রাজধানীর ঢাকা জজকোর্ট (আদালত) প্রাঙ্গণে পুলিশের হাত থেকে জঙ্গি ছিনতাই নিছক দুর্ঘটনা বলে উড়িয়ে দিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন। তবে এই ঘটনাকে ইস্যু বানিয়ে বাকযুদ্ধে মেতে উঠেছেন সরকারি দল আওয়ামী লীগ ও রাজপথের বিরোধী দল হিসেবে পরিচিত বিএনপি। একইসঙ্গে এ নিয়ে রাজনীতিতে শুরু হয়ে কাদা ছোড়াছুড়ি। তবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন গতকাল মঙ্গলবার সিলেটে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, আদালত প্রাঙ্গণে পুলিশের হাত থেকে জঙ্গি ছিনতাই নিছক দুর্ঘটনা। এতে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হবে না। এটা সব দেশেই ঘটে থাকে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, বিএনপি সরকারের আমলে জঙ্গিবাদের সূত্রপাত। তারাই শায়খ আবদুর রহমান, বাংলাভাইকে সৃষ্টি করেছে। তিনি বলেন, হাওয়া ভবন থেকে জঙ্গিদের ইন্ধন দেওয়া হতো। তারাই জঙ্গিদের সৃষ্টি করেছে। আর আমরা (আওয়ামী লীগ) জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে। আদালতে কারা জঙ্গিদের ছিনিয়ে নিয়েছে, সেটার তদন্ত চলছে। অপেক্ষা করুন তদন্তে বের হয়ে আসবে। গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে লক্ষ্মীপুর জেলা আওয়ামী লীগের ত্রি-বার্ষিক সম্মেলনের উদ্বোধন শেষে তিনি এ কথা বলেন। পাল্টা জবাবে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ঢাকায় দুই জঙ্গি ছিনতাইয়ের ঘটনায় ‘সরকারের গভার্ন্যান্সের (সুশাসন) চিত্র’ ফুটে উঠেছে। তিনি বলেন, চারদিকে তাকালে চোর, চুরি; চারদিকে তাকালে গুন্ডামি; চারদিকে তাকালে মারামারি। তাঁরা এত কিছু করছেন, এক দিনমজুরকে গুলি করে তাঁর নাড়িভুঁড়ি বের করে দিতে পারছেন। আর আপনাদের (আইনশৃঙ্খলা বাহিনী) সামনে দিয়ে জঙ্গি উধাও হয়ে যাচ্ছে। বুঝতেই পারেন তাদের (সরকার) গভার্ন্যান্স। কোন জায়গায় তারা গভার্ন্যান্সকে নিয়ে এসেছে। এক প্রশ্নের জবাবে মির্জা ফখরুল বলেন, আওয়ামী লীগ দেশ ও জাতিকে গভীর সংকটে ফেলেছে বলে আমি মনে করি। এটা একটা ক্রিটিক্যাল মোমেন্ট। যদি নির্বাচন ঠিকমতো না হয়, নির্বাচনে যদি জনপ্রতিনিধি সঠিকভাবে নির্বাচিত না হয়, সে দেশ কিভাবে চলবে? এ বিষয়ে কথা বলেছেন সরকারের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদও। তিনি বলেন, বিএনপি এদেশে জঙ্গিবাদের মূল পৃষ্ঠপোষকতা করছে। আওয়ামী লীগ কোনো বাঁধা দিচ্ছে না বলেই সমাবেশ করতে পারছে বিএনপি। মঙ্গলবার দুপুরে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে উন্নয়ন সমন্বয় আয়োজিত, তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন শক্তিশালীকরণে গণমাধ্যমের সাথে অভিজ্ঞতা বিনিময় অনুষ্ঠানে তিনি এ কথা বলেন তিনি। তিনি বলেন, বিএনপির আন্দোলনে আমরা কিন্তু বাঁধা দিচ্ছি না বরং তারা গ্রেনেড বোমা হামলা করে আমাদের সমাবেশ নষ্ট করেছে আগে এমন ইতিহাস আছে। তিনি বলেন, এই দেশে জঙ্গিদের আশ্রয়দাতা, প্রশ্রয়দাতা, অর্থদাতা হচ্ছে বিএনপি ও এর নেতারা। সেই জঙ্গিরা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। তথ্যমন্ত্রী বলেন, আদালত থেকে আসামি ছিনতাই করা হয়েছে, চট্টগ্রামে পুলিশ বক্সের ওপর হামলা চালানো হয়েছে, কাঁচপুর ব্রিজের নামফলক পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ তারা আবার জ্বালাও-পোড়াও, নৈরাজ্য শুরু করেছে। তাদের মদদে এবং পৃষ্ঠপোষকতায় জঙ্গিগোষ্ঠী, সন্ত্রাসীবাহিনী, মৌলবাদীরা আবার ডালপালা মেলেছে। সুতরাং এই জঙ্গিগোষ্ঠীর আস্ফালন আর বিএনপির নেতৃত্বে সারা দেশে নৈরাজ্য সৃষ্টির পাঁয়তারা একসূত্রে গাঁথা। তবে তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী, আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ এর বক্তব্যের কড়া সমালোচনা করেছেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। তিনি বলেন, জঙ্গি ও আওয়ামী লীগের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। ঢাকার জজ কোর্টে যে জঙ্গি নাটক হলো সেটা সন্দেহজনক। হাতকড়া ও পায়ে বেড়ি পরিয়ে জঙ্গি চলে গেলো। পুলিশের কোনো নিরাপত্তা নেই। তারা কি দেশের মানুষকে বেকুব মনে করেন। তাদের