দু’টি পাতা একটি কুঁড়ি উঠে আসে যে নারীদের হাত স্পর্শ করে। সেই নারীদের ঘামে ও শ্রমেই আজ চা শিল্প সুপ্রতিষ্ঠিত। যেসব নারী এই শিল্পকে অধিষ্ঠিত করেছেন মর্যাদার উচ্চাসনে, সেই তারা আজও মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। দারিদ্র্যতা, স্বাস্থ্যসেবা সম্পর্কে অসচেতনতা ও পুষ্টিকর খাবারের অভাবে স্বাস্থ্যঝুঁকিতে আছেন অধিকাংশ চা শিল্পের কারিগররা।
চা শ্রমিক ইউনিয়ন সূত্র মতে, সারাদেশে ১৬৬টি চা বাগানে শ্রমিক রয়েছেন পাঁচ লাখের বেশি। এর মধ্যে চা শ্রমিকের ৫১ শতাংশই নারী এবং পাতাতোলা শ্রমিকের ৯৫ শতাংশ নারী। যারা চা শিল্পের সবচেয়ে কঠিন কাজটি করে থাকেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ১৬৬টি চা বাগানের মধ্যে মৌলভীবাজারে রয়েছে ৯২টি। দৈনিক ১৭০ টাকা মজুরিতে রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে নারী শ্রমিকরা দলবেঁধে পাহাড়ের গা বেয়ে টিলায় টিলায় কাজ করেন। এর প্রেক্ষিতে পর্যাপ্ত খাদ্য, চিকিৎসাসহ মৌলিক অধিকার ঠিক মতো পান না তারা। অপুষ্টি ও দারিদ্র্যতায় যেন নতজানু এক একটি চা শ্রমিকের পরিবার।
জেলায় চা শ্রমিকদের নিয়ে কাজ করছেন এমন কয়েকজনের সঙ্গে আলাপচারিতায় জানা যায়, অধিকাংশ চা বাগানের শ্রমিকরা কুষ্ঠরোগ সম্পর্কে সচেতন নয়। নিম্নমানের জীবন যাপনের কারণেই চা শ্রমিকরা কুষ্ঠরোগে বেশী সংক্রমিত হচ্ছেন। অপুষ্টিজনিত রোগে আক্রান্ত এসব নারীরা বিভিন্ন রোগে ভুগছে। নারী চা শ্রমিকরা বিশেষ করে যারা গর্ভবতী, তারা গর্ভাবস্থায় প্রচুর যন্ত্রণা ও ভোগান্তির শিকার হন। তারা বেশিরভাগই গর্ভাবস্থার প্রায় শেষ সময় পর্যন্ত কঠোর পরিশ্রমের কাজ করেন। পাশাপাশি কর্মক্ষেত্রে পয়ঃনিষ্কাশন ও সুপেয় পানির অভাবে শ্রমিকরা অনেক কঠিন রোগের শিকার হন।
শ্রীমঙ্গলের রাজঘাট চা বাগানের প্রতিমা নায়েক ও দেওরাছড়া চা বাগানের দীপা তাঁতি, নীলু তাঁতিসহ একাধিক নারী শ্রমিক জানান, কর্মক্ষেত্রে বড় সমস্যা হলো তাদের প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে গিয়ে বিভিন্ন সমস্যার মুখে পড়তে হয়। পাশাপাশি চা বাগানের প্রতিটি সেকশনে ছাউনি না থাকার ফলে বৃষ্টি গায়ে মেখেই কাজ করতে গিয়ে ঠান্ডাজনিত নানা রোগে ভুগতে হয় তাদের।
স্থানীয় সমাজকর্মী সোনিয়া মান্নান বলেন, চা বাগানের প্রায় অধিকাংশ শ্রমিক কম লেখাপড়া জানেন। ফলে তাদের গর্ভবতী মায়ের স্বাস্থ্যঝুঁকি সম্পর্কে কোনো ধারণা থাকে না। আমাদের উচিত বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে চা বাগানে কর্মরত গর্ভবতী মায়েদের স্বাস্থ্যসেবা সম্পর্কে সচেতন করা এবং তাদের স্বাস্থ্যকেন্দ্রমুখী করা।
চা শ্রমিক সন্তান মিন্টু দেশোয়ারা বলেন, চা বাগানগুলোতে চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যসেবার মানের অবস্থা খুবই নাজুক। কারণ স্বাস্থ্যসেবার নামে এখানে চলছে রসিকতা। বিশেষ করে নারীদের কর্মক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় যে অসুবিধায় পড়তে হয় সেটি হলো, চা বাগানের সেকশনগুলোতে নারী চা শ্রমিকদের জন্য শৌচাগার নেই। বিষয়টির প্রতি দৃষ্টি দেওয়ার জন্য সরকার ও বাগান কর্তৃপক্ষের প্রতি দাবি জানান তিনি।
চা শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে কাজ করছেন এস এম শুভ। তিনি জানান, চা জনগোষ্ঠীর পুষ্টিকর খাবার দরকার। কিন্তু পুষ্টিকর খাবার কেনার জন্য যে অর্থের প্রয়োজন হয় তা তাদের মালিক কি দেবেন? যে টাকা মজুরি পান, প্রতিদিনের চাল কিনতেই তা শেষ হয়ে যায়। পুষ্টিকর খাবার কোথা থেকে আনবেন? চা শ্রমিকদের জীবন মানের উন্নতি করতে হলে তাদের দিকে সবার আরও বেশি নজর দিতে হবে।
বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক নৃপেন পাল নারীদের বঞ্চনার উদাহরণ দিয়ে জানান, মাতৃত্বকালীন ক্ষেত্রে চা বাগানের নারী শ্রমিকদের পূর্ববর্তী তিন মাসের কাজের ওপর ভিত্তি করে ভাতা দেওয়া হয়। ফলে কিছু বেশি ভাতা পাওয়ার জন্য গর্ভাবস্থায় বাগানের নারীরা আরও বাড়তি পরিশ্রম করেন। এতে মা ও সন্তান দু’জনেই স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ে।
নিউজ /এমএসএম