একমাত্র শুদ্ধি অভিযানই রক্ষা করতে পারে আওয়ামী লীগের সুনাম। বাংলাদেশের মতো প্রবাসেও আওয়ামী লীগের কমিটিগুলোর মধ্যে দেখা যায় দু’টি গ্রুপ এবং এই গ্রুপগুলোর পেছনে রয়েছে আওয়ামী লীগের উচ্চ পর্য্যায়ের নেতৃবৃন্দের হাত। এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, নেতৃবৃন্দ তাদের গ্রুপে যে যতবেশী সমর্থক দেখাতে পারবে তারই প্রাধান্য থাকে বেশি, আর সে কারণেই যে কোন সভা সমিতিতে অনেক সময় দেখা যায় তাদের প্রাধান্য দেখাতে, কার কত শক্তি আছে।
প্রথমে উচ্চ স্বরে কথাবার্তা শুরু হয়, সেখান থেকে অনেক সময় হাতাহাতি এমন কি চেয়ার টানাটানি হতেও দেখা যায়। এসব ঘটনাগুলো শুধু রাজনৈতিক সভা সমাবেশেই নয়, অনেক সময় ভিন্ন ধরণের সামাজিক সমাবেশেও ঘটে থাকে। এসব ঘটনার সূত্রপাত হয় দলীয় কথাবার্তা থেকে।
লন্ডনে যখন পত্রিকায় কাজ করি সেখানে যেমন দেখেছি, ঠিক তেমনি ভাবে অন্যান্য জায়গাও। এই খবরগুলোকে কিছু সংখ্যক সাংবাদিকরা তিলকে তাল করে মনের আনন্দে তা জনসমক্ষে প্রকাশ করার সুযোগ পায়। তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য হচ্ছে, জনগণকে আওয়ামী-বিমুখ করা। এই সত্যটি যদি আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ ও কর্মীরা বুঝতে না পারেন যে, এ সব ঘটনার কারণে দলের ভাবমূর্তি জনগণের কাছে ক্ষুন্ন হচ্ছে, তাহলে জনগণের সহযোগিতা কি ভাবে আশা করা যায়?
রাজনীতিতে গ্রুপিং থাকে এ কথা সত্য, সংগঠনের উচ্চ পর্য্যায়ের নেতৃবৃন্দের উচিৎ খেয়াল রাখা যাতে স্থানীয় নেতৃবৃন্দ ও কর্মীরা প্রতি সংগঠনের ভাবমূর্তি নষ্ট না করে।
বাংলাদেশের বাইরে বিশেষ করে আমি যুক্তরাজ্যের কথা বলছি। লন্ডন সহ বিভিন্ন শহরগুলোতে দীর্ঘদিন যাবৎ সম্মেলন করে কোন নতুন কমিটি গঠিত হচ্ছেনা, বহু বছর ধরে একই কমিটি দলকে চালাচ্ছেন। এ নিয়ে দলের নেতা কর্মীদের মধ্যে প্রচন্ড ক্ষোভ পরিলক্ষিত হয়। কিন্তু কি কারণে সম্মেলনের মাধ্যমে নিয়ম মাফিক দলের নেতৃত্ব রদবদল করা হচ্ছেনা জানতে চাইলে উত্তর আসে সেন্ট্রাল থেকে নির্দেশ না আসলে আমরা তা করতে পারি না।
সম্প্রতি বাংলাদেশে জেলা পরিষদের নির্বাচন হয়েছে। বিভিন্ন অঞ্চলে নির্বাচনী এলাকাগুলোতে দেখা যাচ্ছে, বিভিন্ন এলাকায় অন্যান্য প্রতিদ্বন্ধিদের সাথে আওয়ামী লীগেরও দু’টি গ্রুপ থাকছে। একজন হচ্ছেন আওয়ামী লীগের মূল প্রার্থী আর অন্যজন হচ্ছেন বিদ্রোহী প্রার্থী! যার ফলে দেখা যাচ্ছে অনেক কেন্দ্রে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী জয়ী হচ্ছে। তার কারণ হচ্ছে, আওয়ামী লীগের যিনি বিদ্রোহী প্রার্থী তিনিও আওয়ামী লীগ সেন্ট্রাল কমিটির কোন এক নেতার সাথে তাঁর দহরম মহরম বেশী, সে কারণেই তিনি বিদ্রোহী প্রার্থী হবার সাহস পেয়েছেন, নমিনেশনও পেয়েছেন।
আওয়ামী লীগের এ ধরণের রাজনীতি চলতে থাকলে আওয়ামী লীগ দিন দিন দুর্বল থেকে দুর্বলতর হতে থাকবে এ কথা সত্যিকারের আওয়ামী লীগ যারা করেন, যারা বঙ্গবন্ধুর আদর্শ নিয়ে আওয়ামী লীগ করেন, যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী তাদের অবশ্যই স্বীকার করতে হবে।
শুধু আওয়ামী লীগের দলীয় সভাতেই এসব ঘটনা ঘটছে না, অরাজনৈতিক সংগঠনগুলোরও বেলায়ও তাই হচ্ছে।
