রাকিবুল হাসান: সিপাহী বিপ্লবের পর এ উপমহাদেশে দ্বীন প্রচার, ইসলামি শিক্ষা ও চেতনার প্রসার এবং মুসলিম স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে কথা বলার জন্য আলেমদের হাত ধরে বিভিন্ন উদ্যোগ শুরু হয়। এর মধ্যে আলেমদের অন্যতম একটি উদ্যোগ হলো সাংবাদিকতা এবং পত্রিকা প্রকাশ। শুধু বার্ষিক ওয়াজে নয়, আলেমরা জাগরণের বাণী নিয়ে মানুষের দুয়ারে উপস্থিত হতে চেয়েছিলেন প্রতিদিন সকালে। প্রতিদিন না পারলেও তারা চেয়েছিলেন সপ্তাহে একবার, কিংবা মাসে একবার হলেও হাজিরা দিতে। আলেমদের সম্পাদনায় প্রকাশিত এসব পত্রিকার মাধ্যমে ব্রিটিশ শাসন ও শোষণে জর্জরিত মুসলিম সমাজ শুনেছিল আশার বাণী, পেয়েছিল মুসলিম হিসাবে বেঁচে থাকার প্রেরণা।
সিপাহি বিপ্লবের মাত্র কুড়ি বছর পর ১৮৭৭ সালে ইসলাম ধর্মকেন্দ্রিক প্রথম বাংলা পত্রিকা প্রকাশ করেন মাওলানা কাজী আবদুল খালেক (রহ.)। তার প্রকাশিত সাপ্তাহিক পত্রিকাটির নাম ‘আখবারে মোহাম্মদী’। ১৮৮৯ সালে, বাঙালি মুসলিম সমাজের দুঃখ-দুর্দশার চিত্র তুলে ধরতে কলকাতা থেকে ‘সুধাকর’ নামের একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন মুন্সী মোহাম্মদ রিয়াজুদ্দীন আহমদ (রহ.)। এ ছাড়া তিনি একের পর এক সম্পাদনা করেন ‘মুসলমান’ ‘সওদাগর’ ‘ইসলাম প্রচার’ ও ‘সাপ্তাহিক সোলতান’। জীবনের শেষ পর্যায়েও দক্ষতার সঙ্গে তিনি সম্পাদনা করেন ‘নবযুগ’ ও ‘বয়াতবন্ধু’ পত্রিকা। এসব পত্রিকার বেশিরভাগ লেখকই ছিলেন আলেম সমাজের সদস্য।
মুসলিম জাগরণের প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী (রহ.) ১৯০৩ সালে তিনি সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজীর সঙ্গে ‘সাপ্তাহিক সোলতান’ পত্রিকা প্রকাশ করেন। কিছুদিন পত্রিকাটি প্রকাশিত হওয়ার পর বন্ধ হয়ে যায়। কয়েক বছর পর তিনি আবার পত্রিকাটি প্রকাশ করেন। ১৯২৬ সালে ‘সোলতান’ দৈনিক পত্রিকারূপে আত্মপ্রকাশ করে। মাওলানা ইসলামাবাদী ১৯০৬ সালে ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি’ প্রতিষ্ঠায় নেতৃত্ব দেন। ১৯১২ সালে তিনি ‘হাবলুল মতীন’ সম্পাদনা করেন। ১৯১৫ সালে ‘আল-ইসলাম’ পত্রিকা প্রকাশে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন। ১৯২৯ সালে তিনি ‘দৈনিক আমীর’ পত্রিকা প্রকাশ করেন। এ ছাড়া তখন মাওলানা আজিজুর রহমান-এর সম্পাদনায় ‘তাবলিগ’, মাওলানা শেখ আব্দুর রহীম-এর সম্পাদনায় ‘তরজমানুল হাদিস’ ও আরাফাত ইত্যাদি নিয়মিত প্রকাশ হতো।
মওলানা মুহম্মদ আকরম খাঁকে বলা হয় মুসলিম সাংবাদিকতার পথিকৃৎ। তিনি ১৯১০ সালে সম্পাদক হিসাবে যোগ দেন সাপ্তাহিক মোহাম্মদী পত্রিকায়। ১৯১৩ সালে গঠিত হয় আঞ্জুমানে ওলামায়ে বাংলা। ১৯১৪ সালে এখান থেকে প্রকাশিত পত্রিকা ‘আল ইসলাম’-এর যুগ্ম সম্পাদক ও প্রকাশকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন তিনি। খিলাফত ও অসহযোগ আন্দোলনে ভূমিকা রাখতে ‘দৈনিক যমানা’ নামে একটি উর্দু পত্রিকা তার সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় ১৯২১ সালে। একই বছর একই সঙ্গে দৈনিক সেবক সম্পাদনার দায়িত্বও পালন করেন তিনি। এরপর ১৯২৭ সালে সাপ্তাহিক মোহাম্মদীকে আরও রুচিশীল করে প্রকাশের জন্য মাসিক মোহাম্মদী নামে প্রকাশ করেন। ১৯৩৬ সালের ৩১ অক্টোবর দৈনিক আজাদ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশনায় হাত দেন আকরম খাঁ। অবিভক্ত বাংলায় মুসলমানদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক ও ধর্মীয় স্বার্থ রক্ষায় ‘আজাদ’ ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করে।