আহম্মক মনে করেন শেখ হাসিনা? প্রকৃতপক্ষে জঙ্গি ও আওয়ামী সরকারের কাজের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। মঙ্গলবার সকালে নয়া পল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক অনুষ্ঠানে তিনি এসব কথা বলেন। তিনি বলেন, আপনি কি দেখেননি কীভাগে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুরে ছাত্রদলের নেতা নয়নকে বন্দুক ঠেকিয়ে হত্যা করেছে। এটা তো পুলিশ করেছে। এটা কি জঙ্গির মতো আচরণ নয়? ইলিয়াস আলী গুম। এটাতো জঙ্গিদের কাজ। জাকির খুন। এটাও তো জঙ্গিদের কাজ। প্রকৃতপক্ষে জঙ্গিদের কাজ ও আওয়ামী সরকারের কাজের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। ওরা যে জঙ্গিদের মতো কাজ করে তার প্রমাণ ভুরি ভুরি। সাবেক আইজিপি শহীদুল হক তার বইয়ে লিখেছেন। আসলে তারাই জঙ্গির নাটক করে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটি: ঢাকার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালত চত্বর থেকে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুই জঙ্গিকে ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগ। চার সদস্যবিশিষ্ট এ কমিটি গঠন করে সম্প্রতি সংশ্লিষ্টদের কাছে চিঠি পাঠানো হয়েছে। চিঠিতে বলা হয়, গত রোববার (২০ নভেম্বর) ঢাকার সিএমএম আদালত প্রাঙ্গণ থেকে সন্ত্রাস বিরোধী আইনে সাজাপ্রাপ্ত আবু সিদ্দিক ওরফে সোহেল ওরফে সাকিব ও মাইনুল হাসান শামীম ওরফে ইমরানকে (ব্লগার দীপন এবং অভিজিৎ হত্যা মামলায় মৃত্যু দণ্ডের আদেশপ্রাপ্ত আসামি) তার সহযোগীরা পুলিশ সদস্যদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে যায়। এ ঘটনায় চার সদস্যবিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হলো। সুরক্ষা সেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিবকে (কারা অনুবিভাগ) এ কমিটির আহ্বায়ক করা হয়েছে। কমিটির বাকি তিন সদস্য হলেন—মহাপুলিশ পরিদর্শকের প্রতিনিধি (ডিআইজি পদ মর্যাদার নিচে নয়), অতিরিক্ত কারা মহাপরিদর্শক এবং ঢাকার অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট। কমিটি আগামী সাত কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিল করবে বলে এতে জানানো হয়।
এরআগে হলি আর্টিজানের জঙ্গি হামলার ৬ বছর পর ফের আলোচনায় জঙ্গিবাদ। চার বছর ধরে একটি সংগঠন গোপনে তাদের জঙ্গি কার্যক্রম চালিয়ে আসছে যা ‘জামায়াতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বিয়া’ নামে আত্মপ্রকাশ করেছে। তারা দীর্ঘদিন ধরে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও এনজিওর উন্নয়নমূলক কাজের কথা বলে চাঁদা তুলে কার্যক্রম পরিচালনা করছে। ২০১৬ সালের ১ জুলাই নৃশংসতা বিবেচনায় দেশের সবচেয়ে বড় জঙ্গি হামলার ঘটনা ঘটে গুলশান হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয়। ওই হামলায় যে জঙ্গিরা জড়িত ছিলেন তারা সবাই কথিত হিজরতের উদ্দেশ্যে ঘর ছেড়েছিলেন। এরপর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অব্যাহত অভিযানে কোণঠাসা হয়ে পড়েন জঙ্গিরা। দীর্ঘ ৬ বছর পর আবারও আলোচনায় এসেছে জঙ্গিবাদ। কুমিল্লা থেকে একসঙ্গে আট তরুণের নিখোঁজ হওয়ার ঘটনায় নড়েচড়ে বসে প্রশাসন। শুরু থেকেই সন্দেহ করা হয় ঘরছাড়া তরুণরা নিশ্চয়ই কোনো জঙ্গি মতাদর্শে অনুপ্রাণিত হয়েছে। বাড়তে থাকে নিখোঁজের তালিকা। শুধু কুমিল্লা থেকে নয় দেশের ১৯ জেলা থেকে ৫৫ জন নিখোঁজের তালিকা দেয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। সর্বশেষ ঢাকার আদালত থেকে দুই জঙ্গি ছিনতাইয়ের ঘটনায় নড়েচড়ে বসে প্রসাশন। গত রোববার (২০ ডিসেম্বর) বেলা ১২টার দিকে একটি মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুই জঙ্গি মইনুল হাসান শামীম ও আবু সিদ্দিক সোহেল ওরফে সাকিবকে কারাগার থেকে আদালতে হাজির করা হয়। হাজিরা শেষে পুলিশ সদস্যরা তাদের নিয়ে আদালত চত্বর ছেড়ে যাচ্ছিলেন। এ সময় পুলিশের চোখে-মুখে স্প্রে করে শামীম ও সাকিবকে ছিনিয়ে নিয়ে যায় আগে থেকেই ওৎ পেতে থাকা অন্যান্য জঙ্গিরা। শামীম ও সাকিব এই দুই জঙ্গি দীপন হত্যা মামলার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি।