শুক্রবার, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৮:২৫ পূর্বাহ্ন

যুক্তরাজ্যে দাঙ্গা: ‘ভেবেছিলাম বর্ণবাদের দিন শেষ’

যুক্তরাজ্য অফিস
  • খবর আপডেট সময় : সোমবার, ১২ আগস্ট, ২০২৪
  • ২৩ এই পর্যন্ত দেখেছেন

যুক্তরাজ্যের সাউথপোর্টের ছুরিকাঘাতে তিন শিশুর মৃত্যুর প্রতিবাদে শুরু হওয়া বিক্ষোভ তীব্র আকার ধারণ করেছে। হামলাকারীর পরিচয় সংক্রান্ত ভুয়া তথ্য এই বিক্ষোভকারীদের ক্ষোভের আগুনে যেন ঘি ঢেলে দিয়েছে। আর এই ক্ষোভের নিশানা হয়েছে মূলত মুসলিম ও এশীয় অভিবাসীরা।

ইংল্যান্ড ও উত্তর আয়ারল্যান্ডে গত সপ্তাহের এই দাঙ্গা এতটাই তীব্র আকার ধারণ করেছে যে ৭০ দশকের দাঙ্গার বেদনাদায়ক স্মৃতি মনে করে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন ব্রিটিশ এশীয়রা। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির এক প্রতিবেদনে তাদের আতঙ্কের কথা ওঠে এসেছে।

মসজিদ লক্ষ্য করে ইট-পাথর ছোঁড়া হচ্ছে। মিছিলকারীরা স্লোগান দিচ্ছেন ‘আমরা আমাদের দেশ ফিরে পেতে চাই।’ বর্ণবাদী হামলার সময় এক ব্যক্তি মাথায় আঘাত পেয়ে গুরুতর আহত হওয়ার কথা জানা গেছে।

ইংল্যান্ড এবং উত্তর আয়ারল্যান্ডে গত সপ্তাহের এই দৃশ্যগুলো ব্রিটিশ এশীয়দের ১৯৭০ এবং ৮০’র দশকের বেদনাদায়ক স্মৃতির কথা মনে করিয়ে দিয়েছে। তখন ব্যাপক পরিসরে বর্ণবাদী সহিংসতা ছিল। বর্তমান ছিল ন্যাশনাল ফ্রন্টও।

৭০ বছর বয়সী হরিশ প্যাটেল বলেছেন, চলমান এ দাঙ্গার ঘটনায় তার হৃদয় ভেঙে গেছে। তিনি বলেন, কিশোর-কিশোরীরা তাদের বাবা-মা এবং দাদা-দাদির কাছ থেকে শুনে থাকবে এই দেশে জীবন কেমন ছিল। হয়তো ‘তারা ভাববে সব শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু এখন তারা নিজেরাই তা অনুভব করছে।’

সাউথপোর্টে তিনটি অল্পবয়সী মেয়ের ওপর মারাত্মক ছুরি হামলার জেরে বর্ণবাদের এই ব্যাধি আবারও শুরু হয়েছে। ধারণা করা হয়, সন্দেহভাজন ওই হামলাকারী একজন মুসলিম আশ্রয়প্রার্থী ছিল।

এ ঘটনা এশীয় এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মধ্যে ভয়ের জন্ম দিয়েছে।

ব্রিটেনে বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনে সত্তর ও আশির দশকে বাংলাদেশিরা।

ব্রিটেনে বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনে সত্তর ও আশির দশকে বাংলাদেশিরা।

বয়স্ক এক এশীয় নারী মুংরা ৫০ বছর আগে কেনিয়া থেকে যুক্তরাজ্যে এসেছিলেন। তাকে যেন লন্ডনের সেই প্রথমকার দিনগুলোতে ফিরিয়ে নেওয়া হয়েছে। তার উদ্বেগ ছিল, ক্রমবর্ধমান সহিংসতার কারণে বাড়ির কোণের ওই দোকানটি থেকে তার দুধ কিনতে অনেক কষ্ট হবে। তার কথায়, লন্ডনের প্রথমদিকের ‘দিনগুলোতে আমরা এমনই অনুভব করতাম। এ নিয়ে আমি উদ্বিগ্ন।’

১৯৫০’র দশকে কারখানা এবং জনসেবা খাতে কাজ করতে হাজার হাজার দক্ষিণ এশীয়রা যুক্তরাজ্যে এসেছিলেন। তখন দেশটি যুদ্ধ-পরবর্তী অর্থনীতি পুনর্গঠনে কাজ করছিল।

১৯৭০’র দশকের গোড়ার দিকে দেশটির জনসংখ্যা বেড়ে প্রায় ৫ লাখে পৌঁছেছিল। তখন পারিবারিক পুনর্মিলন হয় এবং এশীয়রা পূর্ব আফ্রিকা থেকে পালিয়ে আসে। তাদের মধ্যে অনেককে উগান্ডা থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল।

