একটি নিয়োগ পরীক্ষার রেজাল্ট শিট। নয়ছয় নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় সরব। এটা পুকুর চুরি নয়, অনেকটা সাগর চুরি। এমনটি মন্তব্য সুশীল সমাজ ও ক্ষতিগ্রস্তদের। অভিযোগ উঠেছে জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয়ে ৭টি ক্যাটাগরিতে নিয়োগে ব্যাপক অনিয়ম, দুর্নীতি ও সিন্ডিকেট করে কয়েক কোটি টাকা বাণিজ্য করেছে একটি চক্র।
সাম্প্রতিক সময়ে এমন ঘটনা স্যোশাল মিডিয়ায় চাউর হলে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জেলাবাসীর। নিয়োগ বঞ্চিত ও সচেতন মহল নিয়োগকৃতদের চাকরি বাতিলের জোর দাবি জানাচ্ছেন। ওই নিয়োগ বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত থাকার গুরুতর অভিযোগ উঠেছে নিয়োগ কমিটির সদস্য, পরীক্ষক ছাড়াও ২ জন এমপি ও ১ জন মন্ত্রীসহ সিভিল সার্জন অফিসের ৪ জন কর্মচারী ও ২৫০ শয্যা সদর হাসপাতালের একজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে।
স্যোশাল মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়া একটি রেজাল্ট শিটে দেখা যায় পরিসংখ্যানবিদ, স্টোরকিপার, গাড়িচালক, ক্লোড চেইন টেকনিশিয়ান, ল্যাবরেটরি এটেনডেন্ট ও অফিস সহকারী কাম মুদ্রাক্ষরিক ৬টি পদে ১২ জন নিয়োগ পেয়েছেন। ১২ জনই সনাতন ধর্মাবলম্বী।
এর কারণ অনুসন্ধানে জানা যায় সিভিল সার্জন অফিসের যারা নিয়োগ দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন তারা ৫ জনই সনাতন ধর্মাবলম্বী। ওই সময়ের স্রোত ও আর্থিক দুর্নীতির বিষয়টি ধামাচাপ সহজ হবে বলে ওদেরকে নিয়োগ পাইয়ে দেন। ফলাফলের দিক থেকে ১ম হয়ে কমলগঞ্জের রুবেল আহমেদ নিয়োগ বঞ্চিত হলেও ৩য় হওয়ার পরও শুধু টাকা ও সনাতন ধর্মের লোক বলে গাড়িচালক হিসেবে নিয়োগ পান শুভচন্দ্র পাল।
এ ছাড়া স্বাস্থ্য সহকারী পদে ৭১টি পদের মধ্যে (৯টি স্থগিত/বাতিল) নিয়োগ পেয়েছেন ৫৫ জন সনাতন ধর্মাবলম্বী। ৭৪টি পদের মধ্যে ৬৭ জনই সনাতন ধর্মাবলম্বী অধিক গুরুত্বে নিয়োগ পান। আর ৪টি কোটায় নিয়োগ পান ২০ জন। অভিযোগ রয়েছে ভুয়া তথ্য দিয়েও অনেকেই টাকার জোরে নিয়োগ পান। জানা যায় ৭টি ক্যাটাগরিতে ২০১৮ ও ২০২৩ সালে দু’টি পৃথক নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয়।
এতে ৯৫টি পদের জন্য ২০ হাজার ৮শ’ ৬৯ জন আবেদন করেন। এরমধ্যে লিখিত পরীক্ষায় অংশ নেন ৮ হাজার ১৫৪ জন। উত্তীর্ণ হন ৫৯৭ জন। মৌখিক পরীক্ষা শেষে চলতি বছরের ১৬ই জুলাই ৯৩ জনের নিয়োগ চূড়ান্ত করা হয় (আইনগত জটিলতায় স্বাস্থ্য সহকারী ৩টি পদ স্থগিত থাকে)। নিয়োগ প্রক্রিয়া, পরীক্ষাসহ সকল আনুষ্ঠানিকতা ঠিকটাক দেখালেও যারা চাহিদামতো বড় অংকের টাকার যোগান দিয়েছেন কেবল তারাই নয় ছয়ের মাধ্যমে যোগ্য বলে নিয়োগ পান। এমন অভিযোগ চাকরি বঞ্চিতদের।
ভালো পরীক্ষা দেয়ার পরও অকৃতকার্য হওয়ায় প্রার্থী ও তাদের স্বজনদের সন্দেহ হয়। তখনই নিয়োগে অনিয়ম দুর্নীতি ও অস্বচ্ছতা নিয়ে অভিযোগ তোলেন। চাকরি বঞ্চিতরা বলছেন যারা নিয়োগ পেয়েছেন তাদের ওই প্রশ্নে আবারো পরীক্ষা নিলে নির্ঘাত অকৃতকার্য হবেন।
