সাইফুল ইসলাম: ভাষা একটি জাতির ঐতিহ্যের বাহন, স্বাতন্ত্রের দলিল। মায়ের সঙ্গে যেমন নাড়ির যোগ থাকে, তেমনি ভাষার সঙ্গে যোগ থাকে প্রাণের। পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি জাতিরই নিজস্ব ভাষা রয়েছে। আমরা বাঙালি জাতি, আমাদের নিজস্ব ভাষা বাংলা।
বাংলা আমাদের মাতৃভাষা, বাংলা আমাদের প্রাণের ভাষা। এ ভাষা আমাদের চেতনার উদ্বোধক, ঐতিহ্যের স্মারক। বাংলা ভাষার রয়েছে এক গৌরবোজ্জ্বল আত্মত্যাগের ইতিহাস, যা পৃথিবীতে বিরল।
এই বাংলা ভাষায় আমরা কথাবলি ভাবের আদান-প্রদান করি। বায়ান্নোর আন্দোলনে মুখের ভাষা ছাড়া কোনো অর্জন নেই। রক্তঝরা সংগ্রাম আর অনেক আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমরা মাতৃভাষা হিসেবে পেয়েছি এ বাংলা ভাষাকে। তাই যে সংগ্রাম, যে ত্যাগের বিনিময়ে আমরা এ ভাষা অর্জন করতে পেরেছি, সে সংগ্রাম ও ত্যাগের কথা ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে চিরকাল।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ২১ ফেব্রুয়ারিকে জাতিসংঘের শিক্ষা বিজ্ঞান এ সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো ১৭ নভেম্বর ১৯৯৯ সালে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করেছে এবং ২০০০ সাল থেকে তা জাতিসংঘভুক্ত দেশসমূহে পালিত হয়ে আসছে।
ইউনেস্কোর পর জাতিসংঘও একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। এটি আমাদের বাংলা ভাষাভাষীদের জন্য একটি বড় পাওয়া। তাই বলি, বাঙালি জাতির একমাত্র গর্বের ও অহঙ্কারের বিষয় তার ভাষা, বাংলা ভাষা।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার বাংলা ভাষাকে দেশের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে মাতৃভাষা বাংলা আজ স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত। সরকার দেশের অফিস-আদালতে কাজকর্মে ভাষা হিসেবে বাংলা ভাষাকে ব্যবহার করার জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়েছেন।
দীর্ঘদিন অফিস-আদালতের কাজকর্মের ভাষা হিসেবে ইংরেজি ভাষার প্রচলন ছিল। ইংরেজ শাসনামলে দীর্ঘদিন অনুশীলনের ফলে দেশের সর্বাধিক কাজেই ইংরেজি ভাষা একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছিল।
বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতিদানের পরিপ্রেক্ষিতে ইংরেজির পরিবর্তে বাংলা ভাষা ব্যবহারের নির্দেশে আসে। তবে এ ক্ষেত্রে কিছু সমস্যাও সৃষ্টি হয়েছে। ইংরেজিতে শিক্ষালাভের ফলে এবং অফিস-আদালতে ইংরেজিতে কাজকর্ম পরিচালনায় অভ্যস্ত হওয়ায় দেখা দেয় নানা অসুবিধা।
বাংলাদেশে সকল অধিবাসীর মাতৃভাষা বাংলা। বাংলা ভাষাকে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে স্বীকৃতিদান করা হলেও এখনও পর্যন্ত উচ্চশিক্ষার বিভিন্ন ক্ষেত্রে, কারিগরি ও চিকিৎসা ক্ষেত্রে বাংলা ভাষা প্রচলন সম্ভবপর হয়নি এবং জীবনের সবক্ষেত্রে বাংলা ভাষা ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা আমরা অনুভব করিনি— এ বিষয়ে আমাদের নেই কোনো প্রস্তুতি।
এ ছাড়া আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলা এখনও নিজের যথাযথ অবস্থান করতে পারেনি। আইনি ভাষা এবং উচ্চতর ডিগ্রির পাঠ্যবই এখন ইংরেজিতে রচিত। আজও কোর্টে রায় লেখা হয় ইংরেজিতে। বিদেশি নির্দেশে পরিচালিত ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলগুলোতে এখনও বাংলা পাঠ্য নেই।
স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ইংরেজি শিক্ষাকে বেশি প্রধান্য দেওয়ায় মাতৃভাষা হিসেবে বাংলা তেমন গুরুত্ব পায় না এবং হয় না ভাষার যথাযথ ব্যবহার। এছাড়া সব কাজেই আমরা বাংলা-ইংরেজি মিশ্রণ করে কথা বলি। কেউ ভালো ইংরেজি বলতে না পারলে তাকে আমরা অবজ্ঞা করি। কিন্তু বাংলা ভাষায় যার পারদর্শিতা বেশি তাকে আমরা তেমন কদর করি না।
এভাবে বাংলা ভাষাকে বিভিন্ন দিক থেকে খাট করা হয়েছে। মাতৃভাষা বাংলার পরিবর্তে ইংরেজি ভাষার ব্যবহার ও মাতৃভাষার প্রতি উদাসীনতা এবং অবহেলা এটি আমাদের জাতীয় জীবনের বড় ধরনের ভুল বলে মনে করতে হবে। আমাদের মাতৃভাষা কখনই দীন নয়। পৃথিবীর অন্যান্য শক্তিশালী ভাষার মতো বাংলা ভাষা বিশ্বসাহিত্যে স্থানলাভের গৌরব অর্জন করেছে।
তাই বায়ান্নর রক্তঝরা সংগ্রাম ও আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত এই বাংলা ভাষা যেন তার যথাযথ ব্যবহার এবং যথার্থ মর্যাদা লাভ করতে পারে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে সবাইকে। তা হলেই বাংলা ভাষা ফিরে পাবে তার প্রাণ।