বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ২২তম জাতীয় সম্মেলন আগামী ২৪ ডিসেম্বর ঢাকার ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। দলীয় প্রধানের নির্দেশনায় এবারের সম্মেলন সীমিত পরিসরে করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। আলোচনা-সমালোচনা চলছে সর্বত্র দলের কর্মী থেকে নীতি নির্ধারক পর্যন্ত। দলীয় অফিস ভরপুর জানান দিতে হরেক রকম শো ডাউন। তবে একটা বিষয়ে হতবাক হচ্ছি যে, পার্টি অফিসে প্রতিনিয়ত নিয়ম করে একেক নেতার ব্যক্তিগত লোক তাদের বডি ল্যাংগুয়েজ দেখলেই আমরা বুঝতে পারতাম, ওমুক নেতা আসছে। যদিও এ সমস্ত লোকদের রাজনৈতিক পরিচয় নিয়ে সন্দেহ আছে। তাদের কপালে চিন্তার ভাঁজ পরেছে! এমন দু-একজনের কাছে জিজ্ঞাসা করেছি নেতার খবর কী? উত্তরে বলেন, ‘টেনশনে আছি ভাই, কী যে আছে কপালে?’ যাক শেষমেষ তারা যে উপলব্ধি করতে পেরেছে।
তবে মূল প্রতিপ্রাদ্য বিষয় হলো ‘উপলব্ধি, চমক, ধমক আর নির্বাচন’। আওয়ামী লীগের দুবারের সফল সাধারণ সম্পাদক ‘ডায়নামিক’ জননেতা ওবায়দুল কাদের ইতোমধ্যে বিরোধী দলকে ধমক দিয়ে ঘোষাণা দিলেন, ১০ লক্ষাধিক মানুষের সমাগম হবে সম্মেলন স্থলে।
অনেকের মতে, আওয়ামী লীগ এখন ক্ষমতায় আছে বলেই বিশাল জনগোষ্ঠী নিয়ে এত বড় সম্মেলন আয়োজন করতে সাহস দেখচ্ছে। কিন্তু কেবল ক্ষমতায় থাকলে এবং অর্থ জোগানের অফুরন্ত উৎস থাকলেই বড় ও সুশৃঙ্খল সম্মেলন করা যে সম্ভব হয় না, সেটা অতীতে ক্ষমতাসীন কোনো কোনো দলের সম্মেলনের ক্ষেত্রে আমরা দেখেছি।
তবে বিরোধী দলের সঙ্গে টেক্কা দিয়ে ১০ লক্ষাধিক মানুষ সম্মেলনে হাজির করা জনদুর্ভোগের কারণ হতে পারে। এ বিষয়টি মাথায় নিয়ে যথাযথ প্রদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। বিরোধী দলকে হিসাবে নেওয়ার আগে নিজ দলের অবস্থান নেতাকর্মী তথা দেশের জনতার কাছে স্পষ্ট হওয়া জরুরি। এই সম্মেলনে বড় চ্যালেঞ্জ থাকবে হাইব্রিড আর অনুপ্রবেশকারীদের ঠেকানোর পাশাপাশি বঞ্চিতদের কাছে টানা।
সাধারণত সম্মেলনের মূল লক্ষ্য থাকে তিনটি। ১. দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে নতুন উৎসাহ-উদ্দীপনা সৃষ্টি করা। ২. একটি নতুন কমিটি নির্বাচন। ৩. রাজনীতি ও সাংগঠনিক বিষয়ে আলাপ আলোচনা। এই তিনটি লক্ষ্যের আলোকে এখন আমরা দেখে নেওয়ার চেষ্টা করব আওয়ামী লীগের ২২তম সম্মেলন কতটুকু সফল হতে পারে।
১. ইতোমধ্যে সারা দেশে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মধ্যে নতুন উৎসাহ-উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়েছে, যা অতিতের সমস্ত রেকর্ড অতিক্রম করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
২. এবারের সম্মেলনে আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা আপাই যে সভাপতি পদে নতুন করে দায়িত্ব পাবেন, সে ব্যাপারে দলে বা দলের বাইরে কারও মনেই কোনো সন্দেহ সংশয় নেই। শ্রদ্ধেয় নেত্রীর বিকল্প আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গ সহযোগী কোনো নেতাকর্মী কল্পনা করতে পারি না। তিনি আওয়ামী লীগের ঐক্য ও সংহতির প্রতীক। তাকে বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগের কমিটি গঠনের কথা কারও বিবেচনাতেই নেই। তাই ২২তম সম্মেলনেও তিনি টানা দশমবারের মতো আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হবেন।