অভিবাসন একটি রাজনৈতিক ইস্যু হয়ে ওঠে। ১৯৬৮ সালে কনজারভেটিভ এমপি এনোক পাওয়েল ‘রক্তের নদী’ হিসেবে খ্যাত বিস্ফোরক বক্তৃতা দিয়েছিলেন। বক্তৃতায় তিনি বলেছিলেন, গণ অভিবাসনের অনুমতি দিয়ে দেশটি ‘নিজের কবর খুঁড়ছে।’

তখন চরম ডানপন্থি ন্যাশনাল ফ্রন্ট সবচেয়ে সোচ্চার ছিল এবং নিয়মিত সভা-সমাবেশ করত। এশীয়দের প্রতিদিনের হয়রানি এবং পুলিশি বর্বরতার সঙ্গে লড়াই করতে হয়েছিল।

মুংরা বলেছেন, ‘তখনকার পরিস্থিতি এবং বর্ণবাদের ভয় এতটাই গভীর ছিল, আমি যে কৃষ্ণাঙ্গ তা উপেক্ষা করা কঠিন ছিল।’

তিনি আরও বলেন, ‘রাস্তার হাঁটার সময় গালিগালাজ শোনা একটি সাধারণ বিষয় ছিল।’

পশ্চিম লন্ডনের এশীয় প্রধান অংশ সাউথহলে দাঙ্গার সাক্ষী ছিলেন মুংরা। স্থানীয় শিখ কিশোর গুরদীপ সিং ছাগ্গার বর্ণবাদের কারণে হত্যার শিকার হন। এর তিন বছর পর ১৯৭৯ সালে সেসব দাঙ্গা সংঘটিত হয়।

ব্রিটেনে বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনে সত্তর ও আশির দশকে বাংলাদেশিরা।

ব্রিটেনে বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনে সত্তর ও আশির দশকে বাংলাদেশিরা। সাধারণ নির্বাচনের কয়েক সপ্তাহ আগে, ন্যাশনাল ফ্রন্ট সাউথহলের টাউন হলে সভা করার সিদ্ধান্ত নেয়।

উগ্র ডানপন্থি এবং পুলিশের বর্বরতার প্রতিবাদে রাস্তায় নেমেছিল হাজার হাজার এশীয় এবং বর্ণবাদ বিরোধী মিত্ররা।

মেট্রোপলিটন পুলিশের তথ্যানুসারে, দাঙ্গায় ২১ জন পুলিশসহ ৪০ জন আহত হন। তখন আরও ৩০০ জনকে গ্রেফতার করা হয়। হত্যাকাণ্ডের শিকার হন এক শিক্ষক।

ভীত-সন্ত্রস্ত ৫০ বছর বয়সী ইকবাল জানান, তিনি আতঙ্কিত এবং তার সন্তানরা তাকে বাইরে না যেতে নিষেধ করেছিল।

ইকবাল বলেছিলেন, ‘আমি ভেবেছিলাম, বর্ণবাদের এই দিনগুলো বুঝি শেষ হয়েছে।’

সাম্প্রতিক দাঙ্গার সাত দিনের মাথায় আশ্রয়প্রার্থীদের আবাসনের হোটেলগুলোতে হামলা হয়েছিল। সংখ্যালঘুদের মালিকানাধীন ব্যবসা লুটপাট এবং গাড়ি ও ভবনে আগুন দেওয়া হয়। এ ঘটনায় ৪০০ জনের বেশি মানুষকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

বিবিসি জানায়, মুসলমানদের বিশেষভাবে টার্গেট করা হয়েছিল। মসজিদে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ, ইসলামবিদ্বেষী স্লোগান এবং বার্নলিতে মুসলিম কবরস্থানে ভাঙচুর চালানো হয়।

দাঙ্গার সময় পুলিশ টহল জোরদার করা হয়েছিল। তবে কিছু তরুণ বলেছেন, সুরক্ষার জন্য পুলিশ কর্মকর্তাদের বিশ্বাস করে না তারা।

২০ বছর বয়সী তরুণ মোহাম্মদ বলেন, ‘আমাদের মনে হয় না তারা আমাদের রক্ষা করবে যেখানে তারা এখন পর্যন্ত আমাদের রক্ষার চেষ্টা করেনি। মনে মনে আমরা অনেক দুর্বল অনুভব করি। আমরা মনে করি, আমাদেরই নিজেদেরকে রক্ষা করতে হবে ।

২০ বছর বয়সী মুসলিম হামজা মরিস বলেছেন, ‘আমি এমন দুর্বলতা অনুভব করতে চাই না। তাদের মতো আমিও এই দেশেরই অংশ।

নিউজ/ যুক্তরাজ্য / কেএলি

দয়া করে খবরটি শেয়ার করুন

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

এই ক্যাটাগরিতে আরো যেসব খবর রয়েছে
All rights reserved © UKBDTV.COM
       
themesba-lates1749691102