধ্যে সমন্বিত, প্রতিফলিত ও প্রকাশিত হয়েছে।”
প্রখ্যাত ভারতীয় লেখিকা সরোজিনী নাইডু বিশ্বনবী (সা:)’র আদর্শ তথা ইসলাম সম্পর্কে দ্যা আইডিয়ালস অব ইসলাম গ্রন্থে লিখেছেন,
‘ন্যায়-বিচারবোধ ইসলামের এক অনুপম আদর্শ। যখনই আমি কোরআন অধ্যয়ন করেছি তখন প্রত্যক্ষ করেছি জীবন সম্পর্কিত সমস্ত গতিশীল নীতিকথা যা ভাববাদী অর্থে নয় বরং বাস্তব অর্থেই পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের দৈনন্দিন জীবন পরিচালনার পথ-নির্দেশনা। ‘
বিশ্বনবী (সা:) মানুষের কাছে যে ধর্ম প্রচার করেছেন সে সম্পর্কে এ. জে. টয়েনবি লিখেছেন ‘মুসলমানদের মধ্যে সংকীর্ণ জাতি বা গোত্রীয় চেতনার পরিপূর্ণ বিলোপ সাধন ইসলামের এক অবিসম্বাদী সাফল্য। বর্তমান বিশ্বকে গোষ্ঠী-প্রীতির অভিশাপ থেকে বাঁচানোর জন্যে ইসলামের প্রচার অত্যন্ত জরুরী।’
জর্জ বার্নার্ড শ বিশ্বনবী (সা)’র অবদান ও আদর্শ সম্পর্কে ‘দ্যা জেনুয়িন ইসলাম’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘ইসলামের মধ্যে যে অসামান্য জীবনী-শক্তি রয়েছে তার জন্যে আমি মুহাম্মদের ধর্মকে সব সময়ই প্রগাঢ় ভক্তি ও উচ্চ-সম্মান প্রদর্শন করে থাকি। আজ আমার কাছে স্পষ্ট যে একমাত্র ইসলামই পরিবর্তনশীল মানব-জীবনের সামগ্রিক অবস্থার সাথে খাপ-খাইয়ে নিতে সক্ষম, যার আবেদন সব যুগেই প্রযোজ্য ও অনুসরণীয়। অসাধারণ প্রজ্ঞাবান ও অত্যাশ্চর্য প্রতিভার অধিকারী এ মানুষ তথা মুহাম্মাদ (সা)কে যতটুকু আমি জেনেছি তাতে অকুণ্ঠচিত্তে বলতে পারি, তিনি সমগ্র মানবজাতির ত্রাণকর্তা। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, বর্তমান সময়ে যদি তাঁর মতো মহান ব্যক্তি পৃথিবী পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করতেন তবে তিনি মানব জাতির সেই কাঙ্ক্ষিত শান্তি ফিরিয়ে আনতে পারতেন, আজকের দিনে যার প্রয়োজন সবচেয়ে বেশী।
ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের প্রতিষ্ঠাতা ইমাম খোমেনী (র) বলেছেন,
‘মহানবীর আগমনের উদ্দেশ্য ছিল মানুষকে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দেয়া। তিনি মানুষের জন্য কুরআনের আয়াত তিলাওয়াত করতেন ও তাদের সংশোধন করতেন এবং পবিত্র করতেন। তাদের আত্মাগুলোকে পবিত্র করতেন। মানুষের সুশিক্ষা ও প্রশিক্ষণের জন্য তিনি সবার চেয়ে বেশি কষ্ট করেছেন। আর তা করেছেন মজলুম মানুষকে জালিমদের হাত থেকে মুক্তি দেয়ার জন্য। তাকে কত বেশি গালি দেয়া হয়েছে ও অপবাদ দেয়া হয়েছে। কিন্তু তিনি ইসলাম ধর্ম প্রচারে বিরত হননি।’