২২তম সম্মেলনে সাধারণ সম্পাদক কে হবেন—এটা বলা মুশকিল। আওয়ামী লীগের ইতিহাসে পরপর তিনবার সাধারণ সম্পাদক হওয়ার নজির নেই। তবে অনেকের ধারণা, আগামী নির্বাচনে ‘ডায়নামিক’ নেতৃত্ব অতিব জরুরি। এই গুণের অধিকারী জননেতা ওবাইদুল কাদেরের বিকল্প নেই। তিনিই হতে পারেন এই বিরল রেকর্ডের অধিকারী। এ ছাড়া সাংগঠনিক বিবেচনায় ড. হাসান মহমুদ চৌধুরী, শেকড়ের বিবেচনায় জাতীয় চার নেতার অন্যতম কামারুজ্জামানের সুযোগ্য উত্তরাধিকারী এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন এবং পরিচ্ছন্ন ও ক্লিন ইমেজ হিসেবে খ্যাত ড. আব্দুর রাজ্জাক ও খালিদ মাহমুদ চৌধুরী প্রমুখ বিশ্বস্ত সূত্রে এগিয়ে রয়েছেন। অনেকেই মনে করছেন প্রেসিডিয়াম সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানিক ও যুগ্ম সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ চমক দেখাতে পারেন।
দেশের জনতা এবং আওয়ামী লীগের কর্মীদের যে সমস্ত নেতারা পালস বোঝেনি, অথবা বুঝতে চায় না—তাদের বিপক্ষে তৃনমূল জনগণও বিরক্ত। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দায়িত্বশীল নেতারা তাদের নেতৃত্বের সুবাতাস যথাযথভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে ব্যর্থ হয়েছেন। স্বজনপ্রীতি ও লেনদেনের কার্যক্রম আলোচনার টেবিলে এবারের সম্মেলনে তাদের বাদ পড়া প্রায় নিশ্চিত। এ সমস্ত জায়গায় দুর্দিনের ছাত্রলীগের সাবেক পরীক্ষিত নেতাদের অন্তভুক্ত করার বিরাট সম্ভাবনা রয়েছে।
এই সম্মেলনে অবাক করা কিছু ঘটনার জন্ম দিতে পারে, যেমন আওয়ামী লীগের অঙ্গ ও তার সহযোগী সংগঠনের নেতা নির্বাচনে সাম্প্রতিক সময়ে বায়োডাটা চাওয়া হয় একটি নির্দিষ্ট ফরমেটে। আজ যে কর্মী হয়েছে, সেও নিজেকে যোগ্য মনে করে নেতা হতে চায়। আওয়ামী লীগের এই সম্মেলনে বায়োডাটা চাওয়া হলে বোঝা যাবে, কত ধানে কত চাল।
৩. সাংগঠনিক পর্যালোচনা: ২২তম ‘এই সম্মেলনে আওয়ামী লীগকে কঠোর ও তিক্ত সত্যগুলো বিশ্লেষণ করতে হবে, দল পুনর্গঠনে বাস্তব কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। নইলে এই সম্মেলন পাকিস্তানের আইয়ুব খানের আমলের উন্নয়ন দশকের উৎসবের পরিণতি বরণ করতে হতে পারে। আমি এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের হাই কমান্ডের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।’ দুঃখজনক হলেও সত্য এটাই যে, আওয়ামী লীগের সম্মেলনে ‘কঠোর ও তিক্ত’ বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা খুব কমই হয়, যা অনাকাঙ্ক্ষিত বটে।