অভিযোগ উঠেছে সরাসরি এই দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন সিভিল সার্জন অফিসের প্রধান সহকারী অসিত চক্রবর্তী, হেড এসিস্টেণ্ট কাম ক্যাশিয়ার রঞ্জনা দেবী, পরিসংখ্যানবিদ অহিজিৎ দাস রিংকু, স্টোরকিপার অলকচন্দ্র পাল ও ২৫০ শয্যা সদর জেনারেল হাসপাতালের প্রশাসনিক কর্মকর্তা সিতাংশ আচার্য্যসহ অন্যরা। এরা দীর্ঘদিন থেকে একই অফিসে কর্মস্থল হওয়ায় দাপটের সঙ্গে দুর্নীতি, ঘুষ ও নিয়োগ বাণিজ্যসহ সকল অপকর্মের সঙ্গে জড়িত রয়েছেন।
তাদের দাপটের কারণে সিভিল সার্জন অফিসের কোনো কর্মকর্তা কর্মচারী তাদের বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস পান না। ওই ঘটনার নেপথ্যে আর্থিক বাণিজ্যে জড়িত ছিলেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক ও মৌলভীবাজার-২ (কুলাউড়া) আসনের সাবেক এমপি শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল, মৌলভীবাজার-৩ (সদর ও রাজনগর) সাবেক এমপি ও অলিলা গ্রুপের কর্ণধার মোহাম্মদ জিল্লুর রহমান, মৌলভীবাজার-৪ (কমলগঞ্জ ও শ্রীমঙ্গল) সাবেক এমপি ও কৃষিমন্ত্রী বীর মুক্তিযোদ্ধা উপাধ্যক্ষ ড. আব্দুস শহীদ, বিএম এর মৌলভীবাজার জেলা সভাপতি ডা. সাব্বির আহমদ খান। ওই নিয়োগ কমিটিতে আহ্বায়ক ছিলেন বিভাগীয় পরিচালক (স্বাস্থ্য) সিলেট, ডা. মো. আনিসুর রহমান, সদস্য ছিলেন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের (স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ) উপ-সচিব মনিরা পারভীন, পিএসসির উপ-পরিচালক মো. জাহাঙ্গীর আলম, মৌলভীবাজারের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মো. আব্দুস সালাম, সদস্য সচিব ছিলেন জেলা সিভিল সার্জন ডা. চৌধুরী জালাল উদ্দিন মুর্শেদ।
অভিযোগ উঠেছে ওই নিয়োগ বাণিজ্যের যাবতীয় কলকাঠি নেড়েছেন সিভিল সার্জন অফিসের ৪ জন, সদর জেনারেল ২৫০ শয্যা হাসপাতালের-১ জন, বিএমএ’র ১ জন ও নিয়োগ বোর্ডের ৩ জন। আর তাদেরকে প্রশ্রয় দিয়ে প্রভাবিত করেন স্থানীয় ২ জন এমপি, ১জন মন্ত্রী ও বিএমএ’র নেতারা।
এ ক্ষেত্রে তারা দালালের মাধ্যমে পরীক্ষার্থীদের কাছ থেকে টাকা সংগ্রহ করেন। তারা নিয়োগ কমিটিসহ অন্যান্য সংশ্লিষ্ট সদস্যদের ম্যানেজ করে চাকরি দেয়ার শর্তে অন্তত ৫০-৬০ জন প্রার্থীর কাছ থেকে ৫-৬ লাখ টাকা হাতিয়ে নেন। নিয়োগের পরও আরেক দফা পোস্টিং বাণিজ্য করেন সিভিল সার্জন অফিসের সংশ্লিষ্টরা।
এ ছাড়া ২০২৩ সালেও আউট সোর্সিং নিয়োগেও অনুরূপ দুর্নীতি হয়েছিল বলে অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের। ওই নিয়োগেও জড়িত ছিলেন সিভিল সার্জন অফিসের কর্মকর্তা, কর্মচারী ও বিএমএর নেতারা।
এ বিষয়ে নিয়োগ কমিটির সদস্য উপ-সচিব (স্বাস্থ্য-৬ শাখা) স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় মনিরা পারভীন ও সদস্য সচিব মৌলভীবাজার সিভিল সার্জন ডা. জালাল উদ্দিন মুর্শেদ মুঠোফোনে জানান, নিয়োগ পরীক্ষায় কোনো দুর্নীতি হয়নি। সরকারের সকল নিয়ম কানুন মেনেই নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে।
নিউজ /এমএসএম