ইরানের সর্বোচ্চ নেতা হযরত আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী বিশ্বনবী (সা)’র আদর্শের প্রকৃত অনুসরণ সম্পর্কে বলেছেন,
‘মহানবীর রিসালাতের লক্ষ্য ছিল মানুষের মুক্তি সাধন। ইসলাম ও মহানবীর (সা) পক্ষ থেকে মানুষের জন্য রোগমুক্তির যে প্রেসক্রিপশন রয়ে গেছে তা সব যুগে মানুষকে মুক্ত করে অজ্ঞতা থেকে। এই নির্দেশিকা দিয়ে মোকাবেলা করা যায় জুলুম, বৈষম্য, দুর্বলের ওপর সবলের শোষণ এবং অন্য সব যন্ত্রণা যার শিকার মানবজাতি সৃষ্টির শুরু থেকে এ পর্যন্ত হয়েছে ও হচ্ছে। এই নির্দেশিকা যদি বাস্তবে মেনে চলা হয় তাহলেই সুফল আসবে। কিন্তু যদি ফেলে রাখা হয় বা এ থেকে ভুল অর্থ নেয়া হয়, কিংবা তা বাস্তবায়নের বা প্রয়োগের সাহস কেউ না করে তাহলে অবস্থা হবে সেই আগের মতই। সবচেয়ে ভালো ডাক্তারের শতকরা ১০০ ভাগ নির্ভুল চিকিৎসা-নির্দেশিকাও যদি আপনাকে দেয়া হয়, কিন্তু আপনি যদি তা পড়তে না পারেন, কিংবা তার ভুল পাঠ নেন, অথবা তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ না নেন ও তা পড়েই থাকে তাহলে রোগীর ওপর তার কী প্রভাব পড়বে! এবং ওই দক্ষ চিকিৎসককেই বা কি দোষ দেয়া যাবে?
পবিত্র কুরআনে মুসলমানদের বলা হয়েছে, তোমরা আল্লাহর রজ্জু শক্ত করে ধর এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না। কিন্তু মুসলমানরা এক আল্লাহ, এক নবী, অভিন্ন কুরআন ও ইসলামের মূল নীতিগুলো মেনে নেয়া পরস্পরের মধ্যে সীসা ঢালা প্রাচীরের মত ঐক্য গড়ে তুলতে পারছে না। অথচ মুসলমানদের বিরুদ্ধে খ্রিস্টান, ইহুদি ও অন্য অমুসলিমদের সুদৃঢ় ঐক্য লক্ষ্যণীয়।
বিশ্বনবী (সা.) যে সমাজ-ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিলেন সেখানে ভাষা, বর্ণ, গোত্র বা জাতিগত পার্থক্যের কারণে কারো অধিকার বেশি বা কম ছিল না। বরং খোদাভীরুতাকেই ধরা হত শ্রেষ্ঠত্বের বা মর্যাদার মানদণ্ড। একজন নিঃস্ব কালো বর্ণের ক্রীতদাসও পেত অন্য যে কোনো মুসলমানের মত স্বাভাবিক মর্যাদা এবং খোদাভীরুতার মত যোগ্যতার বলে সে সেনাপতি বা মুয়াজ্জিন হওয়ার মত উচ্চ পদেরও অধিকারী হত। আর এগুলোই হল সব ধরনের ঐক্যের মহাসূত্র যার বাস্তবায়ন আজো মুসলিম সমাজের জন্য অপরিহার্য ও একান্তই জরুরি বিষয়।
পবিত্র কুরআন বলেছে, মুসলমানরা পরস্পরের ভাই। ইসলাম দু-জন মুসলমানের মধ্যে বিরোধ মিটিয়ে দেয়া এবং তাদের মধ্যে বন্ধুত্ব জোরদারকে ব্যাপক গুরুত্ব দিয়েছে। মহানবী (সা.) তাঁর সহনশীলতা, উদারতা ও ক্ষমাশীলতার মাধ্যমে বহু গোত্র এবং বিবদমান মুসলমানদের মধ্যে শান্তি ও ঐক্য প্রতিষ্ঠা করেছেন। তিনি ফেতনাবাজদের কঠোর হাতে দমন করার শিক্ষাও দিয়ে গেছেন।