গত ১৭ই অক্টোবর বার্মিংহামে যেখানে আমাদের বিরাট সংখ্যক বাংলাদেশীদের বসবাস সেখানে ’লন্ডন বাংলা বই মেলা’ অনুষ্ঠিত হয়। বইমেলা আয়োজকদের আমন্ত্রণে আমি আমার সদ্য প্রকাশিত বই ’রূপসী ওয়েলসের কোলে ছোট্ট এক বাংলাদেশ’ নিয়ে উক্ত বই মেলায় অংশ গ্রহণ করি। এই বই মেলায় যে অনাকাঙ্খিত ঘটনাটি ঘটেছে তার একটি রিপোর্ট অনলাইন পত্রিকা ’দেশ বিদেশ ডট নিউজ”-এ বের হয়েছে। তারই একটি অংশ আমি পাঠকদের কাছে তুলে ধরছি বিষয়টি অনুধাবন করার জন্য।
“সোহেল আহমদ চৌধুরী, বার্মিংহাম প্রতিনিধি –
লন্ডন বাংলা বইমেলা নামক সংগঠন কর্তৃক বিয়া লাউঞ্জে আয়োজিত বার্মিংহামের বাংলা বইমেলায় আজকে ঘটে গেল বার্মিংহামের সাংস্কৃতিক সামাজিক অঙ্গনে ইতিহাসের সবচেয়ে লজ্জাজনক ঘটনা। সাংস্কৃতিক বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদের উপস্থিতিতে বার্মিংহাম আওয়ামী লীগের বিবাদমান দুই গ্রুপের মধ্যে বার্মিংহাম আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক কামাল আহমদের নাম সহযোগি সঞ্চালক হিসেবে ঘোষণা করা মাত্র প্রতিপক্ষের নেতা কর্মীরা প্রচন্ড বিক্ষোভে ফেটে পড়েন।
সাথে সাথে স্নোগানে স্লোগানে উত্তাল হয়ে ওঠে পুরো ঘটনাস্থল। আওয়ামী লীগের বড় একটি অংশ কামাল বিরোধী স্লোগানে চিৎকার করতে থাকে। এর মধ্যে সে জামায়াতের দালাল, সে বিএনপি’র দালাল চিৎকার করতে থাকে। সে কোন অবস্থায়ই সঞ্চালনায় আসতে পারবেনা বলে তীব্র বাঁধার মুখে বার্মিংহাম আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক কামাল আহমদ দ্রুত মঞ্চ ত্যাগ করেন। হতবম্ভ বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন বার্মিংহামসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা বই প্রেমিক সাংস্কৃতিমনা শান্তিপ্রিয় মানুষেরা। অনেকেই এ সময় নিরাপত্তার খাতিরে অনুষ্ঠানস্থল ত্যাগ করেন।
অনভিপ্রেত অত্যন্ত লজ্জাজনক এই ঘটনা সামাল দিতে দ্রুত হস্তক্ষেপ করেন প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ, সহকারী হাই কমিশনার আলীম-উজ জামান, আওয়ামী লীগ নেতা ড. মিসবাউর রহমান, বার্মিংহাম আওয়ামী লীগের সভাপতি কবির আহমদ, আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতা এনামুল হক খান নেপা, শাহ রুকনুজ্জামান সহ অন্যান্যরা। তাদের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি তাৎক্ষনিক শান্ত হয়ে আসে।”
শুধু বার্মিংহামেই নয়, গত ১০ই অক্টোবর সম্পাদক ডট কম অনলাইন পোর্টালে খবর বেরিয়েছে, রবগুনার তালতলী উপজেলা ছাত্রদলের সাবেক সহ-সভাপতি জামাল মোল্লা ও উপজেলা শ্রমিক দলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক রফিক সর্দারের নেতৃত্বে তিন শতাধিক নেতা কর্মী আওয়ামী লীগে যোগদান করেছেন এবং তাদেরকে ফুল দিয়ে বরণ করা হয়েছে। বিষয়টি পাঠকদের বিশেষ ভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। কেননা, বিএনপি বর্তমানে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে হঠানার লক্ষ্যে যেখানে মরনপণ সংগ্রামে লিন্ত হয়েছে, ঠিক সে সময় বিএনপি থেকে ৩০০ জনের একটি বিরাট বহর নিয়ে আওয়ামী যোগদানের ব্যাপারটি সবার মনেই সন্দেহের সৃষ্টি করেছে!