দলের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক লক্ষ্য পূরণেই সরকারের কাজ করার কথা। কিন্তু টানা তিন মেয়াদে সরকারে থাকায় দল হিসেবে আওয়ামী লীগের মধ্যে নানা ধরনের ত্রুটি-দুর্বলতা দেখা যাচ্ছে। আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক কাঠামোর মধ্যে যে দুর্বলতা দেখা দিয়েছে, তার প্রকট বহিঃপ্রকাশ দেখা গেছে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহী প্রার্থীর সংখ্যার মধ্য দিয়ে। দলের মধ্যে সর্বস্তরে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে না আনতে পারলে পরবর্তী নির্বাচনে বড় রকমের খেসারত দিতে হবে। ১০ লাখ সমাগম বৃথা যেতে পারে। বিভিন্ন পর্যায়ে দলের মধ্যে হাইব্রিড আর অনুপ্রবেশকারীদের দাপটে নাজেহাল অধিকাংশ দুর্দিনের নেতাকর্মী। যারা ক্ষমতার কাছাকাছি রয়েছে, তাদের মধ্যে অনেকেই বিনয়ীভাব ভুলেই গেছেন বলে ধরে নেওয়া যায়। অনেককেই এক তরফা সমর্থন দিয়ে অন্যদের বঞ্চিত করেছে। যত বড়ই নেতা, এমপি বা মন্ত্রী হোক দলের সুবিধার্থে তাদের খুঁজে বের করতে হবে। এসবের বিরুদ্ধে এখনই কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার অবস্থাও হয়তো থাকবে না। সম্মেলনে এই দুর্বলতাগুলো আলোচিত হওয়া অতীব জরুরি।
আওয়ামী লীগ সরকারের ১৪ বছরের এত সফলতা মেগা প্রজেক্ট স্যাটালাইট যুগে প্রবেশ, মেট্রোরেল, বঙ্গবন্ধু টানেল, বিদ্যুতে অভাবনীয় সফলতা, জঙ্গি দমন, ডিজিটাল বাংলার রূপায়ন, মহামারি করোনা মোকাবিলায় অকল্পনীয় সফলতা এত কিছুর পরও ভোট নিয়ে কেন ভাবতে হচ্ছে আওয়ামী লীগকে? এই প্রশ্নের উত্তর এই সম্মেলনে বের করতে হবে। সমীক্ষায় দেখা গেছে, দলীয় সভানেত্রীর জনপ্রিয়তা আকাশচুম্বি। আর সেই দলের অধিকাংশ নেতা এবং জনপ্রতিনিধিদের জনপ্রিয়তা নিম্নমুখী। কিন্তু কেন? এর জবাব চাইতে হবে। হাইব্রিড, অনুপ্রবেশকারী এবং তেল মারা নেতাদের সংগঠন থেকে বাদ দিতে হবে।
আওয়ামী রাজনীতিতে দীর্ঘদিন শিক্ষণীয় কার্যক্রম, সভা-সেমিনার অনুপস্থিত। কিন্তু কেন? রাজনীতিতে শিখতে হবে, জানতে হবে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিজে সভা-সেমিনারে প্রতিনিয়ত অংশগ্রহণ করতেন। তিনি নিজে জ্ঞান আহরণ করতেন এবং অন্যদের সঙ্গে তা শেয়ার করতেন।
প্রশিক্ষণের অভাবে কোথায় কী বলতে হয়, তা আমাদের অনেক বড় বড় নেতারাই জানে না। তাদের অগ্রহণযোগ্য কথাবার্তা দল এবং সরকারের ভাবমূর্তি বিনষ্ট করছে। সফল সম্মেলন হতে হলে এ বিষয়গুলো গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে।
এত কিছুর পরও আশায় বাধিঘর, তাই তো মনে করি, সব বাধা ও অপশক্তি নিবাশ করে প্রিয় নেত্রী শেখ হাসিনার প্রাজ্ঞ নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ বাংলাদেশকে বিশ্বদরবারে বিশেষ সম্মান ও মর্যাদার সঙ্গে মাথা আরও উঁচু করে দাঁড় করাতে সক্ষম হবে। মনে রাখতে হবে এই দেশের মানুষ বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কাছে প্রত্যাশা করে অন্য কোনো দল বা ব্যক্তির কাছে নয়। আওয়ামী লীগের ২২তম সম্মেলনের সাফল্য কামনা করি।
লেখক: সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
ইউকেবিডিটিভি/ বিডি / এমএসএম