পবিত্র কুরআন বলেছে, মুহাম্মাদের প্রকৃত সঙ্গী বা অনুসারীরা পরস্পরের প্রতি দয়ার্দ্র এবং কাফিরদের প্রতি কঠোর। মুসলিম নেতাদের বেশিরভাগই আজ ইসলামের চেয়েও জাতীয়তাবাদকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন। তাদের অনেকেই মনে করেন পশ্চিমা গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতেই ইসলাম কায়েম করা সম্ভব! অধিকাংশের ঐক্যমত্যের নামে অনেক অদূরদর্শী ও ভুল পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে যা ছিল পবিত্র কুরআন এবং হাদিসের শিক্ষার সুস্পষ্ট বিপরীত। ইসলামের সবচেয়ে নির্ভুল ব্যাখ্যাদাতা তথা বিশ্বনবী (সা.)’র পবিত্র আহলে বাইতের অনেক সদস্য তথা পবিত্র ইমামদেরকে কোণঠাসা করে বা গোপনে হত্যা করে ইসলামের আলোকে চিরতরে নিভিয়ে দিতে চেয়েছে খলিফা নামধারী একদল রাজা-বাদশাহ।
আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রসহ অনেক ক্ষেত্রেই পিছিয়ে রয়েছে মুসলমানরা। এর কারণ হল পশ্চিমাদের অন্ধ আনুগত্য বা অনুকরণ এবং ইসলামী আদর্শ ও জিহাদ থেকে দূরে থাকা। তাই মুসলিম দেশগুলোর শাসকরা ও বুদ্ধিজীবীরা এখনও পশ্চিমা শোষক ও উপনবিশেবাদীদের স্বার্থকেই প্রাধান্য দিচ্ছেন। ফিলিস্তিন, ইয়েমেন, কাশ্মির ও মিয়ানামারের মজলুম মানুষের জন্য তারা কার্যকর ও ঐক্যবদ্ধ কোনো পদক্ষেপ নিতে পারছে না। বিশ্বনবী (সা.) মিটিয়ে দিয়েছিলেন জাতিগত গরিমা বা বংশীয় ভেদাভেদের সীমারেখা। আজো কেবল ইসলামের ধর্মীয় বন্ধনই পৃথিবীর দুই প্রান্তে অবস্থিত বা দূরতম অঞ্চলে অবস্থিত মুসলমানের মধ্যে ঐক্য ও সংহতির একমাত্র কার্যকর বন্ধন। একমাত্র ভ্রাতৃত্বের চেতনার কারণেই নানা অঞ্চলের এবং নানা ভাষা ও জাতিগত পরিচিতির অধিকারী মুসলমানরা পরস্পরের সুখ ও দুঃখে প্রভাবিত হয়। ইসলামী আদর্শই যদি হয় মুসলমানদের ঐক্যের মূল সূত্র তাহলে তাদের কখনও হতাশ হওয়া উচিত হবে না। মুসলমানদেরকে ফিরে যেতে হবে প্রতিরোধ, ঐক্য ও আত্মত্যাগের সংস্কৃতির দিকে। কবি নজরুলের ভাষায় শহীদী ঈদগাহে যখন হবে জমায়েত ভারি তখনই সারা দুনিয়ায় আবারও হবে ইসলামী ফরমান জারি।
মহান আল্লাহ আমাদের সবাইকে বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা) ও তাঁর পবিত্র আহলে বাইতের প্রতি আনুগত্য আর গভীর অনুরাগের উসিলায় পরিপূর্ণ মানুষ হওয়ার তৌফিক দান করুন। মহানবী’র ওফাত-বার্ষিকী উপলক্ষে সবাইকে জানাচ্ছি আবারও গভীর শোক ও সমবেদনা এবং আল্লাহর সর্বশেষ এই নবী ও তাঁর পবিত্র আহলে বাইতের শানে পেশ করছি অশেষ দরুদ আর সালাম।
নিউজ /এমএসএম