মাওলানা মুহিউদ্দীন খান বাংলাভাষায় ইসলামি সাহিত্য রচনা, সম্পাদনা ও প্রকাশনার ক্ষেত্রে অনন্যসাধারণ ভূমিকা পালন করেছেন। তিনি ছাত্রজীবনেই সাংবাদিকতা ও সহিত্যচর্চার দিকে ঝুঁকে পড়েন। তিনি ১৯৬০ সালে ‘মাসিক দিশারী’, ১৯৬৩ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত ‘সাপ্তাহিক নয়া জামানা’ সম্পাদনা করেন। ১৯৬১ সাল থেকে আমৃত্যু ‘মাসিক মদীনা’ সম্পাদনা করেছেন। এক সময় তার সম্পাদিত ‘আজ’ সাহিত্য মহলে সাড়া জাগায়।
বাংলাদেশের দুটি বহুল প্রচলিত ইসলামি পত্রিকা মাসিক রহমত এবং মাসিক আদর্শ নারী। হজরত মাওলানা মুহাম্মাদুল্লাহ হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) প্রতিষ্ঠিত পত্রিকা মাসিক রহমত ১৯৯১ সালে ডিক্লারেশন পায়। তবে নিয়মিতভাবে তা প্রকাশিত হয়নি। ২০০১ সালে কিছুদিনের জন্য প্রকাশ হয়ে আবার বন্ধ থাকে। তবে ২০০৫ সাল থেকে আবার নিয়মিত প্রকাশ হয়। টানা সাত-আট বছর চলার পর পত্রিকাটি আবার বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৯৪ সালের নভেম্বরে মুফতি আবুল হাসান শামসাবাদী মাসিক আদর্শ নারী প্রতিষ্ঠা করেন। শুরু লগ্ন থেকেই তিনি এ পত্রিকার প্রকাশক ও প্রধান সম্পাদকের গুরুদায়িত্ব পালন করে আসছেন। ৯০-এর দশকে সর্বমহলে লেখক ও পাঠক তৈরিতে মাসিক আদর্শ নারীর অবদান অনস্বীকার্য।
এখনো নিয়মিত কিছু পত্রিকা প্রকাশিত হচ্ছে। গবেষণামূলক উচ্চতর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মারকাযুদ্ দাওয়ার মুখপত্র হিসাবে মাসিক আল কাউসার প্রকাশিত হয়। মুফতি আবুল হাসান মুহাম্মদ আবদুল্লাহ সম্পাদিত পত্রিকাটি আলেম ও মাদ্রাসার ছাত্রদের কাছে খুবই জনপ্রিয়। আল্লামা শামছুল হক ফরিদপুরী (রহ.)-এর সাহেবজাদা মুফতি রুহুল আমীন সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় মাসিক আল আশরাফ। জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়া, মোহাম্মদপুর থেকে প্রকাশিত হয় রহমানি পয়গাম; পত্রিকাটি শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক (রহ.) কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত। জামিয়া আরবিয়া ফরিদাবাদ মাদরাসা থেকে প্রকাশিত হয় মাসিক নেয়ামত। পত্রিকাটি বাংলাদেশের সর্বপ্রাচীন পত্রিকা। মাওলানা শামছুল হক ফরিদপুরী (রহ.) নিজ সম্পাদনায় পত্রিকাটির সূচনা করেছিলেন। মাওলানা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদের সম্পাদনায় মাসিক পাথেয় বের হয় নিয়মিত। এ ছাড়াও চট্টগ্রাম থেকে মাসিক আত-তাওহীদ, হাটহাজারী থেকে মাসিক মঈনুল ইসলাম, ঢাকা যাত্রাবাড়ী থেকে মাসিক আল-জামেয়াসহ এখনো কিছু কিছু পত্রিকা নিয়মিত বের হচ্ছে।
আলেমদের বেসিক সাংবাদিকতার কোর্স-এর গোড়াপত্তন হয় বাংলাভাষায় অগণিত গ্রন্থ প্রণেতা আল্লামা শামছুল হক ফরিদপুরী রহ.-এর হাত ধরে। ফরিদাবাদ মাদরাসায় ১৯৬৭ সালে শুরু হয় কোর্সটি। কিন্তু দুবছর পর আর্থিক সংকটে থেমে যায় পথচলা। ১৯৮৬ সালে মিরপুরের মুসলিম বাজার মাদরাসায় মাওলানা শরীফ মুহাম্মদ ইউসুফ কর্তৃক দ্বিতীয়বারের মতো শুরু হয় বিভাগটি। এক বছর না যেতেই অর্থনৈতিক সংকটে এটিও মুখ থুবড়ে পড়ে। তবে বর্তমানে বিভাগটি মাওলানা মুহাম্মদ সালমান কর্তৃক ১৯৯৮ সালে দারুর রাশাদে প্রতিষ্ঠিত হয়ে আজো টিকে আছে।
দিন যত যাচ্ছে, আধুনিক মিডিয়ায় আলেমদের অংশগ্রহণ তত অনিবার্য হয়ে উঠছে। উম্মাহর কল্যাণে মিডিয়ায় অংশগ্রহণ এখন সময়ের দাবি। কাগুজে পত্রিকার জায়গা দখল করছে অনলাইন পত্রিকা। অনলাইনেও এখন জানাতে হবে সরব উপস্থিতি, দেখাতে হবে নিপুণ দক্ষতা। আল্লাহ তৌফিকদাতা।