সিলেটেও এ ধরণের ঘটনা ঘটেছে। গত ২৩শে অক্টোবর রবিবার ’বংলাদেশ প্রতিদিন’ পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে দেখা যায়, তিন বছর মেয়াদের কমিটির সময় শেষহতে চলেছে। এর মধ্যে তৃণমূলকে ঢেলে সাজাতে পারেনি সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগ। নানা অজুহাতে ওয়ার্ড কমিটি পুনর্গঠনে হাত দেননি মহানগর শাখার দায়িত্বশীলরা। শেষ পর্য্যন্ত কেন্দ্রের চাপে ওয়ার্ড কমিটি গঠন করতে গিয়ে আগুন ধরিয়ে দিয়েছেন তৃণমূলে।
তৃলমূলের অভিযোগ, ওয়ার্ড কমিটি গঠনে কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কাই করছেন না মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসেন। নিজের আত্মীয়-স্বজন ও বিএনপি-জামায়াত পরিবারের সদস্যদের হাতে তুলে দিচ্ছেন নেতৃত্ব এতে ত্যাগী ও পরীক্ষিত নেতা-কর্মীরা বঞ্চিত হয়ে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছেন।
আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের একমাত্র রাজনৈতিক একটি দল, যে দলের নেতৃত্বে দেশ স্বাধীন হয়েছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুশেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সে সময় দলমত নির্বিশেষে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ মুক্তিযুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ে, পাকিস্তানী শাসকদের পরাজিত করে তাদের আত্মসমর্পনের মাধমে দেশ স্বাধীন করে। আজ সেই আওয়ামী লীগের অবস্থা দেখলে বিশ্বাস করতে খুবই কষ্ট হয়। আওয়ামী লীগের এই দুরবস্থার নেপথ্যে কি?
বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, বিএনপি’র শাসনামলে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান যখন ক্ষমতায় বসেন, তখন বাংলাদেশ স্বাধীনতা বিরোধী রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামী, তাদের অঙ্গ সংগঠন সহ বিভিন্ন দল নিয়ে তিনি সরকার গঠন করেন। তখন থেকেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিরোধী শক্তিগুলো দেশে তাদের আসন গেড়ে বসে। সে সময় থেকেই বিএনপি-জামায়াত মিলে আওয়ামী লীগকে দ্বিধা-বিভক্ত করে রাখার লক্ষ্যে একটি নীল নকশা তৈরী করে। এই নীল নকশা অনুযায়ী তারা বিভিন্ন কৌশলে বিএনপি, জামায়াত, শিবিরের ক্যাডারদের আওয়ামী লীগে ঢুকিয়ে দিয়ে স্থায়ী ভাবে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে দলকে দ্বিধা বিভক্ত করে রাখার চেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে।
বিএনপি জামায়াত ভালো করেই জানে, রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের সাথে টক্কর দেয়া কোন মতেই সম্ভব নয়। সুতরাং তারা হাতিয়ার হিসেবে বেছে নিয়েছে তাদের ক্যাডারদের, যাদের তারা আওয়ামী লীগের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছে। তাদের দিয়ে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে জনগণকে আওয়ামী লীগ-বিরোধী করে গড়ে তোলা। এছাড়াও সরকারের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরণের প্রোপাগান্ডা তৈরী করে জনগণকে বিভ্রান্ত করে তোলা।
বর্তমানে বাংলাদেশে যে রাজনৈতিক অবস্থা পরিলক্ষিত হচ্ছে, তাতে স্পষ্টই বুঝতে অসুবিধা নয় যে, এগুলো স্বাধীনতা বিরোধীদের রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের নীল নকশা বাস্তবায়ন করার কৌশল মাত্র। স্বাধীনতা বিরোধীদের এই নীল নকশা ধূলিস্যাৎ করতে হলে, আর কাল- বিলম্ব না করে দলের মধ্যে স্বাধীনতা-বিরোধী ক্যাডারদের খুজে বের করতে হবে। চালাতে হবে দলের মধ্যে চিরুনী অভিযান। মনে রাখতে হবে, যে গাছের মধ্যে ঘুনি পোকা আক্রমন করে সেই গাছকে তারা ভেতরে ভেতরে নি:শেষ করে দেয়, সেই গাছ আর বেশি দিন দাঁড়িয়ে থাকতে পারেনা।
আওয়ামী লীগের মতো একটি বৃহত্তম রাজনৈতিক সংগঠনের মধ্যে যে স্বাধীনতা বিরোধী পোকা ঢুকেছে এদেরকে অতি সত্বর বের করে উপযুক্ত শাস্তির আওতায় আনা হোক। সেই সাথে দলের মধ্যে এদেরকে যারা প্রশ্রয় দিয়েছে তাদের বিরুদ্ধেও দলের সংবিধান মোতাবেক শাস্তির আওতায় আনা হোক। অন্যথায় আওয়ামী লীগের সুনাম ধ্বংস করা ছাড়া, রক্ষা করা কোনো মতেই সম্ভব হবে না। আওয়ামী লীগে ভেতরে একমাত্র শুদ্ধি অভিযানই রক্ষা করতে পারে তার সুনাম।
লেখকঃ দেওয়ান রফিকুল হায়দার (ফয়ছল), কলামিষ্ট, সিনিয়র সাংবাদিক ও সদস্য লন্ডন বাংলা প্রেসক্নাব